সুমিত্র দত্ত রায় – কবিতা (কৃষক, আশংকা,অশ্লীলতার দায়ে, ঘুম ভাঙানিয়া)

কৃষক

– সুমিত্র দত্ত রায়

কৃষক সম্প্রদায়ের একজন,
নাম নিয়ে চিন্তা নেই,
পরিচয়ে নেই ইতিহাস।
শুধু বলা যেতে পারে –
আজ সকালে;
ভোরের সূর্য ওঠার আগে,
ধানের ক্ষেতের ঐ ধারে,
পঁচা জঞ্জাল ছাড়িয়ে কিছু দূরে,
ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় পড়ে ছিলো,
আজ সকালে।

সবাই বললো,
বেশ কিছু আগেই
ও নাকি জীবনের সাথে
শেষ চুক্তি মিটিয়ে ফেলেছে।

দোষ যে ওর ছিলো না-তা নয়।
জোতদারের প্রাপ্য টাকা ঠকিয়েছে,
বলেছিলো দশজনের হয়ে,
“আমাদের রক্তে চষা জমি,
দেহ নিংড়ানো শ্রমে
ঘাম ঝরানো ধান আমাদেরই,
আমাদের …শুধু আমাদের. ..।”

সেই লোকটাই,
জন্মলগ্নে পেয়েছিল পৈতৃক ঋণ-
আর অসংখ্য শঙ্খধ্বনি ,
অন্নপ্রাশনে পেয়েছিলো,
দেনা নির্মিত-সামান্য অনুষ্ঠান।
এইভাবে বয়স বাড়ার সাথে সাথে,
কখনো রোগের দুঃখে,
কখনো ভোগের আনন্দে,
ঋণের বোঝা বেড়েই চলেছিলো,
একদিন জমি গেল।

কিন্তু তবু পথে নামলো না।
মহান মহাজনের অসীম করুণা,
নতুন এক ভাগচাষী জন্মালো,
মাথা বিক্রীত, এক কথায় ক্রীতদাস।

কখন গোপনে,
মনে ঝড় উঠেছিল কে জানে?
জনস্রোতে হাত মেলালো সে,
শত্রুদের চিনতে শিখলো,
করতে শিখলো-
জোতদারের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ।
জমাট বাঁধা ঘৃণা আর ক্রোধে,
শানিত করলো মন-তলোয়ার।
একসাথে সবাই মিলে
ঘোষণা করলো অসহযোগিতা।

হয়তো বা বিদ্রোহ কিংবা বিপ্লব।
মোটের উপর-
বৃক্ষ রোপিত হলো একটা,
যত্নের দায়িত্ব নিলো অনেকই।

কিন্তু আজ সকালে-
নিশ্চিন্তে বলা যেতে পারে,
শুধু একজনকে,
বৃক্ষের রক্ষা দায়িত্ব থেকে-
মুক্তি দিলো ওরা।
আজ সকালে।

যখনো রাত পরিস্কার নয়,
বোঝা যাচ্ছে না সূর্য উঠবে কিনা,
চারদিক কুয়াশাচ্ছন্ন,
তেমনি সময়-
জীবনের শেষ ইংগিতে-
একটা তারা খসে গেল।
আজ সকালে।

ওরা কারা? কে করলো এ কাজ?

“কেহ..বা..কাহারা …
বিশেষ তদন্ত চলিয়াছে। “

আশংকা

– সুমিত্র দত্ত রায়

ডাঙায় বাঘ
আর জলেতে কুমির
চিন্তা তো নেই
তাই সুন্দরী নাচছে।

কিন্তু মানুষ!
ভীষণই ভয়ংকর,
তাই মানুষের ভয়ে
সুন্দরী কাঁদছে ।

অশ্লীলতার দায়ে

– সুমিত্র দত্ত রায়

অশ্লীলতার দায়ে
ধরা পড়ার থেকে আপাত নিস্কৃতি
পারস্পরিক সমঝোতা বৈবাহিক বন্ধন।
কিন্তু তারপর?

নুন আনতে পান্তা ফুরােয় প্রায়
মাসিক আয় টেনেটুনে চার ঘর
চিন্তার সীমা যার পর নাই উঁচু
ফলবশত –

থিয়েটারের প্রশ্ন সিনেমায় হাজির,
তারও পরে, যাত্রা দেখবে বিনে পয়সায়
তবে দুটাকা পেলে বাদাম খেতাম।

ধীরে ধীরে ছেলের পেটে ব্যামো
দেখ একটু চিকিচ্ছে করাও,
হোমিওপ্যাথিই না হয় করো।

এই ভাবে পাকা বাড়ি
চুন খসা রঙ চটা
ভিত আলগা ধ্বসে পড়া।

কিন্তু তবুও ,
অশ্লীলতার দায়ে …।

ঘুম ভাঙানিয়া

– সুমিত্র দত্ত রায়

বালিশে মুখ গুঁজে শুধু ঘুমোচ্ছো,
অবসাদ তোমাকে ঘিরে নাচছে ,
পারছো না নিয়ম ভেঙে কেবল-
চৌকাঠ পেরোতে; মুক্তির আনন্দ!

ভয়ে ভীত আজ শাড়ির আঁচল ,
সেই জড়তায় সেই মেয়েবেলা,
কিন্তু কল্লোলের এ মুখগুলো –
আজ শুধু তোমারই নিয়ন্ত্রণে।

উৎস খুঁজে দেখলে একবার-
বুঝবে, জানবে, পথ পরিস্কার ;
অন্ধকার ঘুরে ফিরে আসে ঠিক,
তবু হার মানে আলোর চমকে।

নিজে পরিণতি দেখবে যখন-
বুঝবে চৌকাঠ; শুধুমাত্র কাঠ
সেখানে নেই তো জটিল বন্ধন!
সামনে শুধু চলার পথ আছে।

শুধুই চলার পথ…


কবি পরিচিতি

সুমিত্র দত্ত রায় কবির ছদ্মনাম। প্রকৃত নাম সংকেত চট্টোপাধ্যায়।

আমি ছেলেবেলা থে‌কে ভাগীরথী কূলে বড় হয়েছি। আমার একাধিক লেখার প্রেরণায় গঙ্গার ভুমিকা অনেক। ওখানেই দেখেছি সূর্যাস্ত বা তৎকালীন মেঘরঞ্জনী। আদি বাড়ির কথা দিদির চোখে দেখা। বরিশালের শোলক গ্রামেই পিতৃভূমি ও বাটাজোরে মাতুলালয় ছিল। পিতা ঈশ্বর যোগেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মাতা ঈশ্বর বিজনবালা দেবী। পারিবারিক জীবনে স্ত্রী রুমা চট্টোপাধ্যায় আর এক কন্যা সপ্তদ্বীপা চট্টোপাধ্যায়। ভাই নেই। দুই দিদি, গীতা মুখার্জী আর অঞ্জনা মুখার্জি। পিতা যোগেশচন্দ্র ছিলেন দেশপ্রেমিক। বরিশাল হতে বন্দী হয়ে দমদম সেন্ট্রাল জেলে বদলি হন। তাঁদের রক্তে কিছুটা দুঃসাহসী আমিও ছিলাম। কিন্তু কবিতার জগত আমার নিজস্ব মনে হত সেই দশবছর বয়সেই। আবৃত্তি, গান, ছবি আঁকা আমার খুবই পছন্দসই ছিলো। চাকুরিজীবী ছিলাম। এলাহাবাদ ব্যাংকে আধিকারিক। বদলির চাকরি। তাই ২০১২ সালে স্বেচ্ছায় অবসরের পর বাংলা কবিতা ডটকমে লেখা শুরু,  আমার কন্যাপ্রতিম সোমালীর হাত ধরে। আর পিছু ফিরে তাকাই নি, এখন ওটাই ধ্যান জ্ঞান।