ফাদার রিগন – ০১

ফাদার মারিনো রিগন – ছবিচিত্র

ফাদার মারিনো রিগান
৫ ফেব্রুয়ারি ১৯২৫ ~ ১৯ অক্টোবর ২০১৮
সমাধিঃ ২১ অক্টোবর ২০১৮ (শেলাবুনিয়া বাংলাদেশ)

ফাদার মারিনো রিগান পঞ্চাশের দশকে বাংলাদেশে আসা একজন ইতালিও ধর্ম প্রচারক, দার্শনিক, লেখক ও অনুবাদক। ধর্ম আর দেশের বেড়াজাল ডিঙিয়ে বাঙালির বন্ধু হিসেবেই সমধিক পরিচিত।

১৯২৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ইতালির ভেনিসের কাছে ভিল্লভেরলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ফাদার মারিনো রিগন। ২৮ বছর বয়সে ১৯৫৩ সালে ফাদার মারিনো খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আসেন। পুরো দেশ ঘুরে শেষ পর্যন্ত বাগেরহাটের মংলা উপজেলার হলদিবুনিয়া গ্রামে দীর্ঘস্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন তিনি। ধর্ম প্রচারের পাশাপাশি তিনি গরিবদের সাহায্য, শিক্ষার প্রসার এবং চিকিৎসাসেবায় এগিয়ে আসেন।

ফাদার রিগান ছিলেন একজন দার্শনিক, অনুবাদক ও লেখক। তিনি বাংলা শিল্প-সাহিত্য নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেন। পরে সেটি ইতালীয় ভাষায় অনুবাদ করেন। তিনিই ইতালীয় ভাষায় অনুবাদ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলিসহ প্রায় ৪০টি কাব্যগ্রন্থ ও গানের মধ্যে ছিল লালন সাঁইয়ের তিন শতাধিক গান। পাশাপাশি তিনি জসীম উদ্দীনের নকশীকাঁথার মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাটসহ বিভিন্ন জনপ্রিয় কবিদের কবিতা অনুবাদ করেন।

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে তার তত্ত্বাবধানেই প্রতিষ্ঠিত হয় সেন্ট পলস উচ্চ বিদ্যালয় সহ ১৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যেখানে ছিল সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য বৃত্তির সুবিধা। তার হস্তক্ষেপেই ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশের একটি নৃত্যনাট্যের দল ইতালিতে মঞ্চস্থ করে ‘নকশীকাঁথার মাঠ’।

ফাদার রিগানের সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি অসুস্থ ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও সেবা দেন। এর মাধ্যমেই তিনি সরাসরি বাংলার মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তার এই কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৯ সালে বাংলাদেশ সরকার ফাদার রিগানকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব প্রদান করেন। মুক্তিযুদ্ধের সেই ভয়াবহ দিনগুলোতে এদেশ থেকে চলে যাওয়ার পরিবর্তে তিনি এদেরই একজন হয়ে এদের পাশে দাঁড়ান পরম বন্ধুর মতো। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ, হত্যা-লুণ্ঠন, নারী নির্যাতন, অগ্নিসংযোগের কারণে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা নিজ চোখে দেখে যুদ্ধপীড়িত ও যুদ্ধাহত মানুষের পাশে এসে দাঁড়ালেন, চিকিৎসাসেবা দেয়ার জন্য ঢেলে সাজালেন নিজের ক্ষুদ্র চিকিৎসাকেন্দ্রটি। সেই সঙ্গে তাদের আশ্রয় ও খাদ্য সংস্থানের ব্যবস্থাও করলেন।

এদেশের মুক্তিযুদ্ধে, সৃজনশীল ও শিক্ষামূলক কাজে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সরকার তাকে প্রদান করেছেন বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব। মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদানের জন্য তিনি অর্জন করেছেন রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’।

অত্যন্ত বৃদ্ধ বয়সে অসুস্থ অবস্থায় চলৎশক্তিহীন ফাদার রিগনকে ইতালি ফিরিয়ে নিয়ে যান তার আত্মীয়রা। অবশেষে ইতালির ভিচেঞ্চায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় স্থানীয় সময় ১৯ অক্টোবর ২০১৭ সালের শুক্রবার সন্ধ্যায় ৯৩ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ফাদার মারিনো রিগন।

বাংলাদেশের মাটিতে চিরনিদ্রায় শায়িত হওয়ার ইচ্ছা বহুবার ব্যক্ত করেছিলেন তিনি। সেই মতো, মৃত্যুর পূর্বে পরিবারকেও জানিয়ে গিয়েছিলেন শেলাবুনিয়ার মাটিতেই সমাধিস্থ হবার কথা। তখন তা সম্ভব হয়নি। তবে তার সেই ইচ্ছার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বাংলাদেশে অকৃত্রিম এই বন্ধুর মরদেহ মৃত্যুর এক বছর পর জন্মভূমি ইতালি থেকে বাংলাদেশ আনা হয় সরকারি সহযোগিতায়। ইতালি থেকে ফাদার মারিনো রিগনের মরদেহ সঙ্গে করে নিয়ে আসেন মিলানের বাংলাদেশ দূতাবাসের কনসাল জেনারেল ইকবাল আহম্মেদ ১৯১৮ সালের ২১শে অক্টোবর। ঐ দিনই দুপুর ২টার দিকে তাকে মোংলার শেলাবুনিয়ার ক্যাথলিক মিশন চার্চে সমাহিত করা হয়। এর আগে, চার্চের সামনে তাকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। তার ইচ্ছাপূরণ হয়েছে। বাংলার বন্ধু ফাদার রিগন পবিত্র শান্তিতে ঘুমিয়ে আছেন বাংলাদেশে শেহালাবুনিয়ার মাটিতে।