অজিত কুমার কর – কবিতা (মহাপ্লাবনে ধ্বংস অনিবার্য, জীবনে নেই অবসর, ও বিহঙ্গ, হইহুল্লোড়ে চাপা পড়ে দীনের আর্তনাদ, সঞ্চারিত কলুষতার কোরবানি)

মহাপ্লাবনে ধ্বংস অনিবার্য

– অজিত কুমার কর

ধ্বংসলীলায় প্রমক্ত আজ রাষ্ট্রপ্রধান
মানুষের সুখশান্তি উধাও গৃহহারা
স্বদেশ ছেড়ে পালিয়েছে ক্লেশ সীমাহীন
পরাশ্রয়ে কাটাচ্ছে দিন এখন তাঁরা।

যুদ্ধবিমান ফেলছে বোমা তাইওয়ানে
স্বাধীনতা করবে হরণ চিনের শাসক
বৃহৎশক্তি দেয় হুংকার খুব সাবধান
উপযুক্ত শাস্তি দিতে ফেঁদেছে ছক।

রাশিয়াও কম যায়নি গুটোয়নি হাত
প্রায় সাতমাস অতিক্রান্ত জ্বলছে আগুন
কেন এমন আগ্রাসীভাব বোঝা দুষ্কর
চেতন এবং মনুষ্যত্বে লেগেছে ঘূণ।

প্রতিবাদে মুখর হলেও বিশ্ববাসী
ওদিকে কান দেয় না নেতা এমন পাষাণ
গ্রাস করবে ইউক্রেনকে ইচ্ছে এটাই
ওদের মুখে শান্তিবাণী খুব বেমানান।

বেশিরভাগই মানুষ ধরায় শান্তিপ্রিয়
সুখযাপনের স্বপ্নটুকু নিচ্ছে কেড়ে
প্রকৃতি মা উঠছে ফুঁসে উষ্ণায়নে
জলোচ্ছ্বাসে বিলীন হবে আসছে তেড়ে।

জীবনে নেই অবসর

– অজিত কুমার কর

প্রাণ আছে যার কাজ আছে রোজ তাঁর
নিজের জন্য, পরের জন্য কিছু
এভাবেই চলে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড
স্থবিরতা পায় প্রাণ নাই দেহে যার।

কীটপতঙ্গ পশুপাখি আছে যত
অবসর নেই দিবানিশি শুধু কাজ
যখন ঘুমোয় ওইটুকু অবসর
আমৃত্যু তাঁরা সকলে কর্মরত।

আমরা মানুষ বিচিত্র সব পেশা
কেউ ভাস্কর কেউ কেউ শিক্ষক
কৃষক-শ্রমিক-ডাক্তার-কবিরাজ
বিজ্ঞানীদের গবেষণাটাই নেশা।

ষাট-বাষট্টি চাকুরিজীবন শেষ
গতানুগতিক কাজ থেকে অবসর
জীবনপ্রবাহ চলে আঁকাবাঁকা পথে
লিখছি এখন করি না হাপিত্যেশ।

সকল প্রাণীর সুসীমিত পরমায়ু
তিমি-কচ্ছপ-স্পঞ্জ দীর্ঘজীবী
চির অবসর কখন যে কার মেলে
কাজ করে, যতদিন দেহে প্রাণবায়ু।

ও বিহঙ্গ

– অজিত কুমার কর

পাখিরা পেয়েছে ডানা একজোড়া পালকে আচ্ছাদিত
ওদের ভুবন সুনীল আকাশ কেউ জলে সাবলীল
কোন শিল্পীর তুলির আঁচড়ে সর্বদা ঝিলমিল?
মাধুরী মিশিয়ে দিয়েছে রাঙিয়ে নয় তা অপরিমিত।

কোয়েলের ব্যথা কোয়েলাই বোঝে ডাকলেই দেয় সাড়া
প্রভাত হবার অনেক আগেই ঝাঁকে ঝাঁকে ছাড়ে নীড়
নিয়মের ফাঁদে জড়ানো জীবন বন্ধন সুনিবিড়
ফিরবে কুলায় সন্ধ্যার আগে দৃশ্য নজরকাড়া।

শ্বেত পারাবত শান্তির দূত, মৈত্রীর আহ্বান
রাষ্ট্রনেতার রক্তচক্ষু চরম আগ্রাসন
সাম্যবাদের পাঠ জানা নেই কেন যে ওরা এমন
পাখিদের মতো কেন যে হয় না মানুষ নিষ্ঠাবান।

ফুলের সুবাস পাখির কুজন প্রশান্তি আনে প্রাণে
মেঘ জমলেই ময়ূর নাচবে পেখমের কী বাহার!
বিষাদগ্রস্ত মানুষ তখন ভুলে যায় ব্যথা তাঁর
ঘুম ভেঙে যায় অতি প্রত্যুষে কোকিলের কুহুতানে।

কাতর আর্তি চাতক পাখির ওগো মেঘ দাও জল
তুমি কী বোঝো না আমাদের ব্যথা জীবন যে যায় যায়
ঝর ঝর ঝর ঝরলেই বারি ওরা তৃষ্ণা মেটায়
রামধনু রং ডানায় তখন ফিরে পায় মনোবল।

হইহুল্লোড়ে চাপা পড়ে দীনের আর্তনাদ

– অজিত কুমার কর

বিয়েবাড়ি হইহুল্লোড়ে আলোকের রোশনাই
অতিথিদের আনাগোনা বিপুল আয়োজন
আপ্যায়নে নেইকো ত্রুটি আমরা অভাজন
এদিকে কেউ দেয় না নজর একটু খাবার চাই।

ঘন্টাদুয়েক দাঁড়িয়ে ছিলাম ফিরে যাই তারপর
আস্তাকুঁড়ে অঢেল খাবার বেঁধেছি গামছায়
অভুক্ত যে আরও দুজন জেগে আস্তানায়
খাবার দেখে ফুটল হাসি পেটপুরে আহার।

শুধুই ভাবি আপন মনে আমি কি মানুষ
আর পাঁচজন লোকের মতোই হাত-পা বিদ্যমান
দেখার জন্য চক্ষু আছে শোনার জন্য কান
কিন্তু ওরা কেমন মানুষ কোথায় ওদের হুশ!

ভিক্ষাবৃত্তি ললাটলিখন কেন এমন হয়
মৃত্যুর পর কোথায় ফেলে শ্মশানে নেই স্থান
সৃষ্টিকর্তা বড় নিষ্ঠুর দেখেও নীরব রয়।

আমাদের এই আর্তি ওড়ায় দক্ষিণা বাতাস
বিসমিল্লার সানাইবাদন বড়ই সুমধুর
খোশগল্পে অভ্যাগত সকলে মজবুর
কর্মকর্তার চোখেমুখে বিরক্তি একরাশ।

সঞ্চারিত কলুষতার কোরবানি

– অজিত কুমার কর

আপন চিত্তে অশুভ যা কোরবানি দাও নির্দিধায়
তবেই তিনি খুশি হবেন সবাই জানি সুনিশ্চিত
চেষ্টা করলে পারব ঠিকই মোটেও তা নয় সাধ্যাতীত
কিন্ত আমরা এড়িয়ে চলি নামি না কেউ পরীক্ষায়।

লোভ-লালসা বড় শত্রু কন্টকিত করছে পথ
প্রমোদে গা ভাসাই আমরা ভোগের দিকে যায় নজর
কল্পনাবিলাসী এ মন উড়ে বেড়ায় নিরন্তর
সমাগত শুভলগ্ন নিতে হবে সেই শপথ।

চান-না তিনি ইদের দিনে ঘটুক এত রক্তপাত
অসহায়ের কাতর কান্না বাড়ায় না কি বক্ষশূল?
কবে মানুষ শিক্ষা নেবে করছে যা তা বিরাট ভুল
জবাই করার সময় দেখ কাঁপবে না কি তোমার হাত?

একদিনে সব বন্ধ হবে, এমন ভাবনা অবান্তর
ভোরের আজান বার্তাবহ পরক্ষণেই হোক প্রচার
জীবের প্রতি দয়া দেখান এ দায়িত্ব নয় একার
রক্তপাতহীন উৎসব চাই জানুক বিশ্বচরাচর।

শান্তি ফিরুক সারাবিশ্বে বিরাজ করুক সুস্থিতি
পৃথিবীটাই স্বর্গ তখন বিলুপ্ত হোক হিংসা দ্বেষ
বৃষ্টি ধারার মতোই ঝরুক মুখে মুখে এ সন্দেশ
সুন্দর এই ভূমণ্ডলে উঠুক গড়ে সম্প্রীতি।


কবি পরিচিতি

অজিত কুমার কর। জন্ম ১লা জানুয়ারি ১৯৪৬ পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কিসমৎ জগন্নাথ চক গ্রামে। মাতা রাজবালা, পিতা কালিপদ। মৌরাজল অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শুরু। ১৯৬২ সালে রামচন্দ্রপুর রাইসুদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে স্কুল ফাইনালে উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৩ তে পাঁশকুড়া বনমালী কলেজে থেকে প্রি-ইউনিভারসিটি ও ১৯৬৬ তে বিজ্ঞান বিভাগে সপ্তম স্থান অধিকার করে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক হন। ১৯৬৯ এ কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এস সি গণিতে প্রথম হওয়ার ছয় বছর পর ১৯৭৫ এ ওখান থেকেই পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। সিএসআইআর এর পোস্ট ডক্টরেল ফেলোশিপ পেয়ে পুল অফিসার হিসাবে দু’বছর গবেষণা করেন। ১৯৭৬ সালে জয়শ্রী মাইতি-র সাথে শুভ পরিণয়। এরপর হুগলি জেলার নবগ্রাম হীরালাল পাল কলেজে কুড়ি বছর অধ্যাপনার পর ২০০৫ এ গণিত বিভাগ থেকে রিডার হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।

তারপর প্রবেশ সাহিত্যের আঙিনায়, সহধর্মিণী ও কবি সুমনা প্রামাণিক এর অনুপ্রেরণায়। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ সাতটি। ‘ঝিরিঝিরি বৃষ্টি তাথৈ তাথৈ নাচ’, ‘পঞ্চক’ ৪খন্ড, ‘লাঞ্ছিত গোলাপ’ এবং ‘রত্নমালা’। অপ্রকাশিত ‘ছড়ার ঘড়া’, ‘ঘড়া ঘড়া ছড়া’, ‘হাঁড়ি ভরা ছড়া’ ‘এক কড়া মিঠা ছড়া’, ‘মহৌষধ বনৌষধি’, ‘শেয়ালের উপাখ্যান’, ইত্যাদি। কবির পাঁচটি ই-বুক ‘নীলাঞ্জনে রঞ্জিত’, ‘কে তুমি লাবণ্যময়ী’, ‘কীর্তিমান’, ‘প্রেমকাননে ফুটলো ফুল’ এবং ‘রুবাইয়াৎ-ই-অজিত কুমার। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে কবির কবিতা, অনুগল্প ও প্রবন্ধ। বর্তমানে বাংলা-কবিতাডটকম ওয়েব ব্লগ সাইটে নিয়মিত কবিতা পোস্ট করেন। ই-ম্যাগাজিনেও কবিতা প্রকাশিত হয়। অবসর জীবন কাটছে সানন্দে সারস্বত সাধনায় পাঁশকুড়ার জয়াকুঞ্জে।