বিভূতি দাস – কবিতা (সব সাজানো আছে, ছিঃ, বন্ধু, ক্যানভাসে ৩৬৫, ক বি তা নয়, শেষ চাঁদ)

সব সাজানো আছে

– বিভূতি দাস

রাস্তা বুক পেতে আছে পথিক প্রবর, তোমার ত্বরে
তোমাকে দেখতে হবেনা, সময় তোমাকে চিনিয়ে দেবে
হাসি কান্না কাউকে জানিয়ে আসেনা বন্ধু, তবুও সে আসে
ভাবলেও হিসাব মেলাতে পারবেনা কোনদিন, সব পেরিয়ে যাবে
ভেবনা, সময়ের প্রতি প্রকোষ্ঠে অতি যতনে সব সাজানো আছে।

প্রতি পলে – সময়ের অনুশাষণে নত শিরে ছোট ছোট ভাবনা
ভাবনার অমৃত কলসে উঁকি দিয়ে যাবে কি দেখা ঠিকানা
কোথায় যাবে – আগামীর জন্য রেখে দেওয়া প্রতি সন্ধিক্ষণে
সন্ধিহান মন, নিজেকেই বিশ্বাস করে না – ভুলে যায় প্রতি ক্ষণে
দিন গুণে গুণে পায়ে পায়ে এগিয়ে যাবে অদেখা ভুবনে।

বীজের রহস্য রক্ষিত – গোপন গভীরতায় সময়ের বন্ধনে
দু-পাতাতেই শুকাবে নাকি মহীরুহ হয়ে দেবে শান্তি প্রতি মনে
মাটির অন্তরে তোমার জনম মরণ প্রতিটি কণায় – অনুতে
চলতেই থাক, ভাবনা দূরে ঠেলে- মেঘের ঘরে বন্দী বৃষ্টির সাজে
ভেবনা, লক্ষ্যে অবিচল থাক জীবনে – সব সাজানো আছে ।

ছিঃ

– বিভূতি দাস

না, ওরাতো কিছু জানে না, ফুলের মত সুন্দর ঈশ্বরের দান
ওরাতো ক্ষতি করেনি কারো, নেয়নি মানুষের প্রাণ
নিস্পাপ ওরা, গিয়েছিল পড়তে, আগামীর স্বপ্ন মেখে
হাসি মাখা সকালে ঝরে যেতে হল অবুঝ-বর্বর কাপুরুষের বুলেটে !

ওরা হারিয়ে গেল, তবুও কি থামবে শয়তানি ইচ্ছার আস্ফালন
কি চায় ওরা? উড়াতে নিস্পাপ রক্তে ভেজা অন্ধকারের নিশান !
কি লক্ষ্য ওদের? কিসের আশায় শুকায়ে ফেলেছে চোখের পানি
পাবে কি ক্ষমা কোথাও, বেহস্ত তো নয়ই, অপেক্ষায় জাহান্নামের ঘানি ।

ফুল সে ফুটবেই জেনে রাখ তোরা, বুলেট দিতে পারে না সমাধান
যে প্রাণ তোরা নিচ্ছিস কেড়ে মূল্য তার চোকাতেই হবে, যাবে মান
বিশ্বাসের বলি হয়ে গেলি বিপথে – লিপ্ত হয়েছিস সৃ্ষ্টির সংহারে
পাবি না মাটি কবরে, কিম্বা শান্তি, করুণা ছায়ায় ঘেরা শেষ দরবারে।

ধিক, শতধিক ওরে কা-পুরুষের দল ভেবে দেখ একবার
সুযোগ হারিয়ে শয়তানি তখতে সাওয়ার হচ্ছিস বার বার
ছদ্মবেশে নারকীয় উল্লাসে মেতে আসলে কার জন্য করছিস কি
মাতৃ জঠর কাঁদছে, পিতার হৃদয় যাচ্ছে ভেঙে, সভ্যতা বোলছে ছিঃ।

( শয়তানি বুলেটে পেশোয়ারের নিস্পাপ শিশুদের ঝরে যাওয়া গোটা মানব জাতিকে নির্বাক, ব্যাথিত করে তুলেছে। এত মায়ের চোখের পানি, পিতার দীর্ঘশ্বাস কি বিফলে যাবে? সুস্থ চিন্তা কি সত্যই হারিয়ে যাবে কোন কিছুর দোহাই দিয়ে? একবার ভাবুন সবাই, সভ্যতা কি এদের ক্ষমা করবে? এই সামান্য লেখাটি, যে দীপ গুলো চিরতরে নিভে গেল তাদের জন্য উৎসর্গ হল। শান্তি আসুক, নিশ্চিন্তে ফুটুক ফুল, হাসি নিয়ে ভরে উঠুক মানব সভ্যতা। )

বন্ধু

– বিভূতি দাস

বন্ধু, ছোট্ট এক শব্দ, অসীমের ডানায় ভাসে
সময়ের আঁচড়ে মিশে থাকে জীবনের ক্যানভাসে।

রামধনু রঙে দিগন্ত সাজায় বিলায়ে নিজেকে
শান্তির ছায়া – পারের খেয়া – সবটুকু মিলায়ে।

বাড়ানো হাতই জানে জীবনের ওঠা পড়ার ছন্দ
সকাল-দূপুর বা মহাপ্রলয়ের ভ্রুকুটি, এ সম্পর্ক অন্ধ।

দুটি হাত – মুঠি এক – দশ আঙুলের অঙ্গীকার
উজান-সুজান সব পথই মেশে এ পথে বার বার।

ক্যানভাসে ৩৬৫

– বিভূতি দাস

কালের গর্ভে পুরানোটা, নতুন আসে আনন্দ উচ্ছ্বাসে
কোথাও স্ফুর্তির গাড় রং অথবা অনেকটাই আপশোসে
ইচ্ছে গুলো বোতলে বন্দি, মুখ খুলে হাসে শেষ রাতে
পোষাকে প্রজাপতি রং, আলোয় ঝল মল, কেউ জাগে ফুট্পাতে
সরকারি সাহায্য উৎসবে-আনন্দে, অভাগারা অপুস্টির অভিশাপে
চির অপরাধি, জন্মের অভিশাপ ঢাকে অবজ্ঞার প্লাস্টিকে।

বিরাট ক্যানভাস, লক্ষ থেকে কোটি শিল্পী -বুদ্ধিমান বিদ্বজন
ধান্দাবাজ রাজনীতিক ধর্ষক ধর্মের ধ্বাজাধারি শয়তান
হাতে তুলি টন টন রং, সবাই চায় দাগ কাটতে আগে আগে
কে ভাবে কার কথা, এগুতেই হবে ঠেলে-ঠুলে কৌশলে-আবেগে
সবাই বলে ভালো থেক মনে মনে সহযোগী নয়, প্রতিদ্বন্দ্বী
ভেসে যায় বোধ ন্যায়, বাধাহীন আরো পাওয়ার অভিসন্ধি।

লোভের রেখা সদাই ঊর্ধগামী – ক্যানভাসে নিচ থেকে সটান উপরে
দূর থেকে বাকিরা দেখে – সাবাস ধ্বনি, ঠান্ডা বাসি ভাত উদরে
প্রতিদিন কেমন যাবে – চিন্তায় পন্ডিত-মৌলবী – পঞ্জিকার
দিস্তে দিস্তে কাগজে-গনকযন্ত্রে হিসাব – জোগাড় নিজের খাবার
দিন যায় – বাতাস ভরে যায় – নানা গল্পে -ঘটনায়, বাড়ে অশান্তি
হারার নেই বিরাম, কাঁদে অনেক, তবু মিলে যায় ক্যানভাসে ৩৬৫।

ক বি তা নয়

– বিভূতি দাস

বিপদ :
এগুলে – পিছলে সবতেই বিপদ
গুরুজনের দীর্ঘশ্বাস – প্রিয়তমার হা-হুতাশ
বেচারা – যাবে কোথায়, নিজেই নিজের করেছে সর্বনাশ ।

যমের বাড়ী :
নতুন নতুন – ভাবে মনে কোথায় এলাম যখন তখন
যমের চ্যালা – ভুলিয়ে ভালিয়ে খোঁটা দেয় দুবেলা
ঝগড়া ঝাটি – কথায় কথায় কুমড়ো বঁটি
পঞ্চাশের পর – গুছিয়ে বসে যমরাজের ঘর
ছেলের বিয়ে – শোধ তুলবে মালকিন হয়ে
চ্যালা তখন – কলুর বলদ শোনে বারন যখন যেমন।

আসল কথা :
আশা ছিল – ভাগব নিয়ে আলাদা ফ্লাটে
গুলিয়ে গেল – বুড়ো – বুড়ির আহ্লাদে
একি মাল – এর চাইতে ঐ ভাল ছিল পাড়ার দুলাল
দখলে কার – জমি গেল আমার, ওদের যত আবদার ।

মেনি মুখো :
চাপের রাত – বেঘোরে যায়, অমাবশ্যা বা পূর্ণিমা নেই ফারাক
বিছানা যেন – এপারে আমি ওপারে তুমি, মাঝখানে নোম্যান্স ল্যান্ড
শুধালে সখা – নারে বেশ আছি, দিব্যি আছি, মনে ভাবে কপালে লেখা।

শেষ চাঁদ

– বিভূতি দাস

বাসি রজনিগন্ধাগুলো তখনো ফেলা হয়নি
কুকুরগুলো আগের রাতের এঁটো পাতা ঘেঁটে চলেছে
আত্মীয়-স্বজন সকালের চায়ে চুমুক দিয়ে মেতেছে গল্পে
কে ওঠাবে বাসি বিছানা তাই নিয়ে হাসাহাসি টিপ্পনি
বন্ধ দরজার ওপারে ডুবন্ত চাঁদ – নদীতে সরনা ভাটা
বেলা বাড়ে, কৌতুহলী চোখ, তবুও দরজা আঁটা।

বিষ্ফোরণ হয়ে গেছে চাঁদের পাহাড়ে, ইচ্ছেরা টুকরো টুকরো
বজ্রগর্ভ মেঘে ঢাকা সকালের আকাশ, তবে কি শেষের পূর্বাভাস
বোঝা যায়নি এত দিনের সম্পর্ক এ ভাবেই করবে নিরাশ
কারণ জানা নেই, কেবলি কানে বাজে অশনির দীর্ঘশ্বাস
এ ল্জ্জা তার পৌরুষের – বিশ্বাসের ভরা নদীতে হটাৎ প্রমাদ
বার বার ভাবে কি করবে, ভাবে থাক, প্রেমের শেষ চাঁদ।

একা থাকার দুর্নিবার ইচ্ছা অনেক গভীরে ছড়িয়ে -জড়িয়ে
ফুলের শয্যায় কাঁটার খোচা – আপদের সঙ্গ ছাড়বে কবে।


কবি পরিচিতি

বিভূতি দাস। অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক। জন্ম ১৪ই ফেব্রুয়ারী, অভিভক্ত ২৪ পরগনার কৃষক পরিবারে।

প্রকৃতির কোল ছুঁয়ে গ্রামে বেড়ে ওঠা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। ছাত্রাবস্থা থেকেই সৃষ্টির সাথে প্রেম। নেশা-লেখালিখি এবং ভ্রমণ। বর্তমান নিবাস – সোনারপুর, কলকাতা –৭০০ ১৪৯, ভারত।