পরাণের লক্ষ্মী
– বোরহানুল ইসলাম লিটন
ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ কেটে যায় পরাণ মাঝির নাও,
পাল যে বিষম টান হয়েছে লেগে পূবাল বাও।
যাত্রীরা আজ আসছে দলে হচ্ছে ভাড়া ঢের,
খ্যাপ নিয়ে তাই এপার-ওপার চলছে ধেয়ে ফের।
দেখলো সে বেশ স্বচ্ছ আকাশ হাসছে তাতে সূর,
গাইছে দু’পাড় পাখ-পাখালি বৃক্ষে সুমধুর।
ভর যৌবনা জল নেচে তার তুললো মনে ঝড়,
স্মৃতির পটে আঁকলো সে এক ছোট্ট নিবিড় ঘর।
হাসছে যে তার লক্ষ্মী রাণী সেই ঘরে আজ বসি,
উচ্ছ্বাসে ঢের খড়ের চালে পড়ছে তারা খসি।
চতুর্দিকে ফুল ফুটে তা দেখতে করে পালা,
ঝির ঝিরে বায় সুবাস দিয়ে চলছে গেঁথে মালা।
ঝাপটায়ে পাখ ডাহুক ডেকে বাঁশির সুরের মতো,
ধারার বুকের রুক্ষতা সব মুছছে অবিরত।
চাঁদ উঠে সেই নিশির বুকে জ্যোৎস্না দিয়ে ঢেলে,
আবেশ ছুঁড়ে লাজ বদনে তুলছে আশা জ্বেলে।
দৃশ্য স্মরে খুব খুশি আজ পরাণ মাঝির মন,
নায়ের তালে গুণছে সে তাই রূপ সায়রের ক্ষণ।
আনমনে ফের বললো শুধু ‘লক্ষ্মী রে তুই জান,
আর ক’টা দিন কর না সবুর বুনবো মোরা ধান!’
ঘর হবে এই ভাড়ার টাকায় থাকবে তাতে সুখ,
করবো তোরে প্রেম সোহাগী রোজ কেড়ে সব দুখ।
নিস দেখে তুই ঠিক পেয়ে তা করবে নিশি ধুম,
এহেন কালে হুট করে তার ভেঙে গেলো ঘুম।
তারেই করো হেলা!
– বোরহানুল ইসলাম লিটন
নদীর ঢালে একলা রচে আউলা মেঘের প্রীতি,
মানছি তুমি ঘাঁটতে পারো ভাঙা বুকের স্মৃতি!
তবু কি তার কণ্ঠ বিনে
রোখ তুলে হোক একশ’ তিনে
ভাবতে পারো খুব সুদিনে ঘুরছে তালে ক্ষিতি?
মানছি তুমি ঘাঁটতে পারো ভাঙা বুকের স্মৃতি!
পানসি নায়ের বৈঠা ফেলে সিন্ধু থেকে দূরে,
হয়তো পারো পঙ্খি সেজে চান্দে যেতে উড়ে!
না পেলে তার আঁখির জ্যোতি
শান্ত রেখে ব্যাকুল মতি
তাই বলে কি চাইলে অতি গাইতে পারো সুরে?
হয়তো পারো পঙ্খি সেজে চান্দে যেতে উড়ে!
ইচ্ছে মতো ধন বা জনের ভাণ্ডে যেচে গিরি,
ভাবতে পারো ’আমার ভুবন শ্যামলা বাটের সিঁড়ি!’
স্নিগ্ধ হাসি না দেখে তার
যতই সাজো দেব অবতার
দেখতে পারো টান করে ঘাড় বঙ্গ মাতার ছিরি?
ভাবতে পারো ’আমার ভুবন শ্যামলা বাটের সিঁড়ি!’
চুপটি রেখে ঝোপের আড়ে ষণ্ডা বুকের বেলা,
তেষ্টা পেলেই ক্যান তবে ভাই তারেই করো হেলা?
জানটা ভেবে দোআঁশ মাটি
কও না রেখে পরিপাটি
সে বিনে হয় চিত্ত খাঁটি কিংবা সুখের খেলা?
তেষ্টা পেলেই ক্যান তবে ভাই তারেই করো হেলা?
সমানে সমান
– বোরহানুল ইসলাম লিটন
এখনও তোমাকে দেখি টলটলে খালে
লহরির সাজে কেশ মৃদু বায়ে দুলে করে খেলা,
লাজুক বদনে জাগা শাপলার হাসি
শালিকের ডাকে গড়ে চুপি চুপি ফাগুনের বেলা।
কচুরী পানার ফুলে পেয়ে জেদি আঁখি
ভীষণ অবাক হয়ে পাশে দেখি হংসের কেলি,
বাঁকি যা বলার ছিলো শুনবার আশে
আহত জবান খুঁজি
দল বেঁধে উড়ে গেলে বলাকারা সাদা ডানা মেলি।
হেরে যায় অবশেষে চির চেনা ক্ষণ,
বুকের পাঁজরে ক’টা হলদেটে ঘাসে
নীরবে যখন নামে ফোঁটা দুই হিমের মতন।
অটল পাহাড় সেও ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়,
প্রবল আষাঢ়ে নদী দেখে সেই দশা
কাতরে নোঙর ফেলে টলে পড়ে স্বীয় মোহনায়।
’এভাবে বয়েছে কেউ অবাঞ্ছিত ব্যথা!’
বুঝেও যদি বা থাকো করে এই ঝড়ো অভিমান,
হয়তো হলেও আমি শরতের কাশ
দেবো না মেঘেরে জ্যোতি হতে দোঁহে ‘সমানে সমান!’
হাফ বোকামির গাড়ি
– বোরহানুল ইসলাম লিটন
নিত্য নতুন শীষ দেখে বিশ
ভাবলো বোকা চাষী,
এমনি করে বাড়লে তো রোজ
ফলন হবে আশি!
রুখবে কে এই হাসি?
মূল না চিনে খুশির ঠ্যালায়
র কি দিলো পানি!
চললো বলে এ’ গাঁও ও’ গাঁও
হাউ ফানি! হাউ ফানি!
টানছে তখন ফুল পাতা ধড়
নষ্ট তিলের ঘানি।
হায় এ কি মানহানি!
কাল করে ক্ষয় ক্লান্ত রথে
ফিরলো যবে বাড়ি,
ভূঁই তো র’লো আগের মতোই
’কই ফসলের সারি?’
বুঝলো গেছে সব নিয়ে তার
হাফ বোকামির গাড়ি!
আমি আর আসবো না ফিরে!
– বোরহানুল ইসলাম লিটন
জমলে শালিক এসে মায়াবিনী বাটে,
মাতবে ছোটুর দল টলটলে ঘাটে।
ফড়িঙের ভীরু মতি
সাজবে হাঁসের পতি
তবু না গাইলে তুমি শ্যামলা এ’ তীরে –
আমি আর আসবো না ফিরে!
ব্যাকুলে নিজেরে পেতে বকুলের ছায়,
জানি গো কাঁদবে মন দখিনা হাওয়ায়।
শাপলার হিম আঁখি
দিবে বুকে স্নেহ মাখি
বুঝেও না র’লে মেঘ তোমাকেই ঘিরে –
আমি আর আসবো না ফিরে!
উঠবে খুশিতে নেচে লহরির দেল,
পাকুড়ের আড়ে গেলে সোনালী বিকেল।
ধবল বকের সারি
উড়ে যাবে তাড়াতাড়ি
দেখে তা না স’লে তুমি বেখেয়ালে পীড়ে –
আমি আর আসবো না ফিরে!
টুপ করে মাছরাঙা ধরে এক মাছ,
লগিতে ফেলবে জানি বলিহারি শ্বাস।
ছুটুক ছাগল ছানা
অযথা রচে বাহানা
তোমায় না দেখে যদি থামে ধীরে ধীরে –
আমি আর আসবো না ফিরে!
ক্লান্ত দিনের কাজ বুকে নিয়ে যতো,
নামবে সোহাগী সাঁঝ ফি-দিনের মতো।
বাড়াতে ঝোপের খ্যাতি
জ্বালবে জোনাক বাতি
না র’লে সেখানে তুমি আশা ভরা নীরে –
আমি আর আসবো না ফিরে!
কবি পরিচিতি

বোরহানুল ইসলাম লিটন। শিক্ষাগত যোগ্যতা এম, এ (প্রথম পর্ব)।
কবির জন্ম ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট বাংলাদেশ, নওগাঁ জেলার অন্তর্গত আত্রাই থানার ’কয়েড়া’ গ্রামের সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে। পিতা মরহুম বয়েন উদ্দিন প্রাং ছিলেন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও মাতা মরহুমা লুৎফুন নেছা গৃহিণী। বর্তমানে তিনি একই থানাধীন ’পাঁচুপুর’ গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন।
স্কুল জীবন থেকেই কবি সাহিত্যানুরাগী মানুষ। প্রকৃতির হাসি অন্তরে পুষে বড় হয়েছেন গ্রামীণ পরিবেশের শীতল ছায়ায়। প্রিয় সখ বই পড়া ও লেখালেখি। ছড়া, কবিতা, গীতিকাব্য ও অনুগল্প মিলে তার লেখার সংখ্যা প্রায় দুই হাজার এর মতো। বর্তমানে তিনি বিভিন্ন ওয়েব সাইটে নিয়মিত লিখে চলেছেন।