পিতৃস্মৃতি
– সুমিত্র দত্ত রায়
স্বাধীনতা সংগ্রামের দাবানল রোষে
যখন শোনিত দানে ব্যস্ত – সর্বনাশে
বদ্ধ, উন্মাদনা মত্ত, শত সংগঠন,
যুবশক্তি দিগ্বিদিকে ঘোষে মহারণ –
মাতৃপনে রাজবন্দী ছিলো।কারাগারে
কেটেছিল দীর্ঘকাল যাঁর, অগোচরে
সুদীর্ঘ জীবন মাঝে, বিদ্ধ হয়েছিল
যে বা নুতন যৌবনে। কী ফল লভিল?
অন্তিমশয্যায় আজ শয্যা তাঁর পাতা –
মরণের নাগপাশে বেঁধেছে বিধাতা,
সর্বচেষ্টা করিয়া নিস্ফল, শুধু যারা
তাঁর শিক্ষনে সমৃদ্ধ ছিলো, দিশেহারা
পান্থসম – প্রচারিবে তাঁরে সর্বজনে,
অমরত্ব দান করি রাখিবে স্মরণে।
_______
নিবেদন – পিতা ঈশ্বর যোগেশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতির উদ্দেশ্যে। বরিশালের পাট গুটিয়ে পানিহাটীতে কেবলমাত্র নিজে ছাত্র-ছাত্রী পড়িয়ে জীবনধারণ করেছেন চরম দুর্দিনে। তাঁর ইহলোকে অবস্থান কাল – ১০ই ডিসেম্বর ১৯০৯ হতে ২৫শ আগস্ট ১৯৭৮ পর্যন্ত।
বিদ্রোহী কবি
– সুমিত্র দত্ত রায়
রত্নমনি সম্ভারিত বঙ্গ জননীরে
অলঙ্কার, বর্ণচ্ছটা, ছন্দরাগে ঘিরে
সজ্জিত করিলো প্রাণ। এক পূর্ণ জ্যোতি
অন্তর গর্জনে জ্বালে শৃঙ্খলিত বাতি –
আলোক রঞ্জিত। দীন-পরাধীন টানে,
উৎসর্গ করে প্রাণ স্বাধীন গগনে।
বিদ্রোহের প্রজ্বলিত শোভা বহ্নিশিখা
দীপ্তিময় বিদ্রোহীর – শিরে যায় দেখা।
হুহুঙ্কারে ভরে পৃথ্বী! যেন ঝঙ্কারিয়া
বিদ্রোহের বানী গেল শুধু নিরখিয়া
নিঃশব্দে নীরবে; কী বা যত্নে তাঁর বীজ
হয়েছে লালিত, কী বা কষ্টে সরসিজ
ফুটন্ত সলিলে। তাঁর, সে বিদ্রোহী মন
অবশেষে শিশু সম মুদিল নয়ন।
কাঠাম
– সুমিত্র দত্ত রায়
পূজো পর্ব শেষ হলো। চলছে বিজয়া।
আলিঙ্গন, প্রণাম. আর আনন্দচ্ছায়া -
না ফুরোতেই রুজির জন্য হন্যে হয়ে
ফেরা। পুজোয় হয়নি জামা,গেছে সয়ে
সপ্তমী কালীরও। তার বাবা সতার -
চিন্তা শুধু কোনোমতে যোগানো আহার।
সতা মানে সনাতন। জাতেতে ধীবর,
সনাতন ধর্মে যার পূর্ণ আজি ঘর -
চার মেয়ে পাঁচ ছেলে নিয়ে। ছোট ছেলে
কালি, খালি গায়ে ঠাকুর দেখতে গেলে
কষ্ট হয় তার। কিন্তু তবুও , অভাব
সাথে ভাব করে ওরা, সংসারে সদ্ভাব
রাখে দারিদ্র্য মোচনে। সকলেই জানে,
বাবা ওদের সারাদিন খাদ্য সন্ধানে
চেষ্টা করে কতো!
আজো বাপ বেটা মিলে
রুজির সন্ধানে নৌকো ভাসিয়েছে জলে।
টাকা যদি কিছু মেলে, আশা বুক ভরা।
মনে পরে, যেন ক্ষ্যাপার সে খুঁজে ফেরা
পরশ পাথর। আকাশে পূর্ণিমা চাঁদ -
ঝলসানো রুটি! নাঃ, ওরা আজ বিষাদ
ভুলে, চলে ভাগীরথী কুলে। বাতাসেতে
আর্দ্রভাব ব্যাপ্ত চারিধার, পরিচিতে
শারদ আকাশ। মৃদুমন্দ বায়ু বয়,
ঠাণ্ডাভাব আছে, সময়টা ভাল নয়।
কিন্তু হায়!ভেজাভাতও জোঠে না যার
শীতের কাঁপুনি, বিলাস কী নয় তার?
নৌকা চলে কূল বরাবর। দোলা খায়।
তালে তালে কখনোবা সতা গান গায়
ভাটীয়ালি সুরে। সুর বহু পুরাতন,
তবু কথার বাঁধনে এসেছে নুতন
নয়া সমাজের ডাকে। ব্যথার আঁচড়ে
সুর বয়ে চলে আর প্রতিধ্বনি ফেরে।
হঠাৎ বিরতি।
‘হেই বাপ ! দেখ্ দেখ্
বিরাট কাঠাম। ‘
‘তাই তোরে! লৌকো রাখ
উটার গায়েতে, উজানে বাইয়ে চল্
জলদি উদিকে।’
বেটা মতির উজ্জল
চোখ। দুগ্গা মাঈ বুঝি মাগ্গি দেখে
নিজিই এয়েচে।
মনে মনে স্বপ্ন এঁকে
সতা ভাবে কাল, ছোট জামাগায়ে দেবে,
চাল ডাল কিনে বুঝি লুঙ্গিটাও হবে,
বিশাল কাঠাম!
লম্বা বৈঠা নিয়ে হাতে
ছেলে তার ব্যস্ত বড় উজানে বাহিতে,
মনের আবেগ বয় স্রোতকে ছাপিয়ে।
কতদিন পরে চুলা নিয়ে মায়েঝিয়ে
ঝগড়া হবে কাল। হূক্কার ডান্ডি নেড়ে
মজা লুঠবে সতা।
‘রশিটা আঁট করে
ফাঁস মার। হাল ধরি আছি আমি, তুই
হিঁচকে টানডা মার। বাঃ দেখ দেখ ঐ
দুগগি মার আপন দয়াতে, কাঠাম
এটিছে ফাঁসে। ধিরি আয়।’
মাথার ঘাম
পায়ে ফেলা সার্থক ক’রে দেবী কঙ্কাল
ধরা দেয়। বারেক নৌকা দোলে উত্তাল
দোলে। বাঁধা পরে ঠাকুরের লাশখান।
হেলেদুলে নৌকা চলে।
ভাঁটিয়ালী গান,
নতুন উদ্যমে ফের মুক্তি পায় সেথা।
কোমোল রাগিনী এক অভাবের কথা
আর দুঃখের ব্যাখ্যান। আাশা ছিলো যতো
ফুটে ওঠে একে একে, ছায়াছবি মত
গানের কলিতে।
‘ওঠ মতি, ঘাট এলো,
চল বাবা, কাঠামটা তোল।’
বাঁশ নিলো
বাপবেটা দুজনায় কাঁধে। বেঁধেছেদে
কাঠামটা তায়, ভালো করে এঁটে, সিধে
রওনা দিল ওরা, লক্ষ্য কুমোর পাড়া,
মোটে একক্রোশ, তারজন্য ভ্যানভাড়া!
সে অসম্ভব। কাঁধে ওঠে ঠাকুর মড়া।
মাঝখানে বদ্ধ কাঠামটা রেখে ওরা
পালকি চলে তালে দুলকি চালে চলে।
মাঝ মাঝে ঠান্ডাতেও ঘাম ঝেড়ে ফেলে,
তবু চলে।
বসাবসা চোখ, ঘোলাদৃষ্টি,
পাঁজর নজর বুক, সমাজের সৃষ্টি
এ এক বিচিত্র গড়ন, কাঁধেতে দেবী
অধিষ্ঠিতা, কঙ্কাল রূপিনী। যদি ছবি
আঁকা যেতো, পুরস্কার মিলে যেতো ঠিক,
ছবি মিউজিয়মের এক নির্মম নির্ভিক
প্রতিশ্রুতি রূপে। কোন কোটিপতি হাতে
বিক্রি হত ছবিখানা আর্ট গ্যালারিতে
মাধুর্য্য বাড়াতে!
কুমোর পাড়ায় আসে
বাপবেটা মিলে। কাঠামটা রেখে, শ্বাসে
বুক ভরে নেয়। পথ চলা শেষ হয়
বাপবেটা দুজনেই এখন নির্ভয়।
‘হেই দুখীর বাপ, আয় দেখবি আয়,
কাঠাম এনেছি এক; সামলানো দায়-
ইত্তো বড় সিটা। ঠাকুর বানাতি গেলি
পেথ্থম মশল্লা খান বড়সর হলি
তবেই না খাসা! কি বলিস? দে দে
দামটা চুকায় দে, বাজার করবো গে।
দরজা খুলে দুখীর বাপ শুনছিল,
খোঁচাদাড়ি চাঁছা মাথা কাঁছা বেঁধে নিলো
কাঠামটা দেখে আনমনে বলে “বটে!
কাঠামটা বেশ বড়ো!”
আনন্দের চোটে
সতা লাফ দিয়ে ওঠে। ‘ভালই মিলবে
খুড়ো তাই লয়? কিগো? কত দিবে?’
সতার গলায় বেশ উৎকন্ঠা ভাব,
ভাল করে লখে খুড়ো জুড়লো জবাব,
“ওমা!একি? এ যে ঘুনেধরা! আর কুনো
লুতন ঠাকুর হবে না ইটাতে। শুনো,
কাঠামটা বদলাতি হবে। জুত সই
লয় একদম।
নীরব প্রতিক্ষা। অথৈ
সাগর থেকে তোলা ঝিনুক মুক্তো ছাড়া
জেনে, ডুবুরির ক্লান্তিভরা মনে, ফেরা।
বেশ কলরব। একদল চাটুকার
নিয়ে, ফুলবাবু চলেছেন বিজয়ার
শুভাশীষ দিতে। কাঁধেশাল কোঁচাধুতি
গিলেকরা পান্জাবী, উচ্ছল তার গতি।
বাতাস আতর গন্ধে বেশ মাতোয়ারা।
পথের দুধার জুড়ে শীর্ণ মানুষেরা
কানাকানি করে। তাদের হটাতে ব্যস্ত
লেঠেলের দল। ডান্ডা নিয়ে সেকি মস্ত
হাঁকাহাঁকি, হেই হট.. ফুলবাবু যাবে।
সতা ভাবে – কাঠামটা বদলাতি হবে।
কবি পরিচিতি

সুমিত্র দত্ত রায় কবির ছদ্মনাম। প্রকৃত নাম সংকেত চট্টোপাধ্যায়।
আমি ছেলেবেলা থেকে ভাগীরথী কূলে বড় হয়েছি। আমার একাধিক লেখার প্রেরণায় গঙ্গার ভুমিকা অনেক। ওখানেই দেখেছি সূর্যাস্ত বা তৎকালীন মেঘরঞ্জনী। আদি বাড়ির কথা দিদির চোখে দেখা। বরিশালের শোলক গ্রামেই পিতৃভূমি ও বাটাজোরে মাতুলালয় ছিল। পিতা ঈশ্বর যোগেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মাতা ঈশ্বর বিজনবালা দেবী। পারিবারিক জীবনে স্ত্রী রুমা চট্টোপাধ্যায় আর এক কন্যা সপ্তদ্বীপা চট্টোপাধ্যায়। ভাই নেই। দুই দিদি, গীতা মুখার্জী আর অঞ্জনা মুখার্জি। পিতা যোগেশচন্দ্র ছিলেন দেশপ্রেমিক। বরিশাল হতে বন্দী হয়ে দমদম সেন্ট্রাল জেলে বদলি হন। তাঁদের রক্তে কিছুটা দুঃসাহসী আমিও ছিলাম। কিন্তু কবিতার জগত আমার নিজস্ব মনে হত সেই দশবছর বয়সেই। আবৃত্তি, গান, ছবি আঁকা আমার খুবই পছন্দসই ছিলো। চাকুরিজীবী ছিলাম। এলাহাবাদ ব্যাংকে আধিকারিক। বদলির চাকরি। তাই ২০১২ সালে স্বেচ্ছায় অবসরের পর বাংলা কবিতা ডটকমে লেখা শুরু, আমার কন্যাপ্রতিম সোমালীর হাত ধরে। আর পিছু ফিরে তাকাই নি, এখন ওটাই ধ্যান জ্ঞান।