যোষেফ হাজরা – বাংলার লোকজ খেলা (প্রবন্ধ)

বাংলার লোকজ খেলা

– যোষেফ হাজরা

বাংলাদেশে বিভিন্ন অঞ্চল ভেদে বিভিন্ন ধরণের খেলার প্রচলন ছিল এক সময়ে। আমার ছোট বেলার সময়টা ছিল বিংশ শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক, ওই সময়ে টিভি থাকলেও বিকালে আমার খুব কমই দেখতাম। গ্রাম্য এলাকায় শুধু মাত্র শুক্রবার বিকালেই টিভিতে সকলে মিলে বাংলাদেশে পূর্ণ দীর্ঘ ছায়াছবি দেখা হত। ছায়াছবিতে কখনো কখনো নামাজের বিরতি সহ আধা ঘন্টার মত বিজ্ঞাপন বিরতি হত। মামার বাড়ি গেলে মামাতো ভাই-বোন, মামা-মামি ও অন্যদের সাথে টিভি দেখতাম। না চাইলেও বসে থাকতে হত কারণ সেই দিন কেউ খেলবে না। এছাড়া অন্য দিন গুলোতে সকল ছোট ছেলে-মেয়েরা কম বেশি খেলতে আসত। এদের মধ্য ঘরে কখনো দুইদলে ভাগ হয়ে খেলা হত, কখনোবা একজনকে চোর তৈরি করে খেলা হত। মাঠ ও লোক সংখ্যার উপরে নির্ধারণ করে খেলা নির্বাচন করা হত।

দল বা চোর নির্বাচন করার জন্য বিশেষ প্রক্রিয়া ছিল। চোর নির্বাচন করার সময় একজন আঙুল ফুটাত এবং যে কয়জন সদস্য খেলবে সেই কয়টা আঙুল সহ ফুটানো আঙুল সকলের সামনে বের করা হত। তারপর সকলে আঙুল ধরত, যে ফোটান আগুল ধরত সে চোর হত। তবে কখনো কখনো কানাকানি করে বন্ধুকে চোর হওয়া থেকে বাঁচানোর জন্য অন্য আরেক জনকে চোর করা হত। আবার ছেলেমেয়ে মধ্যে প্রভাবশালী কেউ ফুটানো আঙুল ধরে ফেলতে তার ভয়ে অন্য কাউকে চোর করা হত। যে চোর হত সে সকলে থেকে আলাদা তাই কেউ চোর হতে চাইত না। একটু বড় হলে তখন আমরা স্বেচ্ছায় চোর হতাম। তবে আঙুল ফোঁটান সকলে বিশ্বাস করত না এজন্য পাতা কাটতে হত। যে কয়জন সদস্য সেই কয়টা গাছের পাতা ছিঁড়ে একটা পাতা নিচের দিক থেকে ছিঁড়ে ফেলতে হত তারপর সব পাতা গুলো একসাথে করে ছেঁড়া পাতা ও অন্য পাতা নিচ থেকে ভাঁজ করে ধরতে হত যেন কেউ বুঝতে না পারে কোন পাতা ছেঁড়া। এরপর সকলে পাতা বাছাই করে ধরত, যে ছেঁড়া পাতা নিত সে চোর। এছাড়া হাতভেঙে চোর নির্বাচন করা হত। তিন জন করে একটি ছড়া কাটত,

​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​”শিল চাপা শিল চাপা,
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ জয়হোক বাংলাদেশ”

তখন তিনজনের ডান হাত এক জায়গায় করে ছড়া শেষ করে উঁচুতে নামিয়ে সবার সামনে একসাথে চিত বা ভুট করে দিতে হত। তিনজনের মধ্যে একজন ব্যতিক্রম হত, তখন তাকে বাদ দিয়ে অন্য সকলের এক এক করে বাদ দেবার পর শেষে যে বাদ পড়ত সে হল চোর। শেষে যখন দুইজন থাকত তখন অন্য আরেকজন তাদের হাত ভাঙাতে সাহায্য করত। আরেকটি হল ঘাস টেনে চোর নির্বাচন করা। এক হাতে মত একটা দড়ি বা ঘাস হাতের মধ্যে মুঠি করে রেখে সকলে একটু একটু করে টানত, টানতে টানতে যখন কেউ হাত থেকে ঘাস বের করে ফেলত, সে হল চোর।

দল নির্বাচন করার ক্ষেত্রে দুজন বড়কে দলনেতা করে, ছেলে-মেয়েদের উচ্চতা নির্বাচন করে জোড়ায় জোড়ায় একটু দুরে গিয়ে দুজনে দুটো ছদ্মনাম নিত। তারপর দলনেতারা পালা করে ছদ্মনাম পছন্দ করে, দল তৈরি করত।

ঝামুর ঝুমুর

এই খেলাতে একজন চোর থাকে। আর বাকি সকলে গোল গোল করে ঘর কেটে সেখানে অবস্থান করে। চোর বিভিন্ন গাছের পাতার নাম বললে বাকিরা ‘ঝামুর ঝুমুর অমুক পাতা’ বলে এক নিঃশ্বাসে সেই গাছের কাছে যায় আর পাতা ছিঁড়ে নিয়ে আসে। এক নিশ্বাসে গাছের কাছে যেতে যদি দম ফুরিয়ে যায় এবং চোর তাকে ছুঁয়ে দেয়, তবে সে এই খেলার চোর হয়ে যায়। এবং যে পাতা সে আনতে গিয়ে চোর হয়ে গিয়েছে তাকে সেই পাতা আলাদা করে সংগ্রহ করতে হয়। আর যদি পূর্বে কোন পাতা সংগ্রহ করা থাকে তবে সেগুলো তার হয়ে যায়, আলাদা করে সংগ্রহ করার দরকার পড়ে না। এরকম করে সাত ধরনের পাতা সংগ্রহ করে আনতে হয়। শেষে সব পাতাগুলো একটা বড় পাতাতে ভরে গোল ঘরের ভিতরে লুকিয়ে রাখতে হয়। ঘর গুলো যে গোল হবে এমন কোন কথা নেই, চারকোনাও হতে পারে। এছাড়া কেউ চাইলে গাছ বা গাছের গুড়িকেও ঘর হিসেবে গণ্য করতে পারে। যে ঘর তারা বেছে নিবে ওই ঘরেই সব পাতাগুলো একসাথে পুটলি করে লুকিয়ে রাখতে হবে। সকলে এমন ভাবে লুকিয়ে রাখত যাতে চোর বুঝতে না পারে। এরপর চোর এসে সাতবার হাত বা কাঠি দিয়ে খোঁচা দিয়ে খুঁজে বের করতে হবে, না পারলে তার পিছে দেওয়া হবে সাত কিল। খুঁজে বের করতে পারলে চোর ঐ ঘরের মালিকে সাত কিল দিবে এবং পরের খেলার চোর হবে।

তবে এখানে কাঠি দিয়ে খোঁজার সময় যদি কেউ ভুল বশত একটা দাগও দিয়ে থাকে তবে সেটা একটা খোঁচা দেওয়া হয়েছে বলে ধরা হবে। আর ঘরের বাছাই করার জন্য সকলে একটু কঠিন জায়গা বেছে নিত, যাতে পাতা লুকাতে সহজ হয়।

দাস কোস

এটা খেলা হত স্কুলের বেঞ্চে ঢিফিনে বা স্কুল শুরুর আগে। শুধু এটার জন্য বিশেষ করে চোর নির্বাচন করা হত। এখানে পাঁচটি সংখ্যার নাম হল দাস, কোস, সিঙ্গা, বুলবুলি, মিদ্দান। খেলোয়াড়রা সকলে এই পাঁচটি শব্দ বলে শূন্য থেকে পাঁচটি আঙুল বেঞ্চের উপর ফেলত এবং প্রত্যকে পাঁচটি সংখ্যা নিজের জন্য বাছাই করে আঙুলগুলো ক্রমিক নম্বর দাস, কোস বলে গুনত। শেষে যে দাস কোস সংখ্যাটি থাকত, সেই সংখ্যা ব্যবহারকারী বাদ দিয়ে শেষে একজন রাখত যে হত চোর।

চোর বেঞ্চের উপরে হাতের তালু টনটন করে রাখত আর অন্যরা সিরিয়াল হিসেবে এক এক করে এসে হাতের তালুতে চড় দিত। অন্য খেলোয়াড়রা তাদের হাত দুইপাশের বেঞ্চে উপর করে রাখত এবং চোখের চোখ ফাঁকি দিয়ে চোরের হাতে বাম বা ডান হাত দিয়ে চড় মারত। চড় মারার সময় চোর হাত উঠিয়ে ফেললে যে চড় মারছে সে নতুন চোর হত। কখনো কখনো দুই হাত দিয়ে চোরকে চড় মারা হত, তখন যদি দুই হাতের মাঝ থেকে হাত বের করে চোর নিজের হাতে চুমু খেত তবে সে চোর হত।

খেলার সময় হাত টনটন করে না রেখে চোর যদি হাত নরম করে রাখত তবে উপর থেকে নরম হাতে ঘুসি মারা হত। বেঞ্চের উপরে হাড়ের উপর ঘুসি খেলে অনেক ব্যথা লাগলে কিন্তু কারো হাড় ভাঙার কথা আমি কখনো শুনি নাই, এছাড়া একটানা বেশি সময় চড় খেলে হাত লাল হয়ে যেত।

কলম খেলা

এই খেলাও স্কুলের বেঞ্চের উপর খেলা হত। যারা যারা খেলতে চায় সকলে তার কলম বেঞ্চের উপর রাখত। তারপর নিজের কলম দিয়ে অন্যের কলমে টোকা দিয়ে অন্যের কলম নিচে ফেলতে হত। এমন ভাবে খেলতে হত যাতে নিজের কলম না ফেলে অন্যদের কলম নিচে ফেলানো যায়। এক্ষেত্রে অনেকে ভারি কলম ব্যবহার করত কারণ ভারি কলমের উপর হালকা কলম টোকা খেলে সেটা ভারি কলমে বেশি সরাতে পারত না। যার কলম শেষে পর্যন্ত মাটিতে পড়ত না সে হত জয়ী।

উঠ বস

এই খেলা একজন চোর থাকত। সে নির্ধারণ করে দিত ‘উঠ’ না ‘বস’। উঠ মানে দাঁড়িয়ে থাকলে চোর অন্য সদস্যকে ছুঁয়ে দিলে সে চোর আর ‘বস’ মানে অন্য সদস্য বসে থাকলে তখন চোর ছুঁয়ে দিলে সে চোর। এই খেলা ছোট জায়গাতে খেলা হত, যেমন ঘরের উঠান।

কুমির কুমির

এখানে তিন চারটা ঘর করে চোরের মাঝে রাখা হত। নিয়ম হল এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যেতে হবে দৌড়ে বা হেঁটে। এক ঘর থেকে আরেক জায়গা যাবার সময় চোর ছুঁয়ে দিলে নতুন চোর আসত। খেলা খুব সাধারণ হলেও মজা বিষয় ছিল চোরকে অপমান করা। ঘরে পরিবর্তন করে অন্য সদস্যরা লাফালাফি ও হাস্যকর শব্দ ব্যবহার করত।

লুকোচুরি

লুকোচুরি বিশেষ করে রাতে খেলতে মজা ছিল, কিন্তু আমরা ছোট থাকার জন্য দিনেই খেলতাম। এখানে একজন চোর এক থেকে ষাট পর্যন্ত গুনত বাকিরা লুকাত, গোনা শেষ হলে চোর সকলকে খুঁজে খুঁজে বের করে একটিপ দুইটিপ দিত। প্রথম যে একটিপ পেত পরের বার সে চোর হত। কিন্তু চোরের চোখ ফাঁকি দিয়ে যদি কেউ তার শরীর ছুঁয়ে দিত তবে সে পুনরায় চোর হয়ে যেত।

ছোঁয়া-ছুয়ি

এখানে একজন চোর বাকিদের দৌড়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে নতুন চোর তৈরি করে, চোর হয়ে অপমান হওয়া থেকে নিজেকে বাঁচাত। আর অন্যরা দৌড়ে পালাত।

বরফ পানি

এখানেও একজন চোর অন্যদের ছোঁয়ার জন্য দৌড়াত, তবে একজনকে তিনবার ছুঁতে হত। প্রথমবার ছোঁয়ার পর সদস্যরা বরফ হয়ে যেত অর্থ্যাৎ যেখানে তাকে ছোঁয়া হয়েছে সেখানে সে দাঁড়িয়ে থাকবে যতক্ষণ না পর্যন্ত অন্য সদস্যরা তার শরীর ছুঁয়ে তাকে পানি করে বা আবার দৌড়ে পালানোর সুযোগ না দেয়। এভাবে একজনকে তিনবার ছুঁয়ে দিলে সে নতুন চোর হত আর যদি সকলেই বরফ হয়ে যেত তবে প্রথম যাকে ছোঁয়া হয়েছে সে চোর হত। তবে এভাবে চোর হতে আমি কখনো দেখি নাই। এই খেলা যেকোন উন্মুক্ত জায়গাতেই খেলা যেত।

এল এম ডি লন্ডন

এই খেলাটা একটা ছড়া কাটতে হত। একজন দাঁড়িয়ে ছড়াটি দ্রুত আবৃত্তি করত, আর অন্যরা পিছন থেকে এগোত। ছড়া শেষ করে চোর পিছনে ঘুরে তাকাত যদি তখন কাউকে এগোতে দেখে ফেলতো তবে সে চোর হত, এগোতে হতে ঠিক তখন যখন চোর ছড়া কাটবে। এরপর আস্তে আস্তে সকলে চোরে কাছে চলে এলে। একজন জোরে চোরকে পিছে চড় দিয়ে নিদিষ্ট দাগের কাছে দৌড দিত, তখন চোর তাদের পিছনে দৌডে ছুঁয়ে দিতে পারলে সে পরের খেলার চোর নির্ধারিত হত। খেলার ছড়াটি এমন, ‘এল এম ডি লন্ডন, ঘড়ি বাজে ঢং’। খেলার জন্য সাধারনত লম্বা রাস্তা ব্যবহার করা হত।

বউচুরি বা জুতো চুরি বা মাংশ চুরি

এই খেলাতে দুটো দল তৈরি করে খেলা হত। দুইপাশের দুটো লম্বা জায়গা দুই দল দাঁড়ত। একদল থাকত ঘরে আরেক দল বাইরে। বাইরের দলের কাছে জুতা, বউ থাকত অর্থ্যাৎ ঘরের দলের একজন খেলোয়াড়, মাংস অর্থ্যাৎ একটা মাটির দলা বা আধলা ইট থাকত। একটু বড় উঠানে এটা খেলা যেত বা মাঠেও খেলা যেত। দুই দলের দাগের দূরত্ব বিশ থেকে ত্রিশ হাতের মত। খেলা শুরু হলে ঘরের দলে থেকে এক একজন কিতকিত বলতে বলতে আসত বা চু বলে এক নিশ্বাসে দৌড়ে আসত। কখনো কখনো ছড়া কাটা হত যেমন-

​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ “আমি যাব আকাশে, জল খাব গেলাসে
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ জলের কী বেদনা, খুকুমনি কেঁদো না”,
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ “আমি আদারে, বাঘ মারব বাদারে
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ বাঘের তেলে পিদ্দুম জ্বলে”।

ছড়া কেটে মাংস বা জুতা বা বউ চুরি করা হত। দম থাকা অবস্থায় যখন কেউ বিপরীত দলের কারো শশীর ছুঁয়ে দিত তখন সে দল থেকে বাদ যেত। দম চলে গেলে বিপরীত দলের খেলোয়াড় সকলে দৌড়ে তাকে ছুঁয়ে দিয়ে দল থেকে তাকে বাদ দেবার চেষ্টা করত। এভাবে ঘরের দল বাইরের দলকে ভয় দেখিয়ে জুতা, বউ বা মাংস চুরি করত। জুতার ক্ষেত্রে লাইন দিয়ে বাইরের দলের কাছে সব জুতা রাখা থাকত, একসাথে দুটো জুতাও চুরি করাও যেত। বউ ও মাংস রাখার ক্ষেত্রে বাইরের দলের দাগের মাঝে গোল করে একটা জায়গা নির্দারিত করা হত। এভাবেই খেলা চলত। টস করে ঘরের দল ও বাইরের দল নির্ধারিত করা হত। যে দল সব জুতা চুরি করত সে জিতে যেত। জুতা বা বউ চুরি করার সময় ছুঁয়ে দিয়ে সকল খেলোয়াড়কে দল থেকে বাইরে বের করে দিলে বাইরের দল ঘরে যেত।

গল্লাছুট

এখানে দুটো দল ভাগ করার পর। প্রতি দলে ৪ থেকে ৭ জন মিলে খেলা হত। ঘরে ও বাইরের দল নির্ণয় করার জন্য আমরা পাতা উড়িয়ে ঠিক করতাম। ছোট পাতা গোল করে ছিঁড়ে উপর না নিচ এভাবে ঠিক করতাম কে ঘরে আর কে বাইরে যাবে।

যে দল ঘরে যেত তারা পায়ের গোঁড়ালি দিয়ে গুতিয়ে গুতিয়ে একটা গর্ত করত। গর্ত করার পর ঘরের দল গর্তে গোঁড়ালি দিয়ে সকলে হাত ধরে চরকির মত ঘুরে ঘুরে বাইরের দলকে ছুঁয়ে দিত। বাইরের দল ঘরের দলের শেষ মাথার খেলোয়াড়ের পিছনে পিছনে দৌড়াত, সুযোগ পেলে ঘরের দলের খেলোয়ার হাত ছুঁটে অনেক দুরে গিয়ে বসে পড়ত এবং এতদূরে যেত যাতে বাইরের দল তিন লাফে গর্তের কাছে না আসতে পারত। গর্তকে বলা হত ‘গদ’। চরকির মত ঘোরার সময় বাইরের দলের কাউকে ছুঁয়ে দিলে সে উক্ত রাউন্ডের সময় খেলা থেকে বাদ পড়ত। আর ঘরের দল পালানোর সময় বাইরের দল ছুঁয়ে দিলে বাইরের দল গদে যেত। এভাবে গদের সকল খেলোয়াড় এক এক করে বাইরে যেতে পারলেই গদের দল জিতে যেত।

কিতকিত

এক হাত চাওড়া তিনহাত লম্বা দুটো ঘর পাশাপাশি। প্রথম ঘরের নাম এক্কা, পরের ঘরের নাম দোক্কা। দোক্কার পরের তিন হাত লম্বা তিনহাত চওড়া একটা ঘর কোনা কুনি ভাবে আঁকা চারটা ঘর। সবগুলো ঘর ধারাবাহিক ভাবে একটার সাথে একটা লাগান। দোক্কার পাশে প্রথম কোনাকুনি ঘরগুলোর মাঝের ঘরটি নাম হল মক্কা। তার ডান পাশ থেকে ঘুরে ঘরগুলোর ধারাবাহিক নাম তেক্কা, চৌকা ও পাঞ্জা।

খেলা শুরুর প্রথমে খেলোয়ার একটি মাটির চাড়া এক্কাতে ফেলে। তারপর এক পা দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে এক্কা থেকে চাড়া মক্কাতে লাথি দিয়ে পাঠাতে হয়। যদি চাড়া মক্কা পাঠাতে গিয়ে অন্য কোটে চলে যায় তাহলে সেই কোট থেকে আবার মক্কাতে পাঠাতে হয়। দম এই খেলা শুরু করতে হয়, ‘কিতকিত’ বলে এক পা দিয়ে চাড়া মক্কাতে রেখে ‘থা’ বলে শেষ করতে হয়। আমার মক্কা থেকে তেক্কা, চৌকা, পাঞ্জাতে ‘কিতকিত থা’ দম নিয়ে ঘুরে আসতে হয়। তারপর মক্কা থেকে চাড়া লাথি দিয়ে এক্কা বরাবর কোটের বাইরে বের করে দিতে হয়।তারপর “কিতিকিত থা’ বলে লাফিয়ে কোট থেকে বের হতে হয়। চাড়া ধারাবাহিক ভাবে এক্কা, দোক্কা, তেক্কা, চৌকা, পাঞ্জা ও মক্কাতে তো ফেলে ফেলে দম দিয়ে খেলতে হয়। চাড়া ফেলার সময় বা পা দিয়ে মক্কাতে সরানোর সময় যদি দাগে পড়ে যায় বা এক কোট থেকে আরেক কোটে যাবার সময় যদি দাগে পা পড়ে যায় তখন নতুন খেলোয়াড় আসে। সর্বশেষ মক্কাতে যখন চাড়া ফেলা হয় তখন পুরো প্রক্রিয়াটি দম ধরে খেলতে হয়, আগের মত মক্কাতে এসে দম নেওয়া যায় না।

এভাবে ছয় কোট জেতার পর, অন্য খেলোয়াড় বলে দেয় কয় ‘চু’ দিতে হবে। যে কয় ‘চু’ দিতে হবে সেই কয়বার খেলোয়াড় চাড়া ছাড়া দাগে পা না দিয়ে ‘চু’ বলে দম নিয়ে পুরো কোট ঘুরে আসতে হবে। তারপর আকাশে দিকে তাকিয়ে কপালে চাড়া রেখে এক্কা, দোক্কা, তেক্কা, সকল কোট না দেখে ঘুরে আসতে হবে, কোটে পা দেওয়া যাবে না। তারপর দম ছাড়া এক্কাতে লাফ দিয়ে দুই পা একসাথে থাকতে হবে, তারপর দোক্কাতে তারপর দুই বা ফাঁক করে ডান পা তেক্কাতে আর বাম পা পাঞ্জাতে দিতে হবে, তারপর চৌকাতে দুই পা একসাথে লাফ দিয়ে রেখে পরের ধাপে চৌকার সামানে কোটের বাইরে বের হতে হবে। এরপর হল কোট কেনার পালা।অন্য খেলোয়াড়রা ঠিক করে দিবে ‘দাড়িয়ে’ না ‘বসে’, ‘ঘুরে’ না ‘ফিলে’। ‘দাড়িয়ে’ আর ‘ঘুরে’ ঠিক করে দিলে চৌকার সামনে দাড়িয়ে কোটের দিকে মুখ করে চাড়া যে কোটে ফেলা হবে সেই কোট ওই খেলোয়াড়রের নিজের কোট। কেনা কোটে কেউ পা দিয়ে খেলবে না, যদিনা কোটের মালিক অনুমতি দেয় বা কোটের কোন একটা অংশ দাগ দিয়ে কেটে অন্য খেলোয়াড়ের খেলার জন্য ছেড়ে দেয়। এই সব প্রক্রিয়ার কোন অংশে দাগে পা দিলে বা চাড়া দাগের মাঝে পড়লে নতুন খেলোয়াড়রা ঘুরে ঘুরে আসে। খেলা শেষে যে সবাবেশি কোট কেনে সে জয়ী হয়।

কড়িখেলা

আরেকটা খেলা যেটা মনে হয় শুধু দখিনাঞ্চলের ছেলে মেয়েরা খেলত, সেটা হল কড়ি খেলা। চারটা নোনা জলের মরা একই আকারের কড়ি ফেলতে হত তারপর একটার সাথে আরেকটা টোক্কা দিয়ে লাগাতে হত আর নম্বর যোগ করে বাড়ানো হত, এভাবে চলতে থাকত যতক্ষণ একজন ভুল না করে। ভুল করলে আরেক জন কড়ি খেলত, যদি কড়ি সব ভুট হয়ে যেত তাহলে চার নম্বর আর চিত হলে বারো নম্বর বাড়তো কিন্তু সব গুলো চিত বা ভুট হয়ে পড়লে অন্য খেলোয়াড়রা কড়ি কেড়ে নিতে পারত। যে বেশি কুড়াত তার তেমন নম্বর যোগ হত। গ্রামের মেয়েরা অনেক কড়ি খেলত। কড়ি খেলতে গেলে অভিভাবকেরা বলত এতে হাতের লেখা খারাপ হয়ে যায়। আমার মা তিনিও প্রচুর কড়ি খেলতেন আর তার বড়বোন ছিল ইস্কুলের শিক্ষিকা। তিনি বলতেন কড়ি খেললে হাতের লেখা খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু আমার মায়ের হাতের লেখা অনেক সুন্দর।

তিন গুটি

এই খেলাতে আয়তার ঘরকে পিজ্জার মত আট খন্ডে মাঝ বরাবর ভাগ করা হত। তারপর দুইজন খেলোয়াড় ভিন্ন রঙের জন প্রতি তিনটা গুটি ব্যবহার করত। গ্রামের ছেলেমেয়েরা উঠানেও দাগ কেটে খেলত বা বর্ষার দিনে ঘরে বসে খেলত, আবার রাতে খেলার জন্য পিড়ার উপরে এই কোট কাটা থাকত। খেলার নিয়ম হল, গুটিগুলো একটা কোনা থেকে আরেক কোনা বা দুই তিনটি রেখার মিলন স্থলে রেখে কোনাকুনি বা লম্বা লম্বি সরল রেখা বরারবর তাকে মিল করতে হবে। যে আগে করবে সে জয়ী। প্রথমে নিজের পাশে খেলোয়ার দাবার মত তিনটা গুটি পাশাপাশি সাজিয়ে রাখত, তারপর খেলা শুরু হত। দুই এক মিনিটের মধ্যে এই বুদ্ধির খেলা শেষ হয়ে যেত।

ষোল গুটি

ষোল গুটি-র কোট – ১

এই কোট বর্ণনা করা জটিল, এবং এখানে দুই ধরনের কোট ব্যবহার করা হত। পিঁড়িতেও এর কোট গ্রামে আঁকা থাকত। কোটের দুই ধরণের ছবি সকলের জন্য পেশ করা হল।

ষোল গুটি-র কোট – ২

দুইজন খেলোয়াড় প্রতিজনে আলাদের রঙের ষোলটি গুটি ব্যবহার করত। একগুটি যেকোন ফাঁকা এক স্থানে রাখার পর অন্য খেলোয়াড় তার গুটি চালত। এভাবে বিপক্ষ দলের গুটি যদি সামনে পড়ে এবং তার ঠিক উল্টো দিকে ফাঁকা জায়গা থাকে তখন ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে একের অধিক গুটি খাওয়া যেত। যে আগে প্রতিপক্ষের সব গুটি খেয়ে শেষ করে ফেলত সে জয়ী হত।

চোর পুলিশ

এই খেলাতে চারটা মেচের বা সিগারেট বা খাতার কাগজ একই রকম ভাবে কেটে রাখতে হবে। যাতে উল্টো পিঠ একই রকম হয়। এরপর কাগজের ভিতরের পিঠে চারটাতে চার রকম শব্দ লিখতে হবে, সেগুলো হল চোর ৪০০, ডাকাত ৬০০, পুলিশ ৯০০, দারোগা ১২০০। লেখার পার চারজন চারটা কাগজ নিবে। তারপর যে দারোগা কাগজ পাবে সে পুলিশ কাগজ যে পাবে তাকে বলবে চোর বা ডাকাত যে কোন একজনের আন্দাজ করে বের করতে। যদি পুলিশ বের করতে পার তবে সে নয়শো নম্বর পাবে, চোর বা ডাকাত যাকে ধরে ফেলবে সে শূন্য পাবে আর দারোগা সব সর্বদা বারশো নম্বর পাবে। তারপর খাতাতে চারজন খেলোয়াড়ের নাম লিখে দাগ টেনে নিচে নিচে প্রত্যেক খেলোয়াড়রের নাম্বার যোগ করতে হবে। যে কয়েকবার খেলা হবে সেটা আগে ঠিক করা থাকবে। খেলা শেষে যে বেশি নম্বর পাবে সে জয়ী হবে। সকলেই এখানে চাইত দারোগার কাগজটি পেতে। এই খেলা বর্ষার দিনে খাটে বসেই বেশি খেলা হত।

শূন্য কাটাকাটি

এই খেলা ক্লাসরুমে খেলা হত। এখানে অনিদিষ্ট কয়েকটি সারি ছোট ছোট শুন্য আঁকা হত। ধরি পাঁচ সারি লম্বা ও পাঁচ সারি চাওড়া দিলে বাংলা লাইন টানা খাতার দুরত্বের ছোট ছোট গোল আঁকা হল। এরপর দুই বা তিনজন পালা করে দুটি শুন্য লাইন টেনে যোগ করে দিবে উপরে বা নিচে। এরকম করতে করতে যদি কেউ একটা চারকোনা ঘর পেয়ে যায় তবে সে চারকোনা ঘরে নিজের নামের একটা অক্ষর বা ক্রস/টিক চিহ্ন একে দিত। এখানে একটা চারকোনা ঘর তৈরি হলে যদি আরেকটা চারকোনা ঘর এক দাগ দিয়ে মিলানো যেত তবে সে একাধিক ঘর নিজের নামের চিহ্ন দিত। ঘর লাভ করার পরে সে আরেকটা সুযোগ পেত ফাঁকা আরেক জায়গাতে দুটো শুন্য মিলানোর তার ফলে প্রতিযোগির জন্য আরেকটা চার কোনা ঘর তৈরির সুযোগ হয়ে গেলে, প্রতিবন্ধী যতগুলো পারে যতগুলো ঘর দখল করে নিত। এজন্য প্রতিদন্দী যাতে কোন ঘর নিতে না পারে, বা নিলেও যাতে কম সংখ্যক ঘর নিতে পারে সেজন্য খেলোয়াড়রা সতর্ক থাকত এবং গুনে দেখত কোন শূন্য দুটি মিলানে প্রতিদন্দী কম ঘর পাবে। যে সবচেয়ে বেশি ঘর দখল করত, সে খেলাতে জিতে যেত।

শলার কাটির খেলা

এখানে পনের থেকে বিশটা দুই ইঞ্চি নারকেল শলার কাটি ও একটি চার পাঁচ ইঞ্চি শলার কাটি ব্যবহার করা হত। একজন খেলোয়াড় সব কাটিগুলো মাটিতে বা টেবিলে ফেলত, ফেলার পর এক একটি কাটি অন্য কাটিকে না নড়িয়ে সরাতে হত ও নিজের কাছে রাখতে হত। এক একটা কাঠি দশ নম্বর, বড় কাঠির নাম রাজা কাটি এর নাম্বার পঞ্চাশ থেকে একশো, যা খেলার আগে ঠিক করা হত। কাঠি সারানোর জন্য হাত বা অন্য আরেকটা কাঠি ব্যবহার করা হত। যে কাঠি সহজে পাওয়া যেত তার জন্য হাত ব্যবহার করা হত, আর যে কাঠি কঠিন জায়গায়তে পড়ছে সেটার জন্য অন্য কাঠি ব্যবহার করা হত, যদি কোন একটা কাটি অন্য কাঠির উপরে পড়ত তখন অন্য যেকোন কাঠি দিয়ে খুব কায়দা করে প্রায় ভাসমান কাঠির নিচ দিয়ে একটা কাঠি ঢুকিয়ে দিয়ে দ্রুত কাঠিটাকে উপরের দিকে ছুঁড়ে ফেলা হত। তারপর সরানো হয়ে গেলে কাঠির নম্বর যোগ করে যে বেশি নম্বর পেত সে জয়ী হত।

ডুগ ডুগ

এই ছেলা পুকুরে বা নদিতে খেলা হত। একজন চোর অন্যদের সাতার কেটে কেটে বা ডুব দিয়ে দিয়ে ধরত। তারপর প্রথম একজনকে ধরতে পারলে, তারা দুইজন অন্যদের ধরত, এভাবে সকলকে ধরার পর শেষে যে ধরা পড়ত সে চোর হত। চোর হবার পরে সে আবার এক এক জন করে চোরের খেলোয়ার বাড়ালে, যে কয়জন চোর তারা অন্যদের ধরত। এই খেলাতে জেতার উপায় ছিল চোর প্রথম একজনকে টার্গেট করে তাকে ছুঁবে কারন সকলকে বিচ্ছিন ভাবে ধরা কঠিন। টার্গেট করলে সেই খেলোয়াড় ডুব দিয়ে পালালেও পরে দম ফুরিয়ে যেত তখন সাঁতার কাটতে কষ্ট হত। চোর তখন একটানা তাড়া করে তাকে ধরে ফেলত।

গাদন

গাদন খেলাতে একজন চোর থাকত। দুইপাশে আনুমানিক চার হাত বাই পাঁচ হাত দুটো কোট থাকত। চোর মাঝের দাগে দাড়াত আর বাকি খেলোয়াররা এক কোসে থাকত। চোর দাগ বরাবর হেটে বা দৌড়ে অন্যদের ছুঁয়ে দেবার চেষ্টা করত। অন্যরা এক কোট থেকে আরেক কোট যেত আবার ফিরে আসত। তিন থেকে পাঁচ জন খেলোয়ার নিয়ে এই খেলা খেলা হত। শীতে কালে মাঠে ধান কাটা হয়ে গেলে বা ঘেরের পানি শিতে শুকিয়ে গেলে এটা খেলা হত। মাঠেও খেলা যেত।

নুনগাদন

নুনগাদনে কোট শীতকালে ধান কাটার পর আঁকা হত। চার হাত বাই চারহাত ছয়টা কোট আকা থাকত। দুইটা দুইটা কোট জোড়া করে। দল বেঁধে এই খেলা খেলা হত। ছয়জন বা আট জন মিলে খেলত। প্রয়োজনে কোট বাড়াত ও কমাত। খেলার শুরুর যে কোট থেকে হতো তার নাম ‘ঘর’, আর পাশের কোটের নাম ‘নুনের কোট’। দুটো দল থাকত, পাতা ছিঁড়ে টস করা হত। বাইরে দলে তিন বা চারজন খেলোয়াড় ছয় বা আট কোটের লম্বা দাগে একজন দাঁড়াত, যে ভাল দৌঁড়াতে সে দাঁড়াত বা সে (হাসপিয়ে) হাঁপিয়ে গেলে অন্য কেউ দাঁড়াত। অন্যদাগে আঁড়া আঁড়ি বাকি বাইরের খেলোয়াড় দাঁড়াত।

এরপর খেলা শুরু হলে, ঘরের দল বাইরের দলের ছোঁয়া খাবার হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে সব কোট ঘুরে আসত, যদি এক কোট থেকে অন্য কোট যেতে বাইরের দলের ছুঁয়ে দিত তাহলে, বাইরের দল ঘরে যেত। সব কোটে ঘুরে প্রত্যেক ঘরের দলের খেলোয়াড় পুনরায় ঘরের দলে ফিরতে পারলেই তারা জয়ী হত, তবে নুনের কোটে না গিয়ে যদি ঘরে কোটে যায় তবে খেলা পচে যায়, বাইরের দল তখন ঘরে চলে আসে। ঘরের দলের যেকোন একজন খেলোয়াড় সব কোট ঘুরে ঘরে আসতে পারলেই ঘরের দল জয়ী হয়।

পাঁচ গুটি খেলা

প্রথম দুটো মারবেলের সমান পাথর বা ইটের টুকরা ঘসে অসমান করে তৈরি করা হয়, যেন মারবেলের মত আবার গড়িয়ে চলে না যায়। খেলাটি বসে খেলতে হয়।

তারপর পাঁচ গুটি মাটিতে রেখে একটি পাথর ডান হাত দিয়ে উপরে মেরে বাম হাত দিয়ে ধরতে হয়, এই উপরে ছোঁড়ার ভিতরে নিচের থেকে একটি পাথর বা গুটি তুলে নিতে হবে। এভাবে চারটি গুটি এক এক করে তুলে নিতে হবে। তারপর একই ভাবে পাথর উপরে ছুঁড়ে দুটি গুটি একসাথে তুলে নিতে হবে, দুইবার করে চারটি গুটি তোলা হলে পরে আবার পাথর উপরে ছুঁড়ে তিনটি গুটি একসাথে একবার তুলতে হবে। এটা প্রথম রাউন্ড।

দ্বিতীয় রাউন্ডে পাঁচটা পাথর হাতের তালুর উপরে রেখে একসাথে ছুঁড়ে দুটো হাত উল্টো করে তাদের আবার ধরতে হবে। যদি কোন পাথর পড়ে যায় তবে হাতের তালুর উপরে অন্য পাথর রাখা অবস্থায় মাটি থেকে যে কয়টা পাথর পড়ে গেছে সেগুলো তুলে নিতে হবে এবং আবার হাতের তালুর উপরে রাখা পাথরগুলো উপরে তুলে তালুর ভিতরে সব গুলো একসাথে ধরতে হবে, তখন যদি না পারা যায় তবে খেলা পচে যাবে। এরকম করে দুইতিন বার করে দিতে হবে সেটা অন্য খেলোয়াড়রা ঠিক করে দিবে।

এরপর একটি দাগ কাঁটতে হবে। তারপর বাম হাত দিয়ে অর্ধ চাঁদের মত দাগটিতে বৃদ্ধা ও তর্জনী আঙুল দিয়ে চেপে ধরতে হবে। এরপর সব পাথর ওই দাগের সামনে ফেলতে হবে। অন্য খেলোয়াড়রা তখন একটি গুটি বাদ দিয়ে দিবে। সেই একটি গুটি বাদ দিয়ে অন্য চারটি পাথর থেকে একটা পাথর তুলে নিয়ে উপরে ছুঁড়তে হবে, উপরের ছোঁড়ার যতটুকু সময় হবে ততটুকু সময়ের মধ্যে বাদ দেওয়া গুটি না সরিয়ে অন্য গুটি দাগ দেওয়া হাতের ফাঁক দিয়ে অন্য দিকে পাঠাতে হবে। এভাবে তিনটা গুটি পাঠানো হলে। এই পর্যায়ে শেষে শেষ।

এরপর প্রথম পর্যায়ে খেলার মত একটি গুটি উপরে ছুঁড়ে বাকি চারটা গুটি একসাথে হাতে উপরে নিতে হবে। তাহলে একটা ‘খোল’ হবে বা এক পয়েন্ট যোগ হবে।

লাটিম

দোকান থেকে লাটিম আর লাটিমের দড়ি কিনে এনে লাটিমের উপরের গোল উচু অংশে দড়ির গিঁটের একমাথা বসিয়ে দড়ি গোল করে গিঁটের উপরে টাইট করে বসিয়ে সোজা টেনে লাটিমের লোহার সাথে ঘুরে ঘুরে পাচিয়ে বেলন আকৃতির লাটিমের পাশের থেকে পেঁচ উঠে যেত। লাটিমের দড়ির আরেক মাথা আঙ্গুলে পেঁচিয়ে বা আরেক মাথাতে বোতলের ছিপির মুখে আটকিয়ে চার আঙ্গুলের মাঝে লাটিম খাটিয়ে বুড়ো আঙুল দিয়ে চেপে ধরতে হত। তারপর কায়দা করে ঘুরিয়ে লাটিম মারতে হত এবং লাটিম বন বন করে ঘুরত। তখন অন্য খেলোয়াড়রা পাশ থেকে তাদের লাটিম ওই লাটিমের উপরে মারত যাতে লাটিমের লোহার কোপ খেয়ে বা তার লাটিম ঘুরতে ঘুরতে এসে যেন অন্যর লাটিম ঘোরা বন্ধ করে দেয়।

সর্বোপরি ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা করে নিজেদের আনন্দ দেবার জন্য ঐতিহ্যবাহী খেলার চর্চা করত। এছাড়াও আমরা দল বেঁধে পাখি শিকার করতাম গুলতি দিয়ে। আমাদের কারো হাতের লক্ষ্য আমরা বলতাম ‘নিরিখ’ ভাল ছিল না তাই চারপাঁচ জন মিলে একটা পাখি নিরিখ করতাম এবং যেকোন একজনেরটা লেগে গেলই পাখিটা মরত। এই বুদ্ধিটা অবশ্য আমি বের করেছিলাম। পাখির মধ্যে ছিল টুনটুনি, বউটুনি, গুদ রাঙা বুলবুলি, চড়াই। পাখি মারার পরে আমরা ঘর থেকে লবন হলুদ নিয়ে পাখি পুড়িয়ে খেতাম।

এছাড়াও কিন্তু খেলা ছিল যেগুলো একা একা খেলা হত। যেমন- ফড়িং ধরা, কচুরি পাতার নৌকা, চরকা ঘোরানো, রিং চালান, টায়ার চালানো।

ফড়িং ধরা

ফড়িং হাত দিয়েও ধরা যেত আবার নারকেল পাতার শলা বের করে মাথার চিকন অংশে চুড়ির মত বড় গোল করে তাতে মাকড়সার জাল পেঁচিয়ে ফড়িং ধরা হত।

কচুরিপাতার নৌকা

চারটা কচুরির পাতার ডগা তিনকোন করে তৈরি করে মাঝখানে রাবার সেট করে একটা আইস ক্রিমের কাঁঠি মাঝে ঢুকিয়ে পেঁচিয়ে দিয়ে জলে ছেড়ে দিলে, রবাবের পেঁচ খুলে খুলে আইসক্রিমের কাঠি ঘুরত আর নৌকা সামনে এগোতো।

চরকা ঘোরানো

খেজুর পাতার চরকা তৈরি করে তার মাঝে। খেজুরের শলা ভরে দিয়ে বাতাস যেদিকে আসে সেই দিকে দৌড়ে দিয়ে চরকা ঘুরত অথবা বাতাস বেশি থাকলে দাড়িয়ে থাকলেও চরকা ঘুরত।

রিং চালান

লোহার রিং আর একটি লাঠির মাথায় ইউ-এর মত একটি শক্ত গুনা বসিয়ে লোহার রিঙকে ঠেলে আস্তে আস্তে দৌড়ালেই রিংটি ঘুরত।

টায়ার চালানো

এটা চালাতে গেলে সাইকেলের টায়ার ও একটা লাঠি দরকার টায়ারকে গড়িয়ে দিয়ে লাঠি দিয়ে মেরে মেরে টায়ারকে ঘুরানো হত।

এইসব কথা ভাবতে ভাবতে স্মৃতির পাতা হাঁতড়ে ফেললাম আমি। কিন্তু লাটিম খেলা, রিং চালানো খেলা, পাঁচ গুটির খেলা আমি খেলতে পারতাম না। তবে আমি হয়তো আকাশকুসুম কল্পনা করছি যদি এমন হত, ইন্টারন্যাশনাল ভাবে খেলাগুলো স্বীকৃতি পেত এবং অলিম্পিকে খেলাগুলি করা হত – যেমন, গল্লাছুট দলীয় খেলা হতে পারে, হতে পারে রিং চালিয়ে দৌড় প্রতিযোগিতা অথবা মাংস চুরির খেলা। এজন্য দরকার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুনজর ও অক্লান্ত প্রয়াস।


পরিচিতি

যোষেফ হাজরা। ছদ্ম নাম তারুণ্যের কবি।

আমি আমার জীবন গঠনের সময় বহু জায়গার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলাম। শহরের হাওয়া বা মফসলের জীবন এমনকি উত্তর আর দক্ষিণাঞ্চলের জীবনধারার ছোঁয়া আমি হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছি। আমার জন্মস্থান মোংলার স্বনামধন্য সেন্ট পলস হাসপাতালে। ১লা মে জন্ম হাওয়ায় ফাদার মারিনো রিগন আমার নাম যোষেফ (আধুনিকায়নে যোসেফ) রাখে। পিতা তাপস হাজরা, মাতা এন্ড্রো রিনা নাথ।

আমি প্রথম যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “আমাদের ছোট নদী” কবিতা পড়ে তার সম্পর্কে জানি তখন থেকেই তিনি আমার অনুপ্রেরণা। এ জন্য চিত্রকলা, সংগীত, আবৃত্তি, অভিনয় ও পরবর্তীতে সেন্ট পলস স্কুলের লাইব্রেরি ও বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের অপার সুযোগে লেখালেখির হাতে খড়ি দেই। সকল শিল্প-সংস্কৃতি থেকে আমি লেখালেখি করতে বেশি ভালবাসি। কারণ মনের কথা সম্পূর্ণরূপে ব্যক্ত করে, ভাষার জাদুকারিত্বে, জ্ঞান ও দর্শনের যে সমন্বয় হয়, সেই আত্মদর্শনে সম্পূর্ণ আত্মতৃপ্ত করতে সক্ষম। আমি যদিও রবীন্দ্রনাথকে গুরুদেব মানি তবুও তার ধাঁচে আমি লিখি না। আমি কাব্য ও রচনায় অন্যান্য ঢং রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করি যাতে কেউ পড়ামাত্রই বুঝতে পারে এই লেখনীর স্রষ্টা কেবলমাত্র আমি।