কবি রুদ্রের নাম কবিতা
– মনোজ কান্তি বিশ্বাস
২১শে জুন ২০২৩, রুদ্রের প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি
একটি কবিতা বা গান একজন কবিকে লক্ষ যুগের তরে বাঁচিয়ে রাখে। অন্য লেখায় তাঁর জীবনদর্শন এবং জীবনের অভিব্যক্তি কে পাঠকের সামনে ক্রমশ প্রকাশিত করে। দিনে দিনে লেখার সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে আমরা আবিষ্কার করি পরিপূর্ণ একজন সমাজ সচেতন শিল্পী, কবি, দার্শনিক ও লেখককে। তারুণ্যসুলভ এ জাতীয় লেখায় পাঠকের মনে নেশা ধরাতে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর মাত্র দুটি লেখাই যথেষ্ট। ‘ভালো আছি ভালো থেকো আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখ’ এবং ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’। প্রথমটি গান যার ব্যাপ্তি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল ঘিরে। যে গানের ব্যঞ্জনা, জনপ্রিয়তা অপরিমাপ যোগ্য। যুগে যুগে মঞ্চ মাতানো কিছু গান আসে, আবার সময়ের বিবর্তনে সেগুলো কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ে। নতুন গান নতুন করে তার জায়গা দখল করে নেয়। কিন্তু অকাল প্রয়াত রুদ্রের ভালো আছি ভালো থেকো গানটির আবেদন কয়েক যুগ ধরে সব ধরনের মানুষের কাছে তুমুল আলোড়ন তুলে জনপ্রিয় হয়ে আছে। ছাত্র অবস্থায় রুদ্রের এই গান লেখা। গানের সুরকার কবি নিজেই। তবে সুর করার সময় মিঠেখালী গ্রামের বন্ধুরা কয়েকজন মিলে হাতে তালি ও বেঞ্চ বাজিয়ে গলায় সুর চড়িয়ে হৃদয় নিঙড়ানো আবেগে উৎসাহিত করতে মেতে উঠেছিলেন রুদ্রের সমকালীন সঙ্গীত অনুরাগী মিঠেখালীর কয়েকজন গুণী ব্যাক্তি। বিশেষ করে গোলাম মোহাম্মদ ও নাজমুল হক এ দু’জন ছাড়াও কয়েকজন মিলে গানের সুরটি গেঁথে সুরের ইন্দ্রজাল সৃষ্টিতে তালি বাজিয়ে, লেখক ও সুরকার কবি রুদ্রকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। এরপর একসময় দেশসেরা শিল্পীদের কণ্ঠে চলে আসে এ গানটি। ২০০০ সালে গানটি চলচ্চিত্রে সাড়া ফেলে দেয়। আগুন/এন্ড্রকিশোর/রুনা লায়লা প্রভৃতি শিল্পীদের কণ্ঠে ভিন্ন ভিন্ন সুরে গানটি ভিন্ন মাত্রা পায়। গানটির জন্য চলচ্চিত্রে শ্রেষ্ঠ গীতিকার হিসাবে ২০০৭ সালে মরণোত্তর সম্মাননা ও পুরস্কার পান। জনপ্রিয় এ গান আজ কবিগুরুর ভাষায় এ যুগের ‘সোনার ধান’। কবি নেই, কিন্তু কবির গানকে বাঁচিয়ে রেখেছে এবং রাখবে আগামী প্রজন্মের সঙ্গীত প্রিয় মানুষ ।
রুদ্রের গানটি তুলে ধরা হল-
ভাল আছি ভালো থেকো
-রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ
ভাল আছি, ভালো থেকো
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো
ভাল আছি, ভালো থেকো
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো
দিও তোমার মালাখানি,
বাউলের এই মনটা রে।
ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে।
আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে।
পুষে রাখে যেমন ঝিনুক
খোলসের আবরণে মুক্তর সুখ
পুষে রাখে যেমন ঝিনুক
খোলসের আবরণে মুক্তর সুখ
তেমনি তোমার গভীর ছোঁয়া
ভিতরের নীল বন্দরে
আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে
আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে।
ভাল আছি, ভালো থেকো
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো
ভাল আছি, ভালো থেকো
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো
দিও তোমার মালাখানি
বাউলের এই মনটা রে
ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে
আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে।
ঢেকে রাখে যেমন কুসুম
পাপড়ির আবডালে ফসলের ঘুম
ঢেকে রাখে যেমন কুসুম
পাপড়ির আবডালে ফসলের ঘুম
তেমনি তোমার নিবিড় চলা
মরমের মূল পথ ধরে
ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে
আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে।
ভাল আছি, ভালো থেকো
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো
ভাল আছি, ভালো থেকো
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো
দিও তোমার মালাখানি
বাউলের এই মনটা রে
ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে
আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে।
ঠিক তেমনি কিছু কবিতা লেখার পর স্বাধীনতা পরবর্তীতে ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’ কবিতা লেখার পরেও কবি তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। মুক্তিযুদ্ধের পর মানুষের মুক্তি অর্জন না হওয়া, মুক্তির চেতনা, স্বাধীনতার শত্রুদের অপ তৎপরতা, মানুষের অপমৃত্যু, মা বোনের সম্ভ্রমহানি প্রভৃতি বিষয় কবিকে ভাবিয়ে তুলেছিল। কবির মনোজগতে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। মানুষের চেতনার বৈপরীত্য এবং দ্বিধা কবিকে ব্যথিত ও মর্মাহত করে তুলেছিল। সমকালীন ভাবনার যথার্থ রূপায়ন এ কবিতায় লক্ষ্য করা যায়।
বাতাসে লাশের গন্ধ
-রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ
আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই
আজো আমি মাটিতে মৃত্যূর নগ্ননৃত্য দেখি,
ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভেতরে…
এ দেশ কি ভুলে গেছে সেই দু:স্বপ্নের রাত, সেই রক্তাক্ত সময়?
বাতাসে লাশের গন্ধ ভাসে
মাটিতে লেগে আছে রক্তের দাগ।
এই রক্তমাখা মটির ললাট ছুঁয়ে একদিন যারা বুক বেঁধেছিলো।
জীর্ণ জীবনের পুঁজে তারা
খুঁজে নেয় নিষিদ্ধ আধাঁর,
আজ তারা আলোহীন খাঁচা ভালোবেসে জেগে থাকে রাত্রির গুহায়।
এ যেন নষ্ট জন্মের লজ্জায় আরষ্ট কুমারী জননী,
স্বাধীনতা – একি হবে নষ্ট জন্ম?
একি তবে পিতাহীন জননীর লজ্জার ফসল?
জাতির পতাকা খামচে ধরেছে আজ পুরোনো শকুন।
বাতাশে লাশের গন্ধ
নিয়ন আলোয় তবু নর্তকীর দেহে দুলে মাংসের তুফান।
মাটিতে রক্তের দাগ –
চালের গুদামে তবু জমা হয় অনাহারী মানুষের হাড়
এ চোখে ঘুম আসেনা। সারারাত আমার ঘুম আসেনা-
তন্দ্রার ভেতরে আমি শুনি ধর্ষিতার করুণ চিৎকার,
নদীতে পানার মতো ভেসে থাকা মানুষের পচা লাশ
মুন্ডহীন বালিকার কুকুরে খাওয়া বিভৎস্য শরীর
ভেসে ওঠে চোখের ভেতরে। আমি ঘুমুতে পারিনা, আমি
ঘুমুতে পারিনা…
রক্তের কাফনে মোড়া – কুকুরে খেয়েছে যারে, শকুনে খেয়েছে যারে
সে আমার ভাই, সে আমার মা, সে আমার প্রিয়তম পিতা।
স্বাধীনতা, সে আমার – স্বজন, হারিয়ে পাওয়া একমাত্র স্বজন –
স্বাধীনতা – আমার প্রিয় মানুষের রক্তে কেনা অমূল্য ফসল।
ধর্ষিতা বোনের শাড়ী ওই আমার রক্তাক্ত জাতির পতাকা।
এই দুটি লেখাই কবিকে বিশ্ববিখ্যাত করে তুলেছে। তার মানে কবির অন্য লেখায় যে পরিচিতি আসেনি সে কথা আমি একবারও বলছি না। বরং শিল্পগত উৎকর্ষতায় কবির অন্যান্য অনেক রচনা এদুটিকেও ছাড়িয়ে গেছে। আমি বলতে চেয়েছি কবিকে জনপ্রিয়তা, খ্যাতির প্রথম পরশ এনে দিয়েছিল এই দুটি রচনা।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘অগ্নিবীণা’ কাব্য রচনার পর যদি আর কোনো কবিতা বা কাব্যগ্রন্থ নাও লিখতেন তাহলেও সাহিত্য জগতে তিনি অমর হয়ে থাকতেন। বিশেষতঃ ‘বিদ্রোহী’ কবিতার জন্য। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘ছাড়পত্র’ তেমনি বিখ্যাত কবিতা। তবে এমন পরিচিতি কম লেখকের ভাগ্যে ঘটে। এক একটি কাব্যগ্রন্থের যেমন নাম কবিতা থাকে যার মাধ্যমেই সমগ্র কাব্যগ্রন্থের পরিচিতি আসে। তেমনি একজন কবি বা গীতিকারের সমগ্র রচনার মধ্যে এরকম দু একটি নাম কবিতা থাকে যা মুহূর্তেই কবিকে পাঠক সমাজে পরিচিতি দিয়ে থাকে।
কিন্তু একজন কবির কাছে তার প্রত্যেকটি লেখা সমান মূল্যবহ। একজন পিতার কাছে তার সব সন্তানের গুরুত্ত্ব সমান তেমনি কবি সাহিত্যিকদের কাছেও সব রচনা বা কবিতার সৃজনের গুরুত্ত্ব সমান। প্রত্যেকটি লেখাই তাঁর মানসজাত সন্তান। তবে প্রত্যেক পিতা সমাজে পরিচিতি লাভ করে বড় সন্তানের মাধ্যমে। পাড়া প্রতিবেশি সকলেই বড় সন্তানের নাম ধরে বলে অমুকের পিতা। তার মানে যে তারা অন্য সন্তানদের কম মর্যাদা দেন তা মোটেই নয়। এখানেই কবির নাম কবিতার একটা ভূমিকা অবশ্যই আছে। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহকে তেমনি এক নামে চিনিয়ে দেয় তাঁর ‘ভাল আছি ভালো থেকো’ গান এবং ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’ কবিতা। কোনোদিন কোনো কারণে রুদ্রের রচনা সমগ্র যদি কালের কৃষ্ণ বিবরে হারিয়ে যায় তাহলেও পাঠক এবং শিল্পীর কণ্ঠ থেকে এ দুটিকে কেউ মুছে ফেলতে পারবে না। বরং যুগ যুগ রুদ্রের কবিতা, গান, গল্প অন্যান্য রচনা কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ কে অমরত্ব দান করবে।
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ






ভাল আছি ভালো থেকো – শিল্পী – এন্ড্রু কিশোর ও কনক চাঁপা
কবি পরিচিতি

মনোজ কান্তি বিশ্বাস। জন্ম ১৯৭৫ সালে খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার মাইটভাঙ্গা গ্রামে। বটিয়াঘাটা হেড কোয়ার্টার পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, বটিয়াঘাটা কলেজ থেকে এইচএসসি এবং সরকারি ব্রজলাল কলেজ থেকে বাংলা সম্মান সহ এম এ পাস। কর্মজীবনে একজন গবেষক ও স্বনামধন্য অধ্যাপক। গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ এর দুটি গবেষণার প্রজেক্টের সাথে। বর্তমানে কর্মরত আছেন বাংলা বিভাগের প্রভাষক পদে মোংলা উপজেলায় অবস্থিত মোংলা সরকারি কলেজ-এ ২০০২ সাল থেকে।
স্কুল জীবন থেকে কবিতা লেখার সূত্রপাত। কলেজে পড়াকালীন সময়ে কবিতা ও প্রবন্ধ রচনায় বেশকিছু পুরস্কার পান তিনি। এসময় বেশকিছু দৈনিক পত্রিকায়ও তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়। এছাড়া তাঁর লেখা কবিতার বই ও শিক্ষার্থীদের জন্য বইও প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে যুক্ত আছেন বিভিন্ন সৃজনশীল লেখা-লেখির সাথে। বেশি পছন্দ কবিতা পড়া ও লেখা। নদী, প্রকৃতি, ঋতুবৈচিত্র ও জীবনবোধের প্রকাশই তাঁর কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।