বিভূতি দাস – কবিতা (দু ফোঁটা অশ্রু দিও ধার, অন্তত এই টুকু থাক, গাঁয়ের বাছাদের কথা, চোখের পানি – মিরাক্কেল, জ্ঞান – বর্ণহীন)

দু ফোঁটা অশ্রু দিও ধার

– বিভূতি দাস

হাত ধরলে না, কথা হল না, জীবনটা দীর্ঘ ঊষর মাত্রা
প্রতিটা মুহুর্ত, যেন মহাজাগতিক কোন এক যাত্রা
খুঁজে না পাওয়া পথটা থেমেছে আশঙ্কা-অবিশ্বাসের বাঁকে
ফুল ফোটাবার মাটি হয়েছে ঊষর, কাঁটা ঝোপ ঝাঁকে ঝাঁকে
এখানে শীতল ছায়ার আকাল, নেই স্নিগ্ধতার ঝর্ণা ধারা
তবুও জীবন বয়ে চলে অবিরাম, বুক ছাপিয়ে সে দিক হারা।

স্বপ্নরা খোঁজে সুনীল আকাশে মিঠে রোদ কিমবা জোৎস্না ভরা
বসন্ত বাতাস খোঁজে নব যৌবনের খোলা জানালায় হাত-ধরা
দিগন্তে গাড় সবুজ-মন ভোলানো নীলের আঁচলে ভালোবাসা
মুঠো মুঠো মাল্লিকা-মাধবী ফুটুক প্রেমের ছায়াপথে নিয়ে আশা
হেমন্তের শিশিরে জাগুক হীরক শুভ্র প্রেমের ঝিকিমিকি
অধীর অপেক্ষায় সময় তাকিয়ে আছে, পথ যে এখনো বাকি।

ভেসে যাওয়া মেঘে যদি চাতকের মেটে পিপাসা
প্রেমের নোঙরে বাঁধা নাওয়ে ছোট ঢেউ ভাঙে সুপ্ত আশা
জীবনের মহার্ঘ্য দান – তৃষিত হৃদয়ে জাগে প্রেম-গান
নিরালায় বসে জোনাক আলোয় ভালোবাসা বাঁধে তান
তবুও কি ফিরে যাবে সখা মেখে বিষাদের ধুলো-ক্ষার
হাত বাড়ায়ে আছে প্রেম, অন্তত দু ফোঁটা অশ্রু দিও ধার।

অন্তত এই টুকু থাক

– বিভূতি দাস

ঢেউয়ের আঘাতে আঘাতে ক্ষয়ে যাওয়া বালির বাঁধ
গভীর ক্ষত নিয়ে আজো পড়ে আছে সকাল সাঁঝ
প্রতিটা দিন যেন এক প্রাগঐতিহাসিক সময়
মুখ থুবড়ে পড়ে আছে স্মৃতি – হয়ত নয় মনোময়।।

জীবনের ঘাটে ভেড়েনি এখনো পারের খেয়া
সচল দিনলিপি আপন ছন্দে -চলছে দেওয়া নেওয়া
নিয়মের বেড়াজাল – অগনিত ফাঁসের হাসা হাসি
তবু বয়ে চলে ধারা নিরবধি – হলেও তিক্ত-বাসি।।

সবুজ হারিয়ে জাগছে শীতল হলুদের আবরণ
কোটরে-বাসায় জীবন, ডানায় মুখ গুঁজে গোনে ক্ষণ
দুফোঁটা অশ্রুর গভীরতায় অবাক সুগভীর নির্বাক রাত
আশা বলে, কিছুই রবেনা তোমার, অন্তত এইটুকু থাক।।

গাঁয়ের বাছাদের কথা

– বিভূতি দাস

১.
বাৎসরিক পরিক্ষা শেষ ইসকুলে ইসকুলে
অফুরন্ত ছুটি – সময় কাটে বাউন্ডুলে
সকাল থেকে দুপুর – দুপুর থেকে রাত
পকেট ভর্তি কাঁচের গুলি, সময় কাটে খেলে
নদীর চর রাস্তা বা বাড়ির পাশের মাঠ।

২.
স্বাধীন ওরা – কেউ বকে না – কেউ ধরে না
ডাংগুলি আর ঘুঁড়ির লড়াই চলছে খোলা মাঠে
সবাই ওরা গাঁয়ের ছেলে, নেই দাবী, যখন যা জোটে
কোমর জলে – ধরছে যে মাছ ঠান্ডা-কাদা মেখে।

৩.
সবার আগে বিছানা ছাড়ে – খেঁজুর রসের লোভে
ধান বদলে গরম মুড়ি – সব চাদরের নিচে
ধানের গাদায় হেলান দিয়ে মনের সুখে খায়
রোদ পোহানো ভীষণ নেশা প্রতি সকাল বেলায়।

৪.
পাশের গাঁয়ের দরগা তলায় পীর সাহেবের মেলা
বসেছে সেথায় সার্কাস আর পুতুল নাচের খেলা
খেয়ে-দেয়ে দূপুর বেলায় – যে যার মত ভাগে
সব কটাতে মনের সুখে ফেরে মেলা দেখে।

৫.
সন্ধ্যা বেলা আগুন জ্বেলে ক্ষেতের আলু পোড়া
অমৃত সেই আলুতে তখন খুশীর গন্ধ মাখা
কেমন পোড়া – আধা কাঁচা সে নিয়ে নেই ব্যথা
আছে সবাই একই দলে – কেউ বা নাটের গোড়া।

৬.
হারিয়ে গেছে সেই সে বেলা – স্বপ্ন দেখার রোদ
সকাল হোলেই পোষাক পরে ছোটরে সবাই ছোট
কোথায় গেল পাখির ছানা কোথায় গাছের কুল
কসছে সবাই অঙ্ক এখন, তবু অনেকটাই তার ভুল।

চোখের পানি – মিরাক্কেল

– বিভূতি দাস

আহা বুড়ো মানুষটার কি অবস্থা
কি জানি বাবা, আমাদের কপালে কি আছে
উপর তলায় টিভির সামনে ছেলের বউ রিমোট হাতে তন্ময়
জগৎ সংসারের নিত্য ঘটা ঘটনার অভিনয় দেখে।

নিচের তলায় শাশুড়ি বাতের ব্যাথায় কাতর,
চাইছে গরম জলের রাবার ব্যাগটা – সেই সন্ধ্যা থেকে
কানে যাচ্ছে না টিভির শব্দে – হ্যাঁ করে গিলছে, বিমোহিত অভিনয়ে
যদিবা কানে যায়ও – বিড় বিড় করে, আর পারি না, রোজ জ্বালাচ্ছে।

সারাদিন বাদে, সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরে কর্তা বাজারের ব্যাগ হাতে
দরজার কড়া নাড়ে – প্রমাদ গোণে – মাঝে মাঝে এই যা–ই
সময় কাটে, পনেরো মিনিট বাদে – তোমার সময় জ্ঞানও বটে
সারাটা জীবন একই রকম – শান্তি দিলে না – আর কবে বুদ্ধি হবে।

নিস্পৃহ, অবাক দৃ্ষ্টিতে কর্তা তাকিয়ে থাকে – ভাবে কোনটা আগে
দরজা খুলে দিয়ে তর তরিয়ে উঠে যায় – বলে মিরাক্কেল শুরু হয়ে যাবে
বেচারা কর্তা, তেস্টা মেটায়, বাজার রাখে, জিজ্ঞাসে তুমি কি চা খাবে
উত্তর আসে, একটু মুড়িও দিও- এই টুকুইতো কর জিজ্ঞাসার কি আছে!

রাত দশটা, আরো একটা বাকি -এটাতো কচি প্রেমের, দেখেই উঠবে
বৃদ্ধা মাকে, খাবার, জল, ঔষধ সব দিয়ে আসে, খাবার গুছিয়ে খেতে ডাকে,
উত্তর আসে, জ্ঞান-গম্মি আছে! দেখছ না কি দারুণ জমে গেছে
কিছুই তো জানো না – একেবারে মায়ের কপি – আর কত জ্বালাবে।

জ্ঞান – বর্ণহীন

– বিভূতি দাস

নোঙর ফেলে নাবিক ক্ষনিক বিশ্রাম আশে
হলে সে অনাহারী কেহ না কেহ আসে বন্ধু বেশে
দুনিয়াদার সৃষ্টি করেছেন অনেক মন একই অবয়বে
কেন ভাব বন্ধু, হারাবে জ্যোতির রেবতী কৃষ্ণ গর্ভে।

সতী-অসতী কেবল ইহ জগতের ভাবনার ফসল
আসিয়াছে সৎ সংস্কারে মানবের মনে বিশেষ ক্ষণে
মহাজ্ঞানী সেই মহাজন লেখে নি এ সকল।

কর্ম করে মানবে ফুল ফল ধরে জীবন শাখায়
কখনো বা কীট দষ্টা হয়ে ঝরে যায় দেখি আগে
এ বিচার করিবে কে? ধরে নিই যদি সবি তাঁরি মায়ায়।

কালের নির্দেশে সবাইকে ছেড়ে যেতে হবে এ ভুবন
মানবের বিচারে হোলেও সতী বা মহাবলে বলীয়ান
একই আলো-পানী-বায়ু-দানার আতিতেয়থায় কিছুক্ষণ
মহাবিচারকের কাছে ছোট নেই, নেই বড়, সবাই সমান।


কবি পরিচিতি

বিভূতি দাস। অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক। জন্ম ১৪ই ফেব্রুয়ারী, অভিভক্ত ২৪ পরগনার কৃষক পরিবারে।

প্রকৃতির কোল ছুঁয়ে গ্রামে বেড়ে ওঠা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। ছাত্রাবস্থা থেকেই সৃষ্টির সাথে প্রেম। নেশা-লেখালিখি এবং ভ্রমণ। বর্তমান নিবাস – সোনারপুর, কলকাতা –৭০০ ১৪৯, ভারত।