গোলাম রহমান – কবিতা (প্রেম নয় প্রেম বোধ, দেউলের গায়, শিউলি তলার বিভা, আগের মত ছবি আঁকতে চাই, জন্ম আমার আজন্ম পাপ)

প্রেম নয় প্রেম বোধ

– গোলাম রহমান

কোনো এক সুধাপ্রেমী এসে নিয়ে গেল মোরে
মরণের ওপারে কেতকী বধুর পাশে,-
শাওন মেঘের ভারে আঁচলে ঢাকিয়া মুখ
রয়েছে জাগিয়া সলিল সমাধি পরে;
কাহার বিরহে কাতর কবেকার বধূ সে যে
অস্তরাগের রেণু মেখে সেঁজুতি জ্বালায়ে
শূন্য পেয়ালা লয়ে হাতে রয়েছে দাঁড়ায়ে!

কোনো প্রেম নয় তবু প্রেম বোধ কাজ করে –
নেশার পেয়ালা ভরে রক্তিম চোখে দেখি
মলিন ধূসর কোনো এক প্রেমিকার মুখ
আজিকার নয় কত শতক-সহস্র
শতাব্দীর পুরানো কিংবা তাহারও বেশি;
ভারত সাগর পারে কিংবা ভূমধ্য সাগর
তীরে হয়েছিল দেখা একবার
তারপর ধূসর পাখির ডানা মেলে উড়ে গেছে
নীল সীমানায় কিংবা বিকেল সূর্যের মত
ডুবে গেছে সাগর সলিলে! ঝিনুক নিয়েছে তারে
গিলে পেটের ভিতরে, সেইখানে বাস তার
সলিল সমাধি তলে।

খুব বেশি কষ্ট হলে শাওন মেঘের দিনে
কেতকী বধুর সাজে ফিরে আসে নীপবনে
কিংবা রাতের শেষ প্রহরে ভোরের সূর্য
ফোটার আগে দেখা মিলে তার সাগর তীরে
বালুকার’পরে খোলা মুখ ঝিনুকের পেটে।

কোনো প্রেম নয়, তবু এক প্রেম বোধ কাজ করে –
সুরাপ্রেমীর শূন্য পেয়ালা ভরে মহুয়ার রসে
হারানো পুরানো সব প্রেমিকার মুখ ভাসে
কঙ্কালের খুলি সাদা দাঁত বার করে হাসে
বৈতালিক সুর বাজে তাহাদের হাড়ে!

কোনো প্রেম নয়, তবু এক প্রেম বোধ কাজ করে –
কবেকার কোন শেফালীর বুক থেকে তুলে আনা
জাফরান রঙ মেখে নেশার চোখে
শূন্য পেয়ালা লয়ে হাতে সুরাপ্রেমীর মতন
হেঁটে যাই বৈতরণী নদীটির দিকে …

দেউলের গায়

– গোলাম রহমান

আশ্চর্য সুন্দর রূপ নিয়ে তুমি
দাঁড়িয়ে এখনো কোনো ছায়ালোকে
দুই যুগ, দুইশ বছর কিংবা দু’হাজার
বছরের সেই তুমি অবিষণ্ণ অমলিন !

কত পাহাড় হয়েছে ক্ষয়, কত নদী হারায়েছে পথ,
বালিয়াড়ির তলায় কত সভ্যতা পেয়েছে লয়!
তিমির আঁধার ভেদি’ কার্তিকের ক্ষীণ চাঁদ
ঝুলে আছে মরা বাঁশ বনের মাথায়!
বিপন্ন সময় কেবল বিস্ময়ে চেয়ে থাকে
তোমার মুখের পানে; সেই অজস্র পুরোনো তুমি
যেমনটি ছিলে আশ্চর্য সুন্দর রূপ নিয়ে
দুই যুগ, দুইশ বছর কিংবা দুই হাজার বছর আগে!

সাগর ফেনার বুকে সময়ের পা ফেলে
ওরা সব চলে যায়, মুছে যায় ছাপ
কেবল তোমার রূপখানি নিয়ে
থেকে যাও তুমি অক্ষয় অনড়!

রাশি রাশি শিলা জ্যামিতিক রেখায় সাজায়
কোনো এক যুবা স্বপ্নের দেউটি জ্বেলে
বিজন বেলাভূমে মৌন মগ্নতায়;
কোথাও নেই কোনও ভাঙনের গান,
মৌন উচ্ছ্বাসে ভোরের সূর্য ভেঙে পড়ে
সবুজ পাতায়, ঘাসের ডগায়;
গানের পাখিরা সব পাখা মেলে দেয়
নির্মেঘ আকাশে সবুজ বাতাসে,
অমিত সৌন্দর্য লয়ে সময়ের ওপারে
কেবল দাঁড়ায়ে থাক তুমি দেউলের গায়!

শিউলি তলার বিভা

– গোলাম রহমান

সূর্য যখন ডুবে গেছে পশ্চিমে
হালকা আধাঁর ফুঁড়ে পুরানো মন্দিরের
পিছনে বিভা এসে বলে গেলো
কাল খুব ভোরে বকুল তলায় থেকো
আমি আসবো ।

পূব আকাশ ধবল হতে আমি যথারীতি
বকুল তলায়;
পাখিরা ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠল
কন্ঠে সুর তুলে পাখা মেলে
উড়ে গেল আকাশ থেকে আকাশে
সূর্য তখন নরম আলো
ছড়ায়ে দেখে নিলো আমাকে,
নরম আলো এখন আর নরম নয়
আমি বিভার প্রতীক্ষায়;
বিভা এলো না!

পুনর্বার দেখা হতে শুধালাম
বকুল তলায় আসলে না কেন?

‘বা-রে আমিতো ভোরে শিউলি তলায়
পূজার ফুল কুড়ালাম
কাল খুব ভোরে তুমি বকুল তলায় থেকো
পাখিরা জেগে ওঠার আগেই
আমি পৌঁছে যাব বকুল তলায়
আর ভুল হবে না, রাগ করো না লক্ষ্মীটি’!

যথারীতি আমি বকুল তলায় পায়চারি করছি
আজও বিভা এলো না।

সন্ধ্যায় মন্দিরের পিছনে হাল্কা আঁধারে
দেখা হতে শুধালাম – আজ কেনো এলে না?
বিভা বলল সাপের ভয়ে,
ঐ যে বাশঁবন ওখানে অনেক সাপ থাকে;
রাগ কর না লক্ষ্মীটি!
কাল ভোরে আমি বকুল তলায় বসে
তোমার জন্য মস্ত বড় মালা গাঁথব
বকুল ফুলের মালা; তুমি এসো কিন্তু!

আমি বললাম তোকে কোনো দিন আর
বকুল তলায় আসতে হবে না,
এখন থেকে প্রতিদিন মনসাদেবী আর
শিব পূজায় মগ্ন থাকবি
আর আমি হাস্নাহেনা ঝোপের নিচে
শুয়ে থাকব চুপটি করে রাতের বেলা
ফুলের ঘ্রাণে সাপেরা মাতাল হতে
প্রতিরাতে আসে ঝোপের নিচে।
জানিস তো – বেহুলা সুন্দরী
লখিন্দরকে বাঁচাতে পারেনি
সাপের ছোবল থেকে!

আগের মত ছবি আঁকতে চাই

– গোলাম রহমান

আমি আবার আগের মত ছবি আঁকতে চাই!
লাল পেড়ে শাড়ী জড়ায়ে সিঁথিতে সিঁদুর পরায়ে
বউ সাজাতে চাই!
আলতারাঙা কপোলে কালো তিল এঁকে
আরো অপরূপা করে তুলতে চাই!
বৈজয়ন্তী মালা পরায়ে গলায়ে
দেহবল্লরী সুশোভিত করতে চাই !
আমি আবার আগের মত ছবি আঁকতে চাই !

মেঘলা রোদের গায়ে রঙধনু রঙ এঁকে
তোমাকে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিতে চাই;
রিমঝিম বৃষ্টির ছোঁয়ায়
তোমার শরীরে শিহরণ জাগাতে চাই!
নদীর জলে বান ডেকে দুকূল ভেঙ্গে
সাগর সঙ্গমে মিলিয়ে দিতে চাই!
আমি আবার আগের মত ছবি আঁকতে চাই!

ছাই রঙা মেঘের গায়ে
ডানামেলা পরীর মতন
মনের সবটুকু মাধুরীমা মিশিয়ে
তোমার ছবি আঁকতে চাই!
আমি আবার আগের মত ছবি আঁকতে চাই!!

জন্ম আমার আজন্ম পাপ

– গোলাম রহমান

ওহে জন্ম! জন্ম আমার আজন্ম পাপ
তাই জন্মেছি আমি পৃথিবীর পথে
জীবের শ্রেষ্ট জীব মানব সন্তান!
বিশাল আকাশ সূর্য মহাকাশ
পৃথিবী মাটি বিশাল সিন্ধু জলরাশি
উহাদের মাঝে খুঁজিয়া পাই আমারে
আমি স্রষ্টার সৃষ্টি বিন্দুসম প্রাণ;
কীটের মতন যে কেবলই দলিত হয়
মথিত হয় জীবনের প্রাণের জন্য!
বাঁচিবার তরে আহা পৃথিবীর পথে
আলো ও আঁধারে কেবলি নিজেরে
মনে হয় এক ঘৃণ্যতম প্রাণীসম!

লভিয়া জনম ধরিত্রীর কোলে
করিয়াছি কী যে ভুল জানিলাম ধীরে!
দিনরাত পৃথিবীর পথে হেঁটে হেঁটে
উহারই দান শস্যদানা গিলে গিলে
বেশ বুঝিলাম চিনিলাম ঢের পরে
আমারে আমি, অন্ধকার কানা গলিতে
দেখিলাম চেয়ে পড়ে আছি আমি একা
পৃথিবীর নিকৃষ্টতম প্রাণী হয়ে!


কবি পরিচিতি

গোলাম রহমান। জন্মস্থানঃ বরিশাল।

বর্তমান নিবাসঃ ঢাকা, বাংলাদেশ, ফোনঃ ০১৭১০৮৯৫২৫০।