“কবিদা”র সিকুয়েন্স

– যোষেফ হাজরা

১ কবিদার বিবাহ

সে হইল আমাদের কবিদা। এলাকার সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যক্তিত্ব তাহার। এমন কেহ নাই যে তাহাকে বুঝিতে পারে। কারণ সে যাহা বুঝিতে পারে অন্য কেহ তাহা বুঝিতে পারে না, অন্য কেহ যাহা বুঝিতে পারে সেও তাহা বুঝিতে পারে না। কবিদার নিকটে সকলেই উপন্যাসের চরিত্রে মত ‘ধোঁয়া তুলসী পাতা’।

আমরা সেই কবিদার বিবাহ হইতে ফিরিতেছি। আসিবার সময় সকলের আমেজ বাড়িয়া বহুগুণে বৃদ্ধি পাইয়াছে। যাইবার সময় ভালোয় ভালোয় গিয়াছিলাম কিন্তু এখন উত্তম-মধ্যম করিয়া ফিরিয়া আসিতেছি। এজন্যই আমাদের আমেজ অত্যাধিক বাড়িয়াছে।

কবিদার বিবাহ কবিদারই অনুরূপ কোন এক সাদাসিধে পরিবারে হইবার কথা ছিল, কিন্তু তাহা হইল না। হইল গিয়া এলাকায় প্রভাবশালী ফারহাদ মোল্লা বাড়িতে। তবে মনে হয় কবিদাকে ওখানেই ঘর জামাই থাকিতে হইতে পারে। কিন্তু ঘর জামাই হইলে আমরা যাহারা আজিকে লাঠিসোটা নিয়া বিবাহ বাড়ী হইতে ফিরিয়া আসিতেছি তাহারা কবিদার সম্মুখে কী করিয়া দাঁড়াইবো তাহাই ভাবিতেছি।

কবিদা মোল্লা সাহেবের বাড়িতে কাহাকে যেন সংগীত শিখাইত। মোল্লা সাহেবের ছেলেমেয়ে তাহারা নয়, কারণ তাহারা বিদ্যালাভের জন্য শহরে অবস্থান করিত। সেই দিন কবিদা সংগীত শিখাইয়া মোল্লা সাহেবের বাড়ী হইতে বাহির হইতেছিল। তখন কবিদার সহিত মোল্লা সাহেবের দেখা। মোল্লা সাহেব কবিদাকে দেখিয়া ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “গানটাতো তুমি ভালই শিখাও, কিন্তু তোমার নাম কী বাবা?”

কবিদা নাম বলিল। এরপর সে আবার জিজ্ঞাসা করিল, “শুধু গান করলেই কি হবে? কাজ-বাজ কর কিছু নাকি?”
কিন্তু তাহার প্রশ্ন শুনিয়া কবিদা চটিয়া উঠিল। “এটাই তো আমার কাজ। শুনুন মশাই, কিছু মানুষের জীবন, জন্ম, মৃত্যু আর বিবাহের মধ্যই আবদ্ধ। আমি তাদের মধ্যে নই।”

এই কথা বলিয়া কবিদা হনহন করিয়া চলিয়া গেল আর মোল্লা সাহেবের মাথার উপর দিয়া তাহার কথা উড়িয়া গেল। আমরা পাশের দোকান বসিয়া ছিলাম, এই ঘটনার পর আমাদের মধ্যে দারুণ হাস্য-কৌতুকের উদয় হইল। কারণ মোল্লা সাহেবকে এ হেন কথা কাহাকেও বলিতে শুনি নাই।

এদিকে মোল্লা সাহেব এই কথা শুনিয়া স্তম্ভিত হইয়া গেলেন। তাহার পর কবিদার বিষয়ে খোঁজ লাগাইলেন। সে কী করে? কেন করে? তাহার এত সাহস কেন? তিনি জানিতে পারিলেন কবিদার স্বপ্ন একদিন সাহিত্যে নোবেলজয়ী হওয়া। তাই সে মনে যাহা বিশ্বাস করে তাহাই বলিয়া ফেলে।

কবিদা সর্বদা বলিয়া থাকেন – “কেউ কি নিজের কাছে মিথ্যা বলতে পারে?”
বা ধরুন বলে – “আমি যেমন সাপের মত সতর্ক তেমন কবুতরের মত সরল।”

সব কিছু শুনিবার পর একদিন মোল্লা সাহেব কবিদার বাড়িতে ঘটক পাঠাইলেন। তাহার খুব ইচ্ছে তাহার একমাত্র কন্যাকে গ্রামের সুপাত্রের সহিত বিবাহ করাইয়া কন্যাকে যেন চোখে চোখে রাখিতে পারেন। এছাড়া কবিদার সৎ সাহস আর উচিত কথা শুনিয়া তিনি বড়ই প্রীত হইলেন। কিন্তু মোল্লা সাহেবের কথা শুনিয়া কবিদা বলিল, “যার মস্তিষ্ক শূন্য তার ঐশ্বর্য বৃথা।”

কিন্তু এই কথা শুনিয়া মোল্লা সাহেবে বড়ই প্রীত হইলেন। ঘটককে দিয়া তাকে বলাইলেন, “তাহার কন্যাও রূপে-গুণে অনন্যা। চারুকলার ছাত্রী সে। তুমি বিবাহ করিবে তার কন্যার সহিত, মূর্খদের সহিত নয়।”
কবিদার প্রত্যুত্তর, “কিন্তু যে পাত্র ভরা তাকে কীভাবে পূর্ণ করা যায়। আমি চাই আমার বউকে সব শিখিয়ে পড়িতে নিতে।”

বেশ বুঝাইবার পর এই কথায় আসিয়া থামিল – “যে তোমাকে বুঝিতে পারে তাহাকেই তোমার গ্রহণ করা উচিত।” কবিদার হয়তো এই কথা মনে ধরিল।

তো আর কি, বিবাহ বাড়িতে আসিয়াছি। তিন হাজার লোকের বিশাল আয়োজন। মোল্লা সাহেবে কেটারস্-দের দিয়া খাবার পরিবেশন করাইতেছে। আমাদের অন্যান্য বিবাহের মত কোমর বাঁধিয়া কাজ করিতে হইল না। হবু ভাবীর বান্ধবীদের সিগনাল মারিতেছি।
– আরেক পিস মাছ দেও না।
– কি হবে না।
– মোল্লা সাহেব এতই কৃপণ।
– গিফ্ট তো আর সস্তা দেই নাই।

এক কথায় দুই কথায় কেটারস্-দের সহিত মারামারি বাঁধিয়া গেল। সেই দেখা-দেখি মোল্লা সাহেবদের প্রতিদ্বন্দ্বী শরিকেরা একটা ছুতা পাইয়া আমাদের সহিত মারামারিতে যোগ দিল। আশে পাশের অন্যান্য লোকেরা খাবার ফেলিয়া পালাইয়া গেল। যুদ্ধ শেষ করিয়া আমরা কবিদা ও ভাবীকে খুঁজিয়া পাইলাম না। শেষমেশ কবিদার বিবাহ ভাঙিয়া দিয়া আসিলাম।

কিন্তু দুইদিন পরে শুনি এ কী অবাক কান্ড। কবিদা ভাবীকে লইয়া যুদ্ধ হইতে বীরের ন্যায় পলায়ন করিয়াছে। মোল্লা সাহেব নাকি তাতে অখুশি হয় নাই। কন্যাকে বিবাহ ভাঙা হইতে বাঁচানো সে তো এক মহৎকার্য।

দুই দিন পরে আমাদের কবিদার বাড়িতে ডাক পড়িয়াছে। শুনিয়াছি তাহার শালিকাগণ আসিয়াছে। কী জানি আবার যদি চান্স পাই। হটাৎ ফোনটা বাজিয়া উঠিল
– হ্যালো, কে বলছেন?
– মারামারি তো ভালই শিখছ।
একটা মেয়ে কন্ঠস্বর ফোনের অপর প্রান্ত থেকে শোনা গেল।

পুনশ্চ – আমাদের প্রকাশনীতে এই লেখাটা গল্পকারের বোন ডায়েরি হইতে চুরি করিয়া পাঠাইয়াছে। ছোট্ট মনিকে প্রকাশনীর পক্ষ থেকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।

২ কবিদার পান্ডুলিপি

কবিদা এইবার নির্ঘাত পাগল হইয়া যাইবে। কবিদার ট্রাঙ্ক ভরা কবিতার পান্ডুলিপি সব উধাও। দুপুর বেলায় কবিদার স্ত্রী ট্রাঙ্ক খুলিয়া দেখিতে পাইল সেখানে কয়েকটি মাত্র কবিতার খাতা পড়িয়া আছে। কবিদাকে সে এই কথা কী করিয়া জানাইবে? কবিদা ঝগড়া করিতে জানে না, স্ত্রীর উপর ক্ষমতা দেখাইতে পারে না, দুঃখ পাইলে কবিদা উদাস হইয়া বসিয়া থাকে। মনের দুঃখে কবিতা লেখে। মনে সুখ আসিলে, প্রেম আসিলে সে তাহা বোঝাইতে পারে না। একা একা কবিতা লেখে। তাহার বিষয়বুদ্ধি নাই, শোক নাই, সুখ নাই, তাহার সম্পদ শুধু তাহার কবিতা। এইগুলো হারাইয়া ফেলিলে কবিদা কী করিয়া বাঁচিবে?

কবিদার ঘরে তিনজন সদস্য। তাহারা দেবা-দেবি সহ কবিদার বাপ-মা মরা ভাই। বিবাহের পরে কবিদার স্ত্রী তাহার দেবরকে পুত্র স্নেহে মানুষ করিয়াছিল। তাহার নাম গোপী। গোপীও কবিদার মত শান্ত-শিষ্ট। কবিদার সহিত শুধু তাহার একটাই পার্থক্য যে, সে কবিতা লেখে না, এমকি কবিতা বোঝেও না। সারাদিন ঘুড়ি উড়াইতে পারে, মাছ ধরিতে পারে, পাঠশালায় লেখাপড়া নিয়মিত করিতে পারে।

কবিদার পান্ডুলিপি উধাও দেখিয়া কবিদার বউয়ের মনে সন্দেহ হইল। হয়তো সে এইকাজ করিতে পারে। সন্ধ্যার সময় গোপী ঘরে ফিরিয়া আসিলে কবিদার বউ গোপীকে জিজ্ঞাসা করিল-
– হ্যাঁ রে, গোপী। ট্রাঙ্ক ভরা কতগুলো খাতা ছিল। তুই কি জানিস সেগুলো কোথায়?
– আমি তো জানি না বউদি। আমি কেমন করে জানব?
– সত্য কথা বল। এতগুলি খাতা কোথায় গেল?
– আমি সত্যিই বলছি আমি জানি না, আমি নেই নাই।
– সত্যি কথা না বললে আমি কিন্তু তোর দাদা ফিরলে সব তাকে বলে দিব।

এই কথা শুনিয়া গোপী ভ্যাঁ ভ্যাঁ করিয়া কাঁদিয়া দিল। কবিদা যদি জানিতে পারে সে তাহা চুরি করিয়াছে তাহা হইলে সে তাহাকে কী করিবে তাহা সে নিজেও জানে না। সে কি জানে এই খাতাগুলির মধ্যে কী বস্তু আছে? কবিতার খাতার পিছনে ফাঁকা পৃষ্ঠা পাইয়া সে ওখানে বাড়ির কাজ লিখিয়াছে। খাতা শেষ হইয়া গেলে তাহা বেচিয়া দিয়া দেলবাহার খাইয়াছে। দেলবাহার হইল পুরানো রস দিয়া বানানো শুকনা কটাকটে এক ধরণের মিষ্টি।

ইতিমধ্যে কবিদা ঘরে ফিরিয়া আসিয়াছে। বাজার হইতে চাল, মুদি, বাতাসা কিনিয়া আনিয়াছে। ঘরের বারান্দায় তাহারা দুইজনে দাঁড়াইয়া আছে দেখিয়া সে গোপীকে জিজ্ঞাসা করিল, “কিরে গোপী তুই এখানে দাঁড়ানো কেন? পড়তে বসিস নাই?”

গোপী কবিদার দিকে তাকাইতে পারিল না। তখন কবিদা বলিল, “যাইহোক পড়তে বসিস নাই যখন, তখন বাতাসা খেয়ে পড়তে বস। রসিদ আমাকে ওর দোকানের বাতাসা ধরিয়ে দিয়ে বলল সে আজকে আমার কাছ থেকে বাতাসার দাম নিবে না।”

এই বলিয়া কবিদা বাতাসার পুঁটলি লইয়া খুলিতে লাগিল। আর কোন কথার উত্তর না দিয়া তাহারা দুইজন দাঁড়াইয়াই থাকিল। বাতাসার পুঁটলি খুলিতে গিয়া কবিদার মনে হইল, যে খাতার পৃষ্ঠা দিয়া এই পুঁটলি করা হইয়াছে, সেটা তাহারই হাতের লেখা। তাই সে সেটাকে খুলে পড়িতে লাগিল।
-এ্যা, এটাতো শুধু আমার হাতের লেখা নয়। এ যে আমার কবিতা। এখানে কী করে এটা আসলো?

তখন বাতাসা ফেলিয়া সে তাহার ট্রাঙ্কের কাছে গেল। ট্রাঙ্কে তালা থাকে না কখনো। সে ট্যাঙ্ক খুলিয়া দেখিল ট্রাঙ্ক প্রায় ফাঁকা। কবিদা এই দেখিয়া মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িল।

কবিদা অনেক ভাঙিয়া পড়িয়াছিল এই ঘটনার পর। এতিম ভাইকে সে কিছু বলিতে পারে নাই। সে তো যাহা সব সময় করে তাহাই করিয়াছে। পুরাতন খাতাতে লিখিয়া সংসারের খরচ বাঁচাইতে গিয়াছে। সে কি জানে এই গুলো তাহার কবিতা? কবিদার পুর্বে তাহার এক কবি বন্ধু ছিল। তাহারা সাতশো গানের খাতা ফিরিঙ্গি এক পাদ্রি মশাইকে দিয়াছিল। ভাবিয়া ছিল সবার উপকার করা পাদ্রি সাহেব তাহার কবিতাগুলো ছাপাইয়া দিবে। কিন্তু সে তাহা দিল না। পরে সেই কবিতার খাতাও আর খুঁজিয়া পাওয়া গেল না। পাগল হইয়া তাহার কবি বন্ধু মরিয়া গিয়াছিল।

কবিদা শোক সামলাইল, অনেক দিনের পুরাতন কবিতা। মানহীন মনে করিয়া সে নতুন করিয়া কবিতা লিখিয়া চলিল। কবিদার কোনদিন তাহার লেখা থামাইল না।

৩ কবিদার কাব্য বিড়ম্বনা

ইদানিং কবিদা সারাক্ষণই ছড়া কাটিতেছে। যদি বা ছড়া কাটা বন্ধ হইয়া যায় তখন সে সাধুভাষায় কথা বলিতেছে। মাছের বাজারে যাইয়া কবিদা মাছওয়ালাকে বলিয়া বসে, “ওহে মৎস্য বিক্রেতা, তোমার পসরা হইতে সর্বোৎকৃষ্ট ইলিসা মৎস্য আহরণ করিতে আসিয়াছি। অনুগ্রহ করিয়া আমার এই থলেতে উহা মাপিয়া দেও। ইহার বিনিময় ধার্য কত স্বর্ণমুদ্রা?”

কিন্তু তাহারা হইল সমাজের নিম্নশ্রেণীর মানুষ। স্কুল কলেজে কোন দিন যায় নাই। তাহারা কবিদাকে চিনিত এবং তাহাকে বলিত, “কী কতা কচ্ছো কবিদা। বুজদি পাত্তিছি না। ঠিক ওইরে কও।”

কবিদা তখন বলিয়া বসিত, “না, না, না। এ হেন ভাষ্য শুনিবার অপেক্ষা কৃষ্ণপ্রাপ্তি টের উত্তম। হে মানব, তোমার এ কী জীবন, সেথায় জ্ঞানের আলো এখনো প্রজ্জ্বলিত হই নাই? অজ্ঞতার অন্ধকার হইতে আপনাকে উন্মুক্ত হইবার নিমিত্ত তোমার চিত্তে কি বাসনা জন্মে না?”

মৎস্য বিক্রেতা উপায়ন্ত না পাইয়া আশে-পাশে আমরা থাকিলে আমাদের ডাক দিত। কখনো বা কবিদাকে খালি হাতে ফিরাইয়া দিত। তাহাতে কবিদা অধিকতর দুঃখিত হইয়া বাজার ছাড়াই ফিরিয়া আসিত। সবচেয়ে সমস্যা হইত যখন কবিদার বউ তাহাকে বাজারের লিস্ট ধরাইয়া দিত। তখন কবিদা বাজারের লিস্ট পড়িয়া, যাহা আনিতে হইবে তাহা সব ছন্দে ছন্দে মিলাইত। যদি লেখা থাকিত, পাঁচ কেজি চাল, সরিষার তেল এক লিটার, আখের গুড় আধা কেজি, গরম মসলা একশো গ্রাম, এক ডজন দেশি মুরগীর ডিম তাহা হইলে কবিদা ছড়া বানাইতো,

              "গিন্নি বলিছে আনিতে হইবে
                     পাঁচ কেজি আতপ চাল,
             তাহার সাথে আরো দিও
                     লাল লাল শুকনো ঝাল।
             এক লিটার তৈল দিও
                        ঘানি ভাঙা সরিষার,
             তাহার সহিত মেপে দিও
                       দেশী মুরগির বাহার।
             ডিম দিও, মসলা দিও
                         দিও আখের চিনি।
             সব কিছুর বিনিময়ে
                          কত নিবে শুনি?"

তখন দেখা যাইত বাজারের দুই চারটে আইটেম বেশি হইয়াছে বা কোনটা একেবারেই বাদ পড়িয়াছে। কবিদার বউ যদি তখন তাহাকে জিজ্ঞাসা করিত- যা আনতে বলেছি তাই আনো নাই কেন? তখন সে বলিত,

             "চালের সহিত ডাল মেলে,
                           চুনের সাথে নুন,
             কবিতা বড়ই মহৎ সৃষ্টি
                           হইও না আগুন।"

কবিদার শ্বশুর বড়লোক, তাই কবিদার অর্থের সংকট হইত না। কবিদার বউ তখন গোপীকে দিয়ে নিকটবর্তী দোকান হইতে বাকি সব আনাইতো। আবার যদি কাঁচা সব্জি কবিদা বেশি আনাইয়া ফেলিত তখন কবিদার বউ আশেপাশের প্রতিবেশীকে বিলাইয়া দিত। কখনো বা ভিক্ষুক পাইলে তাহাকে ধরাইয়া দিত। ভিক্ষুকেরাও আবার প্রতিদিন একবার কবিদার বাড়ি আসিয়া জিজ্ঞাসা করিত কিছু বাড়তি কিনিয়া ফেলিয়াছে কিনা কবিদা। তাহা হইলে সে অনুগ্রহ করিয়া সেগুলো গ্রহণ করিবে।

এই ভাবে তো বেশি দিন চলিতে পারে না। কিছু একটা করিবার দরকার। কাহার সহিত পরামর্শ করিতে হইবে কিছু ভাবিয়া না পাইয়া কবিদার স্ত্রী আমাকে ডাক পাড়িল। আমি ভাবীকে কহিলাম- “কবিদাকে কিছু বই প্রকাশ করিলে হয়তো তাহার এই কবিতার ভুত ঘাড় হইতে নামতে পারে।”

ভাবীও এই বিষয়ে সম্মত হইয়া মোংলার নিকটস্থ তিলোত্তমা প্রকাশনীতে আমাকে যাইতে বলিলেন। সব কিছু জোগাড়যন্ত্র হইল, বই প্রকাশ করা যে কত ঝামেলার তাহা বলিয়া বোঝানো যাইবে না। বইয়ের কভার ছবি করিতে হয়, আই এস বি এন করিতে হয়, কপিরাইট, প্রুভ চেক, কবিদার জীবনী ও ছবি, পুস্তক পরিচিতি সব কিছু করিয়া প্রকাশনী আমাদের হাতে তাহার বই তুলিয়া দিল।

হাতে বই পাইয়া কবিদা এত খুশি হইয়া ছিল যে, তাহার শালির সহিত বিবাহ দিবার কথা আমাকে বলিয়া ফেলিল। কিন্তু আমি কবিদাকে এখনো বলি নাই, সে যাহার কথা বলিতেছে, তাহার সহিত আমি লাইন মারিতেছি। কিন্তু তাহাতেও কবিদার কাব্য বিড়ম্বনা গেল না। পূর্বের মতই সে আচারণ করিতে লাগিল। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারী চলিয়া আসিল। মোংলাতে বইমেলা বসিল। অনেক কষ্ট করেও কবিদার বই সর্বসাকূল্যে বিশ/পঁচিশ পিসের বেশি বিক্রি করিতে পারিলাম না। কিন্তু কবিদা বলিল,

             "মূর্খের দল আছে যত এই মোংলায়
             না হইলে কি এমন কাব্য রহে অবহেলায়?
             মাইকেল কি আর হইয়া ছিল রাতারাতি কবি
             রবীন্দ্রনাথ নোবেল পাবে পেরেছিল কেউ ভাবি?"

আমরা কবিদাকে সান্ত্বনা দিলাম। তাহাকে উপদেশ দিবার ক্ষমতা আমাদের নাই, তাই এইসব বিষয়ে আমরা চিন্তাও করি নাই।

কিন্তু হঠাৎ একদিন শুনিনাম, কবিদা আগের মত হইয়া গিয়াছে। এখন আর সাধু ভাষায় কথা কহে না। কথায় কথায় ছড়া কাটে না। কিন্তু কবিদা কি কবিতা লেখে এখনো? কী জানি। আমি সেই দিন বিকালে কবিদার বাড়িতে গিয়াছিলাম কবিদার খোঁজ-খবর করিতে। ভাবী আমাকে আপ্যায়ন করিলে আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম,

– কবিদা কি সুস্থ আছে? শুনিয়াছি কবিদা আর ছড়া কাটে না?
– ঠিকই শুনেছ হেলাল ঠাকুরপো। তোমার কবিদা এখন ছড়া কাটে না। সাধু ভাষায় কথা বলে না।
– কিন্তু কেন? সে কি বোবা হয়ে গেল?
– আরে না, না। গত সপ্তাহে তোমার কবিদার পোষা ময়না পাখিটা মারা গেছে। ওটাকে তুমি ধরে দিয়েছিলে না তাকে আমাদের বিয়ের আগে। সেই শোকে কাঁদতে কাঁদতে কবিদা সব ভুলে গেছে।
– কিন্তু কবিদা কবিতা লেখা কি বন্ধ করে দিলো? কবিতা প্রকাশিত হোক বা না হোক, কেউ পড়ুক আর নাই পড়ুক, কবিতা লেখা বন্ধ করলে চলবে কেন? আমরা আর যাইহোক কবিদাকে নিয়ে গর্ব করি। কবিরা হল জাতির স্তম্ভ।
– না, কবিতা লেখা বন্ধ করে নাই। নতুন কবিতা লিখেছে, শুনবে নাকি?

আমি ভাবির মুখে কবিতা শুনিব বলিয়া আনন্দিত হইলাম। সে আবৃত্তি করিতে লাগিল-

             "এই পৃথিবীর কেহ নহে আপন, কেহ নহে পর।
             যাইবার সময় চলিয়া আসিলে, সকলেই হবে পর।"

ভাবী যে এত সুন্দর আবৃত্তি করিতে পারে তাহা পূর্বে জানিতাম না, তাহাকে আমি ভূয়সী প্রশংসা করিতে লাগিলাম। তখন গেট হইতে শুনিতে পাইলাম কবিদা গান গাইতে গাইতে ভিতরে ঢুকিতেছে-

-“আমার সোনার ময়না পাখী”


কথ্য সাধু ভাষায় লিখিত হয়েছে এই রম্যরচনা সমুহ, যেন পাঠকগণ মাঝে মাঝে সাধুর ভাষার রস উপভোগ করতে পারে।


লেখক পরিচিতি

যোষেফ হাজরা। কবি ও লেখক হিসেবে তিনি সব্যসাচী। কবিতা, ছোটগল্প, রম্যরচনা, সাইন্স ফিকশন, ভৌতিক, অ্যাডভেঞ্চার, থ্রিলার, প্রবন্ধ, ডকুমেন্টারি লেখনীতে তিনি সিদ্ধহস্ত। তাকে তারুণ্যের কবি বলা হয়। তবে তার কবিতায় ভাবুক বা দার্শনিক কবিতার ভাব বেশি লক্ষ্য করা যায়। বর্তমান নিবাস বঙ্গবন্ধুপাড়া, শেলাবুনিয়া, মোংলা, বাগেরহাট।

তিনি প্রথম যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “আমাদের ছোট নদী” কবিতা পড়ে তার সম্পর্কে জানেন তখন থেকেই তিনি অনুপ্রেরণা পান। এজন্য রবীন্দ্রনাথের মত চিত্রকলা, সংগীত, আবৃত্তি, অভিনয় ও পরবর্তীতে সেন্ট পলস স্কুলের লাইব্রেরি ও বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের অপার সুযোগে লেখালেখির হাতে খড়ি দেন। সকল শিল্প-সংস্কৃতি থেকে তিনি লেখালেখি করতে বেশি ভালবাসেন। কারণ তার মতে, মনের কথা সম্পূর্ণরূপে ব্যক্ত করে ভাষার জাদুকারিত্বে জ্ঞান ও দর্শনের যে সমন্বয় হয় সেই আত্মদর্শনে সম্পূর্ণ আত্মতৃপ্ত করতে সক্ষম। তিনি যদিও রবীন্দ্রনাথকে গুরুদেব মানেন তবুও নিজের ধাঁচে তিনি লেখেন। তিনি তার কাব্য ও রচনায় অন্যান্য ঢং রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করেন যাতে কেউ পড়ামাত্রই বুঝতে পারে এই লেখনী যেন তারই হাতের ছোঁয়া।