বিভূতি দাস – কবিতা (উৎস সন্ধানে, দানব, বিপন্নতা, প্রতিষেধক, থাকতে পারে)

উৎস সন্ধানে

– বিভূতি দাস

খুব বেশিদিন নয়, এইতো মাত্র হাতে গোনা কয়েকটা মাস আগে
নানা কথায় উপদেশে দেশ বিদেশে চলছিল বেশ গরমা গরম কলরব
কাটা ছেঁড়ায় যুক্তি তক্কে কে কাকে ছাপিয়ে যাবে পাল্লা দেওয়া হল্লা সব
ধরতে বললে বেঁধে আনার জাল ফেলতে কোমর কষে জ্ঞানী গুণীর দল
জল মাপতে গোয়েন্দা কুলে জোয়ার লাগে, ঠান্ডা ঘরে রাষ্ট্র নায়কদের ঢল
সুতো ছিঁড়ে সূত্রের খোঁজে নতুন দড়ির পাক, নীল নক্সায় সম্ভবনাময় দাগ
নেটিজেনদের মুঠোয় ধরা প্রমাণ প্রলাপ, সবিস্তারে ধর্মাধর্ম জ্ঞান ওষধির ভাগ
নতুন দিনের ম্যানেজমেন্টে হাইপ্রোফাইল যুক্ত হোলো, বিজ্ঞাপনে বিকেন্দ্রীকরণ
কে করবে বাজার দখল, কার কতটা অগ্রগতি, চোখের সামনেই বিবরণ
তবে কি চিচিং ফাঁকের দরজা খুলে লক্ষ্মী এলেন ঠান্ডা ঘরে, ভাগে ভাগে!

আদিম সভ্যতার কথা বাদ থাক, কারণ তখন উদর পুরনই ছিল মুখ্য ভাবনা
যা কিছু কর্মকান্ড সবই ছিল বাঁচার তাগিদে, লক্ষ্মীর কথা জানাই ছিল না
সময় থেমে থাকেনি, পরিবর্তনের অবিরাম স্রোতে তীক্ষ্ণ হয়েছে অভিজ্ঞতা
কালের বহু ভাঙা গড়া ইতিহাসের সাক্ষী হয়েছে, ধীরে দীপ্ত হয়েছে মেধা
কাজে লাগিয়েছে তার অনেকটাই সভ্যতার কল্যাণে, কিছুটা ক্ষমতার লোভে
তবুও এমন নগ্ন অসভ্যতার চিহ্ন নেই ইতিহাসে, যেখানে তাবত বিশ্ব স্তব্ধ শোকে
মানুষের সমস্ত ভাবনা করে দাও একমুখী, বন্ধ করে দাও শিক্ষার দরজা
পূঁজির আস্ফালনে স্তব্ধ করে দাও বাঁচার লড়াই, বদ্ধ কূপে চলুক যাপনের তরজা
মানুষ বাদে আর সব কিছু থাক অক্ষত, ধীরে পঙ্গু করে দাও সকল শুভ চেতনা
পুঁজিই ঠিক করবে আগামীর আবেগ জন্ম মৃত্যু, নিখুঁত স্ট্রাটেজি, মনে হয় না!

তরঙ্গের পর তরঙ্গে বিধৌত পৃথিবীর তটভূমি নির্বিকার, কিছু খড়কুটো ভেসে যায়
হৈচৈ হয় – গেল গেল রবে ক্ষণিক অথবা সময়ের আবহে মাত্র কয়েকটা দিন
শোকের চেয়ে অবচেতনে নিজেকে সুস্থ রাখার প্রয়াস নয় নিতান্ত যুক্তিহীন
চক্রান্তের উৎস সন্ধানে দুনিয়ার নামী গোয়েন্দার দল নিশ্চয়ই করবে সমাধান
আশা ছিল, সাধারণ মানুষ ভেবে ছিল শতাব্দীর ঘৃণ্য দুর্যোগের হবে অবসান
কিন্তু সাধারণের জানা ছিলনা বিজ্ঞান আজ পূঁজির পৃষ্ঠপোষক, পুঁজিই সবের নিয়ন্ত্রক
রাজনীতি, সমাজ, ধর্ম ভাবনা সবই পূঁজির অধীন, পূঁজির নির্দেশ নয় নিরর্থক
গতানুগতিক রাস্তায় পূঁজি বৃদ্ধির হার সঙ্কুচিত, নতুন পথের সন্ধানই পূঁজির ধর্ম
বেশি মানুষের জন্য যা কিছু অমঙ্গলের সুচক, পূঁজির বৃদ্ধির পক্ষে তাই সুরক্ষিত বর্ম
দুনিয়ার তাবত সমীক্ষা, উদ্ভাবন, নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অক্ষে পূঁজির নির্দেশই শেষ কথা
শুনতে যতই খারাপ লাগুক প্রজনন থেকে মরণ অবাধ বিচরণ, কোথাও নেই বাধা
আক্ষরিক নয়, সভ্যতার শ্রেষ্ঠ শত্রু পূঁজির সামনে নতজানু মানুষ, জীবন ভিক্ষা চায়।

দানব (ট্রায়োলেট)

– বিভূতি দাস

মানুষের অস্থিতে এত রস! ছিলো কি জানা আগে?
দানবীয় লোভের অট্টহাসি, ডলারে ফলার, বিনিয়োগ রাশি রাশি
গোপন চুক্তিতে লাশের অঙ্কে লাভের হিসেব শতকরা ভাগে
মানুষের অস্থিতে এত রস! ছিলো কি জানা আগে?
যৌথ খামারের দানব, বিশ্ব খামারে বারবার রূপ বদলায়
পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা ভিন গ্রহের মাটিতে! সহস্র ধিক, ছিঃ বিশ্বাসী
মানুষের অস্থিতে এত রস! ছিলো কি জানা আগে
দানবীয় লোভের অট্টহাসি, ডলারে ফলার, বিনিয়োগ রাশি রাশি।

বিপন্নতা

– বিভূতি দাস

এই শব্দটির কোন ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয়নি কোনদিন
হয়ত বা হবেও না সময়ের কোন ধাপে, মাপে বা সরণিতে
যখন যে প্রাণের কাছে আসে, লিঙ্গ বর্ণ ধর্ম নির্বিশেষে
অক্টোপাশের মত জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গনে শুষে নেয় জীবন
কখনো ব্যক্ত, কখনো অব্যক্ত পরিসরে সামগ্রিক মনন
ভীষণ দাবানলের সাথে যেমন বাতাসের সখ্যতা চিরকালীন।

মানুষ সময় গোনে সন্তর্পণে, তবুও ফাঁক গলে এসেই যায়
কিছুই বোঝা যায় না আগে, কখন কিভাবে সে আসে
নিঃশব্দে; অজান্তে দহনের ছোবলে বিদীর্ণ অন্তর জ্বলে
হয়ত কারো অভিজ্ঞ চোখ বুঝতে পারে তার দীর্ঘ ছায়া
হাসিতে, বাহ্যিক প্রসাধনে, ঢাকা থাকে না অদৃশ্য বিষ কায়া
আবেগের মাঠ চৌচির গোপনে, বিপন্ন মন কেবল সময় কাটায়।

ঝাপসা চোখে চেয়ে থাকা, অতীতের পাতা উল্টে দেখা
চোখে পড়ে না ব্যাতিক্রম, অসময়ের শিশিরে ভেজে চোখ
শব্দ পরমানুর বিকিরণ, তেজস্ক্রিয় আগুনে লেখা তোমার দায়
খুঁজে পাও বা না পাও, মানতে হয়, ভার লাঘবের আশায়
যুক্তি বুদ্ধি বিবেচনা বিকলাঙ্গ, অদেখা নিয়তির পাঠশালায়
হারানো সময় ফেরে না, চোখে মুখে বিপন্নতার ছায়া মাখা।

প্রতিষেধক

– বিভূতি দাস

প্রতিষেধক যদি না হয় উপযুক্ত, ব্যারামে আরাম দুর-অস্ত
যতই বলো শিক্ষা মানবতার কথা, খোঁয়াড়ের ভাবনা যায় না
বাড়তেই থাকে কোষে কোষে, পিছে সহস্র শয়তানী প্রেরণা
ধার করা অভ্যাসে রুচিশীল, না থাকলেও নূন্যতম ধারণা
জ্ঞান অনেক দূরের জিনিষ, আক্ষরিক অর্থও নেই জানা
মুখে মুখে আওড়াই বুলি, জাবর কাটি, না বুঝেই মর্মার্থ ।

রাখালের মুখে স্বর্গের বাণী, ঝাঁপাই জাহান্নামে, বর্ণান্ধ মণি
সময়ের সাথে স্বার্থের ফাঁদে বদলেছি পোশাক, নয় মন
বিদ্বেষ ব্যারামে খুঁজে তৃপ্তি অহরহ, যাপনে মাছির জীবন
নিজের যা নেই অন্যের কেন থাকবে, উড়ে রাতের ঘুম
নানা অছিলায় বিভীষণ রণে জাগে, আলো নেভানোর ধুম
আসুরিক ভাবনায় লড়াই অহরহ, আপন ছায়ায় শেল হানি।

অযুত সময় পেরিয়ে এসেও, বুঝিনি আলোই জীবনের সার
আলো ছাড়া সভ্যতা, সমাজ, জীবন সবই নিকষ অন্ধকার।

থাকতে পারে

– বিভূতি দাস

থাকতে পারে, তোমার আমার মতান্তরে ফালতু কিছু বিষয়
কাজে লাগে না, তবুও আঁকড়ে থাকা এটাই কি কারণ নয়
যদিও জানি এসবই মূল্যহীন, কারণ তুমি আমি একই কায়া
আলোর বিপরীতে দুই আধারেই পড়ে বেঁটে লম্বা কালো ছায়া।

জন্মের জন্য কেউ দায়ী নয়, সব্বাই তো মায়ের কোলেই আসি
মাতৃ সুধা পান করে একই ভাবে বেড়ে উঠি, আনন্দে হই খুশী
চাহিদা এক, ব্যথা এক, ভালবাসার ধরণও এক, তবুও কেন হয়
যুক্তিহীন ভাবের ঘোরে মনের মাঝে রনং দেহি কুট-কচালি নয়!

থাকতে পারে, তোমার চাওয়ায় আমার চাওয়ায় কিছু এদিক ওদিক
প্রকৃতিতে সকল প্রাণেই মেলে এমন যৌগের হদিশ, এটাই সঠিক
তলিয়ে দেখলে খুঁজে পাবোই তথ্য, মতান্তরের আসল কারণ কোথায়
খাবার খানায়, গান গানায়, বুঝতে হয় অসুবিধা অনুভবের স্বল্পতায়।

পোশাক; খাবার; রীতি-নীতি সময় ভেদে, স্থান ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়
যোগান অনুযায়ী; প্রয়োজনে তুমি আমিই ঠিক করেছি, অন্য কিছু নয়
ভিন গ্রহের কেউ আসেনি, দেয়নি কোন আদেশ, থাকতে পারে মতান্তর
স্থিতাবস্থায় শান্ত মনে খুঁজে দেখলে, সব মিলে যাবে, উত্তর দেবে অন্তর।


কবি পরিচিতি

বিভূতি দাস। অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক। জন্ম ১৪ই ফেব্রুয়ারী, অভিভক্ত ২৪ পরগনার কৃষক পরিবারে।

প্রকৃতির কোল ছুঁয়ে গ্রামে বেড়ে ওঠা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। ছাত্রাবস্থা থেকেই সৃষ্টির সাথে প্রেম। নেশা-লেখালিখি এবং ভ্রমণ। বর্তমান নিবাস – সোনারপুর, কলকাতা –৭০০ ১৪৯, ভারত।