শুক্লা বোস – কবিতাগুচ্ছ (হরিবালা, বাস্তবতার ঘেরাটোপ, কালচক্র, চিরন্তন, সম্প্রীতি)

হরিবালা

– শুক্লা বোস

হরিবালা, ঝালাপালা, খিদে জ্বালা ভারি,
বাটে-হাঁটে,পথে-ঘাটে, দিন কাটে তারই।
অবহেলা করে খেলা, ভাসে ভেলা পথে,
কণ্টকের ঘেরা ঘের, জীবনের রথে।

রূপরাশি গেছে ভাসি, নাহি হাসি মুখে,
দীন-হীন, বাজে বীণ আশাক্ষীণ দুখে।
আপামর, সবে পর, নাহি ঘর কোথা,
পায় যেথা থাকে সেথা, ঘোরে হেথা-হোথা।

বোধিসত্ত, পুত্র দত্ত, মদমত্ত হাতি,
হলাহলে কোলাহলে, দলে দলে মাতি।
লোভে নেয়ে, আসে ধেয়ে, পথে পেয়ে ফাঁকে,
দেহ পরে, চিরতরে,রক্তাম্বরে আঁকে।

অবসান,ঝরাপ্রাণ,হারা মান যেবা,
পড়ে থাকে পথবাঁকে, দেখে তাকে কে বা!
শয়তানে ময়দানে, রতি গানে ভাসে,
হরিবালা, মৃতমালা- সব জ্বালা নাশে।

বাস্তবতার ঘেরাটোপ

– শুক্লা বোস

আশার স্বপন ছিড়ছে আজি বাস্তবতার চাপে,
জীবন ঘেরা দুখের শাপে বারুদেরই তাপে।

পুড়ছে জীবন, ধুঁকছে মানব, কঠিন জীবন ধারা,
বাস্তবতার কাঠিন্যে আজ হৃদয় দিশাহারা।

ধনীর ঘরে ইলিশ ভাজা, গরীব ঘরে পান্তা,
নিরন্নতার অভিশাপে ধুঁকছে মজুর কান্তা।

অনেক কষ্টে শিখন শেখে দিনমজুরের ছেলে,
ঘুচবে বাপের দুঃখটি যে চাকরি একটা পেলে।

বেকার যুবক বেড়ায় ঘুরে, সুশিক্ষা তার গালি,
চাকরি চোরের বড়াই ভারি, ঘরে টাকার থালি।

আকাশছোঁয়া দ্রব্যমূল্য, মধ্যবিত্তের আশা,
বছর শেষে একটা ইলিশ! জমবে ভারি খাসা!

আশার স্বপন পোকায় কাটে, হাজার- দু’হাজারে,
আধা পোয়া চিংড়ি জোটে এই দামের বাজারে।

ওজন ভারি নীতিকথার, মঞ্চ কাঁপায় নেতা,
উঁচু গলায় আমজনতার দুঃখ ঘোচার কেতা।

নীতিহীন ওই বিবেকবোধে মাদকতার ছুরি,
জনগণের অর্থ লুটে করছে দেদার চুরি।

বাস্তবতার ঘেরাটোপে পাথরচাপা কান্নায়,
আশার স্বপন পোড়ায় দহন ছিন্ন মলিন বন্যায়।

কালচক্র

– শুক্লা বোস

কালচক্রে মহাকাল ঘোরে অবিরত,
চক্রব্যুহে ঘুরে মরি কেটে যায় বেলা।
বাল্য থেকে বার্ধক্যের হাসি কান্না মেলা,
কালের নিয়মে কাল চলে তার মত।
পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে অভিনেতা যত,
পিতা-মাতা, ভ্রাতা-ভগ্নি সম্পর্কের খেলা।
হাসি-কান্না, সুখে-দুখে ভাসে স্বপ্ন ভেলা,
জীবনের নাট্যমঞ্চে অবিরাম ক্ষত।

কত না যতনে চাই সাজাতে জীবন,
আবাল্য গ্রন্থিত স্বাদে ছুটে চলে মন।

মরণ লিপিকা লেখা জীবনের ভ্রূণে,
যবনিকা পতনের আসন্ন সকাল।
ক্ষণস্থায়ী সুরাপানে চলা কাল গুণে,
শেষ পরিণতি টানে সেই মহাকাল।

চিরন্তন

– শুক্লা বোস

শেষ ফাগুনের ছড়ানো আবিরে বিদায়ের ব্যথা বাজে,
বিষাদের বাণী ওঠে রণরণি দুখ ভরা প্রাণে রাজে।
ঝরাপাতা গানে মর্মর তানে বুকেতে কথার জ্বালা,
নিশি দিনমান ঝরে অবিরাম বেদনার গাঁথা মালা।
বসন্ত প্রীতি, সুমধুর গীতি যায় কি গো তারে ভোলা,
শুধু অনিবার ঘেরে চারিধার চুপি চুপি দেয় দোলা।
বিকশিত সেই রক্ত ফাগুন গুলালের লালে লাল,
সে অতীত স্মরে, ফিকে রঙ ধ’রে ম্লান শিমুলের গাল।
রক্ত কুসুম লুটায় ধুলায় বিবর্ণ মলিনতা,
বুকে দোলে তার ধূলি মাখা হার, আশাহারা ব্যাকুলতা।
চৈতি হাওয়ায় প্রহর জাগায়, ডাহুকের ডাক ম্লান,
পথ মাঝে পড়ে ধূলি ঝড়ে ওড়ে, ঝরা পাতাদের গান।
ফোটে নাকো কলি আসেনাকো অলি, রিক্তের হাহাকার,
অতীত বারতা স্বপনের কথা মনে জাগে অনিবার।
চৈতালি তাপে দহনের ভাঁপে ঝরে অবিরত গ্লানি,
ভুবনের পথে নিয়মের রথে মহাকাল রচে বাণী।
যাবে পুরাতন ফেরাবে নতুন, নিয়তির খেলাঘরে-
ঝরাপাতা শাখে সবুজের হাসি নব কিশলয় পরে।
রজনীর বুকে হাসে মহাসুখে প্রভাত আলোক রাশি,
মরণের পরে জীবন বাসরে বাঁচার আশার হাসি।

সম্প্রীতি

– শুক্লা বোস

শাওয়ালের চাঁদ উঠেছে গগনে
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ সিয়াম সাধনা শেষে,
এসেছে রে ঈদ, ভেঙেছে রে নিদ্
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ আয় তোরা ভালোবেসে।

নতুন পোশাকে ঈদের খুশিতে
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ আজ সবে মাতোয়ারা,
নবীন-প্রবীণ, যুবক-বৃদ্ধ
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ প্রাণে প্রাণে জাগে সাড়া।

ধনী গরিবের নেই ভেদাভেদ
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ সবে মিলে সম্প্রীতি,
নামাজের শেষে কোলাকুলি হেসে
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ হৃদে আনন্দ গীতি।

ভজনে-ভোজনে আপ্যায়নে
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ সবে খাবে ভালো-মন্দ,
ঈদের খুশিতে সকলেই মাতে
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ নেই ভেদাভেদ দ্বন্দ্ব।


কবি পরিচিতি

শুক্লা বোস। মোংলা অঞ্চলের জ্ঞানের প্রধান বিদ্যাপীঠ শেলাবুনিয়ায় অবস্থিত সেন্ট পলস্ উচ্চ বিদ্যালয়-এর স্বার্থক ও কৃতি শিক্ষিকা। সুদীর্ঘকাল শিক্ষকতার পর শিক্ষার্থীদের প্রাণপ্রিয় এই শিক্ষিকা মার্চ ৪, ২০২০সাল থেকে অবসরে আছেন।

ছেলেবেলার থেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, জীবনানন্দ দাশ সহ বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য প্রথিতযশা কবি ও সাহিত্যিকদের লেখার সান্নিধ্যে বেড়ে উঠেছেন। কখনও কখনও লিখেছেন আত্মার সন্তুষ্টির জন্য। আত্মপ্রচারে বিমুখ হওয়ায় নিজের ভিতরেই রেখেছেন নিজেকে – তেমনভাবে বাইরে প্রকাশিত হয়ে ওঠা হয়নি।

বর্তমানে অবসর জীবনের একঘেঁয়েমি কাটিয়ে জীবনযাত্রায় কিছুটা ভিন্নতা ও বৈচিত্রের ভিতর দিয়ে সময় কাটানোর জন্যই বেছে নিয়েছেন বই পড়া ও লেখালেখিকে। সাহিত্যের মাধ্যমে মানুষের আত্মশুদ্ধি হোক, মানুষ সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠুক – এই প্রত্যাশাই তার ভাবনায় জীবন জুড়ে বিকশিত।