কোথায় অবসর
– জয়শ্রী কর
প্রাণী মাত্রই কর্মব্যস্ত
নেইকো অবসর
এই সমাজের কোনও মানুষ
নয়কো স্বনির্ভর।
যে যার পেশায় যুক্ত থাকে
বৈচিত্র্যে ভরপুর
পশুপাখি কীটপতঙ্গের
পথ নয় বন্ধুর।
চাকরিজীবন শেষ হলেও
স্থির নয় সাম্পান
কাজকর্ম চলতে থাকে
হয় না অবসান।
ঘুমিয়ে গেলে পাই অবসর
স্বপ্নে হই বিভোর
জেগে দেখি আলোর ছটা
কখন হল ভোর।
এমনি করেই দিন গুজরান
প্রহর গুনি আজ
প্রদীপের তেল ফুরিয়ে এল
বাকি অনেক কাজ।
চাঁদমামা
– জয়শ্রী কর
অপরূপ সাজে দেখি আকাশের মাঝে
ঝরে পড়া জ্যোৎস্নায় বিরোহী বিরাজে।
রাতের আকাশ প্রেমের জোয়ারে ভাসে
কুঁড়িদের চুমা দিলে আঁখি মেলে হাসে।
ভুবন ভরায় শশী পূর্ণিমা রাতে
সারারাত কথা বলে প্রকৃতির সাথে।
গাছের পাতায় হাসির ঝরনা ঝরে
অটবিতে লতা খুশিতে নৃত্য করে।
সারা বিশ্বকে আঁচলে আগলে রাখে
জননীর মতো কোলে নিয়ে জেগে থাকে।
দখিনা বাতাসে দিঘিবুকে ওঠে ঢেউ
বিধুমুখী নেচে যায় দেখে কেউ কেউ।
চাঁদের পরশে মন খুঁজে যায় তাঁরে
জানলার ফাঁক দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারে।
নাই তাঁর মনে লজ্জা শরম ভয়
একলাই জাগে কোথা তুমি মনোময়।
জেলেদের তরি ভাসে সাগরের জলে
ফলবতী হবে আশা যাবে না বিফলে।
নিশীথে নীরবে বাজায় প্রাণের বাঁশি
ভোরের আলোতে নিমেষে মিলায় হাসি।
হাতঘড়ি
– জয়শ্রী কর
হাতঘড়িটা হাতে বাঁধি
কলেজ-জীবন থেকে
ঠিক সময়ে কলেজ যেতাম
ঘড়ির কাঁটা দেখে।
বাবার দেওয়া হাতঘড়িটা
হৃদয়ে দেয় দোলা
কী আনন্দ তখন আমার
যায় কখনো ভোলা?
নতুন ঘড়ি পেয়ে তখন
মা’কেই আগে ডাকি
প্যাকেট খুলে দেখিয়ে দিয়ে
যত্ন করে রাখি।
হাতঘড়িকে হাতে বাঁধার
রেওয়াজ ছিল আগে
সময়মতো কোথাও যেতে
খুব দরকার লাগে।
মুঠোফোনের যুগে এখন
ক’জন পরে হাতে
প্রয়োজন নেই ঘড়ি পরার
মোবাইল রয় সাথে।
বাংলার গ্রাম
– জয়শ্রী কর
গ্রাম বাংলার মনোমোহিনী কী অপরূপ শোভা
জলে স্থলে রঙের মেলা সে রূপ মনোলোভা।
শরৎ আসে ভুবনমাঝে খুশির পরশ মেখে
নীল আকাশে মেঘবলাকা দিচ্ছে ছবি এঁকে।
শীতল হাওয়া খেলা করে শুভ্র কাশের বনে
শিশির, ঘাসে আলপনা দেয় খুশির জোয়ার মনে।
রৌদ্রছায়ার লুকোচুরি চলে মেঘের মেলায়
আঁধার রাতে আঙিনাতে শিউলি সুবাস ছড়ায়।
দিঘির বুকে শাপলা শালুক প্রাণে পরশমণি
কদিন পরে উঠবে বেজে মায়ের আগমনি।
বর্ষারানি চায় না যেতে ভুবনখানি ছেড়ে
আমরা বলি, ‘সব আনন্দ নিয়ো না গো কেড়ে’।
গ্রামবাংলা ভরে ওঠে পাখপাখালির গানে
উন্মাদনায় মাতিয়ে তোলে মিষ্টি মধুর তানে।
কচি ধানের মঞ্জরিতে তৈরি বরণডালা
মা কে আমরা পরিয়ে দেবো শ্বেত শতদলমালা।
শত দুখেও মেতে ওঠে সকলে উৎসবে
সবার সাথে মিলেমিশে মাতবে আবার ভবে।
ছয়টি ঋতু ছয়টি সাজে মাতায় নৃত্য গীতে
ফুলের হাসি ফুটিয়ে তোলে সবার চিতে চিতে।
রোজনামচা
– জয়শ্রী কর
এখন আমি পৌঁছে গেছি বার্ধক্যের দ্বারে
মনের কথা জমিয়ে রাখি মনেরই খামারে।
সকাল থেকে ব্যস্ত থাকি মাত্র দুজন ঘরে
হাসিমুখে রান্না-খাওয়া হালটি রাখি ধরে ।
বেশ কেটে যায় আনন্দেতে আঁকড়ে ধরে মাটি
সর্বকর্মে সখা আমার নিখুঁত পরিপাটি।
বৃষ্টিভেজা হিমেল হাওয়া জাগায় আমায় ভোরে
উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকি শিউলি পড়ে ঝ’রে।
মনে মনে উড়তে থাকি ইচ্ছেডানা মেলে
কোথায় হারাই তা জানি না হাতের কাজটি ফেলে।
যতই বলুক, ‘পড় পড়’, মন বসে না পড়ায়
রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকি আকাশটা মন ভরায়।
নীল আকাশে উড়ে বেড়ায় পেঁজাতুলোর সারি
রোজ বিকেলে বেড়াতে যাই হই না ছাড়াছাড়ি।
দিন কেটে যায় রাত কেটে যায় তাকিয়ে আকাশপানে
রবি-শশী ছড়ায় আলো সকলেই তা জানে।
চাঁদের আলো ডাক দিয়ে যায় হবি আমার সাথি
পূর্ণিমাতে খেলে খেলে কাটিয়ে দেবো রাতি।
মহানন্দে প্রহর কাটে প্রকৃতির ওই ডাকে
চন্দ্র বলে আয়-না সাথে দেখবি যদি মা কে।
কবি পরিচিতি

জয়শ্রী কর। জন্ম জুন ২, ১৯৫৬তে পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় কোলাঘাট থানার অন্তর্গত চিমুটিয়া গ্রামে মাতুলালয়ে। মাতা কমলাবালা, পিতা রামপদ মাইতি।
কোদালিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার প্রথম পাঠ। ১৯৭৪ এ ভোগপুর কেনারাম মেমোরিয়াল হাই স্কুল থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর পাঁশকুড়া বনমালী কলেজে স্নাতক স্তরে কলা বিভাগে ভর্তি হন। পড়া চলাকালীন ১৯৭৬ এ ডক্টর অজিত কুমারের সঙ্গে শুভ পরিণয়। কৈশোর থেকেই খেলাধুলা, সেলাই ও শরীরচর্চার সঙ্গে তিনি যুক্ত। পরে গিটার, তবলা, যোগ ব্যায়াম এবং কাব্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন। নিজে একজন সংগীত শিল্পী ও সুরকারও বটে – বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি ও সংগীত পরিবেশন করে থাকেন।
প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘নীল আকাশের কোলে’ পাঠকমহলে খুবই সমাদৃত। রাজ্য সরকারের তরফে রাজা রামমোহন রায় লাইব্রেরীর ফাউন্ডেশন এবং বঙ্গীয় প্রকাশক ও পুস্তক বিক্রেতা সভার যৌথ উদ্যোগে তার বই কেনা হয় পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার গ্রন্থাগারগুলির জন্য। এছাড়া আরো দুটি কাব্যগ্রন্থ – ‘ভোরের বাঁশি’ এবং মায়াডোর’ – প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যে। প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাঁর কবিতা রচনার প্রেরণা। প্রতিদিন কবিতা লেখা, কাব্য আলোচনা আর গানবাজনা নিয়ে দিন কাটছে বর্তমানে।