শুক্লা বোস – কবিতাগুচ্ছ – ৩

নারী বন্দনা

– শুক্লা বোস

ওগো পুলক আলোক বন্দিতা,
ওগো মনোহারী মন নন্দিতা।
তুমি প্রেমের কুসুম নন্দিনী,
মম মন মন্দিরে ছন্দিনী।
ওগো হৃদয় গহনে পূজিতা–
মম প্রেমের বাসরে সৃজিতা।
তুমি মৃদু মন্থরা গামিনী,
মম চিত-চঞ্চলা কামিনী।
ওগো পরাণের পুরবাসিনী,
ওগো মায়াময়ী মৃদু হাসিনী।
তুমি চন্দ্রিমা মধু যামিনী,
মম অমরাঙ্গনা ভামিনী।
ওগো পূরব গগনে অলকা,
তুমি সুনীল আকাশে বলাকা।
ওগো নব মেঘদূত দুহিতা,
তুমি অদ্রিশিখর বাহিতা।
মম অভ্যুদিত বাসনা–
তুমি পুরজনবাসী শাসনা।
ওগো অমরাবতীর বালিকা,
তুমি কুন্দ কুসুম কলিকা।
ওগো বিশ্ব-ভুবন জয়িতা —
তুমি বিষ্ণুমোহিনী দয়িতা।
আছো সৃষ্টমাঝারে ব্যাপিয়া,
দিনু তোমারে পরাণ সপিয়া!!

নষ্টা

– শুক্লা বোস

সেদিন গোধূলি বেলা অবসান, কৃষ্ণানদীর তীরে,
আবিরের রাগ মিলায়ে আকাশে সন্ধ্যা নামিছে ধীরে।
চারিদিকে আজি ভীষণ কুয়াশা, শুনশান নদি তীর,
শীতের সন্ধ্যা, কেহ নাই ঘাটে, বহি চলে নদী ধীর।
গৌরী নামের গৌরী বালিকা একা চলিয়াছে পথে,
রাঙা ফিতা দিয়া বাঁধা বেণী দুটি লুটিতেছে তার পিঠে।
শীতের সময়ে নদীতীরে জাগে শ্যামল সবুজ ঘাস,
সে ঘাস পারায়ে নদি জলে চরে তার দুটি পোষা হাঁস।
মাকে বলিছিলো, “মাগো, যাই তবে, নিয়ে আসি হাঁস ঘরে,
ঘন কুয়াশায় হারাবে যে পথ, আসিতে পাবেনা ফিরে।”
মা বলিল আজ, “সাবধানে যাস শীঘ্র আসিস ফিরে,
ফেরে যদি বাপ্, করিবে যে রাগ তোরে না হেরিয়া ঘরে।”

ছোটো বোন তার ধরিল বাহানা, “আমি যাবো দিদি সাথে।”
গৌরী বলিল, “আজ থাক বোন, অনেক বিপদ পথে। “
বিপদের কথা শুনিয়া হঠাৎ কাঁপি ওঠে মার মন,
সভয়ে সবেগে, “দূর্গা, দূর্গা” করিল সে স্মরণ।
দ্রুত পদে তবে চলিলো গৌরী কোন দিকে নাহি চায়,
নির্জন পথে একাকী বালিকা, বুকে জাগে আজি ভয়!
দক্ষিণ পাড়া আসিলো ছাড়ায়ে – এক জানোয়ার,
একাকী বালিকা হেরিয়া নয়ানে লালসা জাগিল তার।
লুকায়ে যুবক পিছু নিলো তার, বালিকা না জানে কিছু,
সাক্ষাৎ যম হয়ে আগুয়ান লয়েছে তাহার পিছু।
কিছু না জানিয়া কিছু না বুঝিয়া নামিলো সে নদী তটে,
পোষা দুটি হাঁস দুই কাঁখে লয়ে ফিরিতে চাহিল বাটে।
হঠাৎ শিহরি, সমুখে কী হেরি! বালিকা উঠিল কাঁপি,
সম্মুখে তার দাঁড়ায়েছে কাল, দিগদিগন্ত ব্যাপী!
উঠিল সহসা বুনো কালো ঝড় মেলিয়া লোলুপ থাবা,
নধর দেহটি ছিন্ন করিল, বাঁচাবে তাহারে কেবা?
কচি কণ্ঠের ভীত চিৎকার শুনিলো না কেহ হায়!
হাহাকার রবে ক্ষীণ স্বর তার বাতাসে মিলায়ে যায়।
ফেলিল বাতাস হু-হু নিঃশাস, কাঁদিল সবুজ ঘাস,
নীরব সাক্ষী শান্ত নদীটি ফেলিলো দীর্ঘশ্বাস!
অচেতন দেহ রুধিরে নাহিয়া পড়িয়া রহিলো ঘাটে,
পোষা দুটি হাঁস কাঁখে লয়ে সে যে ফিরিলো না আর বাটে।
সেদিন নিশীথে বহু খোঁজ শেষে অচেতন দেহ তার,
বুকে তুলি লয়ে গভীর আঁধারে ফিরিল যে বাপে ঘর।
রক্তধারায় সিক্ত বসন, ক্ষতবিক্ষত দেহ,
কন্যার লোহু ভিজালো বসন, ফিরিল আপন গেহ।
প্রতিবেশী সবে ছুটিয়া আসিলো মার চিৎকার শুনি,
সান্ত্বনা আর শুশ্রুষা দিল, দিল যে প্রবোধ বাণী।
দরিদ্র পিতা বিচার চাহিয়া ফিরিল যে দ্বারে দ্বার,
কোথায় বিচার? কে করে বিচার? দরিদ্র কন্যার!

********

বৎসর দুই হইলো অতীত বালিকা সারিয়া ওঠে,
আজিকে সে আর নহেকো বালিকা–যৌবন যেন ফোঁটে।
বহু যত্নেতে বহু খুঁজি পিতা পাত্র আনিলো বটে,
পাড়া পড়শিরা করে কানাকানি – “নষ্টা”নামটি রটে।
যতবার পিতা খুঁজি আনে বর ততবার ভাঙে বিয়ে,
শৈশবক্ষত সারিলো না আর – রহিলো “নষ্টা” হয়ে।
বহু অপমানে বহু অভিমানে মার অন্তর ফাটে,
অন্তর্জ্বালা ক্রোধাগ্নি হয়ে কন্যার পরে লোটে।
“ওরে হতভাগী! মরিলি না কেন, কেন বা আসিলি ফিরে”
এমনি সকল আকথা-কুকথা ঝরে গৌরীর শিরে।
নত মস্তকে পাষাণ প্রতিমা সকলি সহিয়া যায়,
ঘর বাঁধিবার আজন্ম সাধ চিরতরে মুছে যায়!
কাঁদে একাকিনী নীরবে আড়ালে গোপন অশ্রুভার,
অবিরাম ঝরে হৃদয়ের পরে, কেহ নাই মোছাবার!

********

গ্রীষ্ম-দহন হইয়াছে শেষ — নবমেঘসম্ভার,
গুরুগুরু রবে কাঁপিয়া বাতাসে ঘেরিয়াছে অম্বর।
ঘেরিল আকাশ ঝরিল বরষা ঝরঝর বারিধারে,
হু-হু করি বায়ু বহে অবিরাম কৃষ্ণা নদীর তীরে।
মত্ত বরষা-মত্ত তটিনী উন্মাদবেগে ধায় —
মুছি তটরেখা ক্ষীণ নদীটি যে প্রমত্ত বয়ে যায়।
উন্মাদ বেগে ছুটিয়াছে বারি, দুকূল প্লাবিয়া বহে,
ঘোর আঁধারেতে ঘেরা চারিধার মত্ত মদির মোহে।
ঘূর্ণিপ্লাবনে ছুটিছে উর্মি মেলিয়া লোলুপ জিহ্বা,
মনে হয় আজি গ্রাসিবে কাহারে হানিয়া বিরাট থাবা!

********


গভীর নিশীথে একাকী গৌরী নামিয়া আসিলো পথে,
ঘোর আঁধিয়ার ঘন বারিধার বজ্র নামিল সাথে।
কোনদিকে তার নাহি দৃকপাত নির্জন পথে চলে,
ধীরপদভরে একাকী যুবতী আসিলো নদীর কূলে।
প্রমত্তা নদি বহি চলে বেগে ধরিয়া বিপুল বেশ,
তার জীবনের কলঙ্কতট নাহি আর অবশেষ।
ধীরে ধীরে নারী আরো ধীর পায়ে স্পর্শে অতল জল,
মুহূর্ত মাঝে ঝাঁপ দিল সে যে – বিকল চিত্ততল!
পরম আদরে নদীমাতা তারে কোলেতে লইলো তুলি,
জনমের তরে ঘুচালো তাহার “নষ্টা” নামের গালি!
মার মত সেই শীতল তটিনী নিলো তারে কোলে তুলি,
পরমাশ্রয়ে ত্যাজিল জীবন “নষ্টা” নামটি ভুলি!

কৃষ্ণা নদীটি আজো বহি চলে গৌরীর স্মৃতি বয়ে,
যেই নদীবুকে ঘুমালো গৌরী ভ্রষ্টা নামটি লয়ে।
আজো কাঁদি ফেরে সকরুণ সুরে কৃষ্ণা নদীর বায়ু,
যেই নদী সনে মিশিয়া রয়েছে গৌরীর ক্ষীণ আয়ু।
এমনি করিয়া যুগে যুগে কেন হয়ে যায় নারী “নষ্টা”?
পুরুষ কেনরে হয়না নষ্ট — বলিতে কি পারো স্রষ্টা?


কবি পরিচিতি

শুক্লা বোস। মোংলা অঞ্চলের জ্ঞানের প্রধান বিদ্যাপীঠ শেলাবুনিয়ায় অবস্থিত সেন্ট পলস্ উচ্চ বিদ্যালয়-এর স্বার্থক ও কৃতি শিক্ষিকা। সুদীর্ঘকাল শিক্ষকতার পর শিক্ষার্থীদের প্রাণপ্রিয় এই শিক্ষিকা মার্চ ৪, ২০২০সাল থেকে অবসরে আছেন।

ছেলেবেলার থেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, জীবনানন্দ দাশ সহ বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য প্রথিতযশা কবি ও সাহিত্যিকদের লেখার সান্নিধ্যে বেড়ে উঠেছেন। কখনও কখনও লিখেছেন আত্মার সন্তুষ্টির জন্য। আত্মপ্রচারে বিমুখ হওয়ায় নিজের ভিতরেই রেখেছেন নিজেকে – তেমনভাবে বাইরে প্রকাশিত হয়ে ওঠা হয়নি।

বর্তমানে অবসর জীবনের একঘেঁয়েমি কাটিয়ে জীবনযাত্রায় কিছুটা ভিন্নতা ও বৈচিত্রের ভিতর দিয়ে সময় কাটানোর জন্যই বেছে নিয়েছেন বই পড়া ও লেখালেখিকে। সাহিত্যের মাধ্যমে মানুষের আত্মশুদ্ধি হোক, মানুষ সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠুক – এই প্রত্যাশাই তার ভাবনায় জীবন জুড়ে বিকশিত।