বিভূতি দাস – কবিতা (কেউ চায় না, বেশ কঠিন, মাসি পিসি, শরণ নিব কোথা, কে যাসরে)

কেউ চায় না

– বিভূতি দাস

শুধু আশীর্বাদ চায় তোমার আদর্শ মানতে কেউ চায় না
ফটোতে আবক্ষ মূর্তিতে মালা পরিয়েই কাজ শেষ
তোমার দেখানো পথে কেউ ভুলেও হাঁটতে চায় না
শুধু আশীর্বাদ চায় তোমার আদর্শ মানতে কেউ চায় না।

“শিব জ্ঞানে জীব সেবা”-র ভাবনা উল্টো পথে দেয় রওনা
ভাষণে কৌশলী ছাপ, ধুপ-ধুনো গানে স্মরণ লাগে বেশ
শুধু আশীর্বাদ চায় তোমার আদর্শ মানতে কেউ চায় না
ফটোতে আবক্ষ মূর্তিতে মালা পরিয়েই কাজ শেষ।

সুন্দর ফ্রেমে বাঁধানো বাণী দেয়াল জোড়া দেখতে পাই
তার নিচেই দেখি মানবতার মৃত্যু, অন্তরে গভীর আঁধার
কেউ বলে না উঁচু নিচু মূর্খ দরিদ্র সবাই সকলের ভাই
সুন্দর ফ্রেমে বাঁধানো বাণী দেয়াল জোড়া দেখতে পাই।

মুক্ত উদার দৃষ্টিতে বিশ্ব ভাতৃত্বের ভাবনা আর বেঁচে নাই
মুখোসের মুখ দেখে দেখে চঞ্চল চিত্ত, শুধু সাজের বাহার
সুন্দর ফ্রেমে বাঁধানো বাণী দেয়াল জোড়া দেখতে পাই
কেউ বলে না উঁচু নিচু মূর্খ দরিদ্র সবাই সকলের ভাই।

বেশ কঠিন

– বিভূতি দাস

খাবার আছে পোশাক আছে, আছে মাথার উপর ছাদ
তবুও বাঁচাটা বেশ কঠিন; মনে হয় জীবনটাই বরবাদ
খাওয়া ঘুম খাওয়া; দিন রাত্রির পরিক্রমায় একটাই কাজ
কেমন করে বাঁচে মানুষ নিষ্কর্মে? বুঝতে পারছি আজ
আড়-মোড়ায় সকাল অথবা ভরা পেটে এর বিপরীত
অকাজ হলেও সই, তাসে গল্প গুজবে না হলেও হিত।

ঘরে থাকলেও বোবা, অকাজের কথা শোনার তেমন কেউ নেই
আড্ডায় পরনিন্দা পরচর্চা এড়িয়ে চললে ঘর ও বাহির একই
পার্টি পলিটিক্সে হাজার পেচাল, সেখানে কল্কে পাওয়াই দায়
ষ্টেশনের বেঞ্চেও জায়গা মেলে না, সারাক্ষণ কি হাঁটা চলা যায়?
চায়ের দোকান বেঞ্চি হীন, যারাই আসে সবাই দেখি ব্যস্ত
আগের কালে চায়ের আড্ডায় রাজনীতি সমাজনীতি বেশ জমত।

চায়ের গ্লাসে উঠত তুফান খেলা কিমবা রাজনীতির আঙিনায়
যদিও ছেদ পড়েনি, তবুও অনেকটাই ম্রিয়মাণ বর্তমানের তালিকায়
কিছু যৌবন জোটে ছুটির দিনে, তবে ব্যস্ত থাকে নিজ ধান্দায়
কর্মে অবসর, দরজা বন্ধ ঘেরা টোপে সকাল বিকেল বন্দী
খুঁজে পেতে পেলেও গাছতলা, সেখানে ও সহজে হয় না সন্ধি
অন্তসার শূন্য আলোচনায় অবান্তর ভাবনায় মনের হয় না তৃপ্তি।

মাসি পিসি

– বিভূতি দাস

শীতের মাসি শীতের পিসি ছিলি কোথায় ঘাপটি মেরে
আদরে কাঁপছে শরীর ছেঁড়া কাঁথায় হাহা হিহি হুঁ হুঁ করে
সুয্যি মামাও আছে ভয়ে মুখ লুকিয়ে মেঘের কোলে
করছ মজা সেই সুযোগে! উত্তুরে হওয়ায় পাল তুলে।

বুকের কাছে হাঁটু এনে কান চাপা দিই দুই হাতে
নিঃশ্বাসের গরম টুকুও যায় পালিয়ে আঁধার রাতে
জড়সড় রাত কাটে না ঢুকছে বাতাস বেড়ার ফাঁকে
ও মাসি এবার থামো দাঁত কপাটি যাচ্ছে লেগে।

রাত-বিরেতে বলি কাকে ভীষণ ভয় খড়ের গাদায়
শুনেছি মনসার ছা সেথায় নাকি আরামে নিদ্রা যায়
ও পিসি তুই নাকি বড্ড আপন বাপের আপন বোন
চুলার আগুন ও নিভে গেছে বল না কি করি এখন?

সকাল হলে নতুন খড়ে ঢেকে দেবো বেড়ার ফাঁক
কথা দিচ্ছি ভুল হবে না করিস নে আর খ্যাঁক খ্যাঁক
আর পারিনে সইতে গো মায়ের দেওয়া নকশি কাঁথায়
মা নেই তাই করছ এমন হাড় কাঁপানি ভালবাসায়!

বুঝতে পারছি এ কেমন আদর মায়ের মত মোটেই নয়
মায়ের আঁচল করত যতন আদরে তার ফাগুন হাওয়া বয়
গাছ গাছালি পশু পাখী গান শোনাত সকাল বিকেল সন্ধ্যায়
বুঝেছি আপন সবাই মুখে সুখে, অসময়ে কেউ কারো নয়।

শরণ নিব কোথা

– বিভূতি দাস

দুঃসময়ের আঁধার ঘেরা এই জাহানের চারভিতে
কোথা গিয়া শরণ নিব পরাণ রাখি কার হাতে
গুরু বিনে পথের দেখা পাইনে কোথাও তাই
ও দয়াল কি ভাবে চিনি, বল তারে কোথায় পাই
চলতে চলতে হয়রান হয়ে পরাণ কি যাবে পথে?
কোথা গিয়া শরণ নিব পরান রাখি কার হাতে।

গুরু ভেবে যার কাছে যাই পথ দেখায় সে জোচ্চুরি
সৎ ভাবনার রকম দেখে মন বলে মুক্ত কর হরি
ভবের এই ভাঙা মেলায় সব দোকানি ঘরে ফেরে
পথ যে দেখি আঁধার ঘেরা ফিরি তবে কেমন করে
বৃক্ষতলে আশায় আছি যদি পথ চেনাতে আসে সাঁই
এই জাহানের চারিভিতে ভীষণ আঁধার, আলো কোথা যাই।

ফাঁকা কলসের পসরা নিয়ে কত তরী নিত্য আসে যায়
জ্ঞান চক্ষু সাবধান করে না জেনে মজ না মহিমায়
আর কতকাল বইবে সময় এমন করে বসে বৃক্ষ তলায়
হরির স্বরুপ হরিই জানে কি ভাবে চিনি তোমায়
যোগ সাধনার কোন অক্ষে গুরুর দেখা মেলে
ইহজন্মে কি হবে না জানা? দেহের বিনাশ না হলে।

কে যাসরে

– বিভূতি দাস

কে যাসরে গোলাপ বাগে পরাণ রাইখা বাজী
কাঁটার আঁচড় খাবেই পরাণ ভরবে নারে সাজি
দেইখা শুইনা যতই চলিস তারে এড়ান নাহি যায়
ছাড়ান নাই তার কোন ভাবেই মন করলে হায় হায়
রূপের মাঝে রঙ্গ অনেক; বন্ধু যাইয়োরে সব বুঝে
কাঁটার জ্বালায় পাগল পারা প্রেম পাবি না খুঁজে
অকুলে তোর ভাসবে তরী ওরে সজাগ থাকিস মাঝি
যাইওনা বন্ধু গোলাপ বাগে পরাণ রাইখা বাজী।

কার চোখে যে কি খেলা সেতো বোঝা বড়োই দায়
কোন ছলনায় খেলছে কে খেলায় কাকে, আসে না চেতনায়
আসবে যাবে সময় তরী ভাসাইও না ঢেউয়ের মাথায়
মজলে নোনা পানির ছলনাতে জলাতঙ্ক দেহে ছড়ায়
তিন মাথাতে বসা মাঝির কথা শুইনো ভাবের সময়
কাঁচের টুকরার চমক বেশি আসলেই তা হীরা নয়।


কবি পরিচিতি

বিভূতি দাস। অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক। জন্ম ১৪ই ফেব্রুয়ারী, অভিভক্ত ২৪ পরগনার কৃষক পরিবারে।

প্রকৃতির কোল ছুঁয়ে গ্রামে বেড়ে ওঠা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। ছাত্রাবস্থা থেকেই সৃষ্টির সাথে প্রেম। নেশা-লেখালিখি এবং ভ্রমণ। বর্তমান নিবাস – সোনারপুর, কলকাতা –৭০০ ১৪৯, ভারত।