মল্লিকা রায় – কবিতা ( নিশ্চুপ নেতৃত্ব, প্রেমকাব্য হত যদি, এক গুচ্ছ মহাপুরুষ, বাড়ন্ত নুন)

,

নিশ্চুপ নেতৃত্ব

– মল্লিকা রায়

আমাদের একপাশ এখন সংঘর্ষ ক্ষেত্র
অন্যপাশ মদমত্ত জাতীয় কমিটির একতা মঞ্চ
আমরা সমস্ত উৎসবে
দুই পাশকেই আলিঙ্গন করি কেউ সাদা টুপিতে
কেউ বিজয়ার সন্ধিক্ষণে, কেউ কোরান পড়ি
কেউ গীতা কেউ বাইবেল |
একদিন আমি দেখেছিলাম একজন পোপ সহজ ভাষায়
আমাদের কথা বলছে, আনোয়ারের বোনের
কথা বলছে, যে বোনটিকে উদ্ধার করেছিল
ইসলামি এক ভাই আটদিন পর পঁচে যাওয়া
পানা পুকুরের পাঁক থেকে
ধর্ষক গ্রাম প্রধানের এক্সট্রা পাইয়ে দেওয়ার নিভৃত
অঞ্চলের, অন্ধকার আলোতে মোদো বাপের
ট্যাকে গুঁজে দেওয়া কড়কড়ে নোটের বিনিময়ে।
আমারই গ্রামের।
একদিন এসেছিল
চাল ধার করতে, অন্যদিন মায়ের ওষুধের পঞ্চাশটি টাকা
সঙ্গে ওর অন্ধ বাপ
চিৎকার করে বলেছিল বাবু গৃহ যোজনায়
আমার বদলে ওরা লিখেছে জমিদারের ভাইপোর নাম
মা মরা একটাই মেয়ে বাবু বড় অসহায়
হোগলা পাতার ঘর, ভয় হয় বাবু
বলেছিলাম জোড়হাত নামা – চেঁচিয়ে কথা বল, রুখে দাঁড়া
প্রয়োজনে উঁচিয়ে ধর টাঙি
তেড়ে যা শয়তানের সামনে চিৎকার করে বল
দিবি কি না নইলে এক কোপে —-
বলেছিলাম –
পরের দিন আমার বোনও, টাঙি নিয়ে
রুখে দাঁড়াতে পারিনি, আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম
দিন ক্ষণ পেরিয়ে হাসপাতালের বেডে
আজও সর্বাঙ্গ অসার, ডাক্তারি ভাষায়
কোয়াড্রিক প্যারালাইসড।

প্রেমকাব্য হত যদি

– মল্লিকা রায়

তুমিও তো মহাকাব্য বোনো কষ্টি ফলকে
কত শত খোদিত অধ্যায়
সেদিন দেখেছি শিয়রে প্রতাপ ছিল
বর্মের উজ্জল আভাস, হাঁটাপথে মৃদু অচঞ্চল
এত এত বর্ণ ভর করে, এতটা মগ্নতা আর
দুরন্ত কথায় কার পানে চাও সখা
কারে চাও অনঙ্গ রসদ সেবিতে – সে বুঝি আরাধ্যা
নিয়নের আলো যারে ছোঁয় সে তো কৃষ্ণকলি
তারে খোঁজ তুমি রাশ চুল পিঠে যার
জ্বলন্ত নাগিনী, পিঠ বেয়ে ছেয়েছে অতলে
এই বুঝি শেকড় ছড়াবে, রাশি রাশি শিরস্ত্রাণ মেয়ে!
তার ছায়া বুকে এসে পড়ে
ডাহুকের তপ্ত দুপুরে?
উদাসীন পটে সেও বিভঙ্গ নর্তকী!

কারে চেয়ে এত কথা জমা কর পাষাণ ফলকে
যে কষ্টি ভাঙে রোজ
অহর্নিশ ধিকি জ্বলে খোদিত অক্ষর
পায়ে যার সূক্ষ্ম নোলক, অংশীভূত অতশীর
মাটি গন্ধ মাথায় জড়িয়ে
শুয়ে থাকে জলের উপর, হি হি হাসে জ্বলন্ত পেটে
বজ্রে যার দৃশ্য খেলা করে, সেই মেয়ে!

এতটা ধৈর্য্য সখা কার সেবা নিতে
নিত্য ঘাটে সেও তার কলস ডোবায়, পঙ্ক মেখে ফেরে
আঁতেল ঝুমুরে বেজে ওঠে সেও
ভেসে আসা কবে কোন গান
পাতা হয়ে কলস জড়ায়ে, কোলে, কাঁখে দিব্য ছিল সুখে
কার যেন নিপাট অসুখ, চোখ বেয়ে
ছেয়েছিল চোখে,
সেই থেকে সেই থেকে চোখের অসুখ!

সেই মেয়ে সখা!
সেই মেয়ে, মহাকাব্য কষ্টি পাথরে ছেয়ে আছে
খাঁ খাঁ ওই বুকের ভিতর?

এক গুচ্ছ মহাপুরুষ

– মল্লিকা রায়

কাল রাত্রে জীবনানন্দকে দেখলাম
নির্বিঘ্নে হেঁটে যাচ্ছেন
সেই ট্রামলাইনটা কেন্দ্র করেই –
চেঁচিয়ে উঠলাম
থামুন, থামুন কবি –
বারংবার আপনাকে হারাতে পারব’না
অড়হড় ক্ষেত ধরে আলপথের মাঠে
পোয়াতি রোদ্দুর ছোঁওয়া শালীধানের
চূড়বৃন্তে মদেমত্ত বসন্তের খুনসুটি-
আমার তন্বী হবার সেই মুহূর্তটা
ফ্রক পাল্টানোর সেই মুহূর্তটা
থাকনা বুক সেল্ফে
কিছুটা ভালোবাসা হয়ে!

শ্বেতমূর্তি থেকে
নেমে আসছেন রবীন্দ্রনাথ
বাম হাতে একগুচ্ছ ওকালতনামা
দেশটাকে আবারও বাঁচাতে হবে
স্বাধিকার এখনও পারেনি
প্রত্যাশিত সময়টা গড়ে তুলতে
বিবেক, বৈরাগ্য খুইয়ে
একদল বিক্রেতা
হরপুন তাসের আসরে
হৈ হল্লায় মত্ত
সদ্য পাওয়া মসনদটা আবারও হাতছাড়া হবে!

শরৎচন্দ্র পালাচ্ছেন রেল লাইনের
পেছনের পথ ধরে
বৈধব্য ঘুচিয়ে ছোট্ট মেয়েগুলোকে
বসিয়েছিলেন খাজাঞ্চিতে, একই চেয়ারে
হলেন দন্ডিত!
জাগরণ থেকে উঠে আসছেন রামমোহন
সঙ্গে বেন্টিঙ্ক হাতে মৃত্যুজয়ের উইল
স্বাধীনতা!

চতুর্দিকে মহাপুরুষদের ধুম
একা আমি অনাড়ম্বর ছুটে চলেছি ট্রাম লাইন
আম্রকুঞ্জ, দেউলটি পেরিয়ে
শেলী, বায়রন, কীটস, গোর্কির দেশে!!

বাড়ন্ত নুন

– মল্লিকা রায়

মাথা ঠুকে বসে আছি
একটু নুনের জন্য, হা পিত্যেশ
মরিচ তেল জুটলেও
নুন কিন্তু বাড়ন্ত
লক্ ডাউন পর্বের মত
ওখানেই স্থিত হোন
তৈরী যারা দোকানের খোঁজে
বোঝার উপায় নেই
বাইরে থেকে বন্ধ সব
টোকা দিলেই খসে পড়ছে
এক একটি ফিলিস্তিনি পর্ব
নুন নেই – অঢেল চিনি
পিছ পথে রপ্তানী হয়ে গেছে!

ঝনঝন কাঁকন
উঠে যাচ্ছে সামাজিক কোরক
পরোয়া নেই
পরস্ত্রীর আঁচলে যুক্তাক্ষর
চার পাঁচ অধ্যায়ে
নুন চিনির তফাৎ খুঁজছে
পরিত্যক্ত বৌ –

জোরে হাঁটতে পারবেন

মাথা উঁচু রেখে?
ইমেজের ডগা থেকে আদ্যপান্ত
খেয়ে নেমেছে ওপাশের টিম
এপাশের ঘেমো জার্সির
খসখস রাঙ্ক লিখছেন, নুন বিক্রেতা


কবি পরিচিতি


মল্লিকা রায়। বারাসাত, উঃ চব্বিশ পরগণা। লেখেলেখি একপ্রকার নেশা। বাৎসরিক ‘পদক্ষেপ’ সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদিকা।​