একটি নিন্দিত ও নন্দিত কবিতা
– মনোজ কান্তি বিশ্বাস
একাত্তরের মার্চএ এই নিন্দিত ও অনিন্দিত
কবিতা লেখা হল বাংলার মানচিত্রে
মোংলা নেপালের দোহা থেকে দামেরখণ্ড
নিভৃত জনপদ-এক হিমেল রক্তহোলিতে
মেতেছিল নরদানবের দল,
হিংস্র থাবা মেলে ধারাল অস্ত্র
আর গুলি চালালো নিরীহ জনপাজড়ে।
পালাও পালাও বলতে বলতে গৃহহারা হলো
কৃষাণ-কৃষাণী, ছেলে-বুড়ো,আর তরুশীলের
মত নব বিবাহিতা যুবতীরা!
সেদিন রেহাই না পাওয়া
তরুশীল আজ বীরাঙ্গনা সম্মানে ভূষিতা-
যার দেহ বীরাঙ্গনার পোষাকে ঠাঁই পেয়েছে
শ্মশানের ছাইভস্মের দেশে!
আগামী প্রজন্মকে বলতে এসেছি-
তোমরা কি তরুশীলের
নির্মম নির্যাতনের ইতিহাস জানো?
রজব আলির দল দামের খণ্ডের মাটি থেকে
তাকে টানতে টানতে নিয়ে
লঞ্চে তুলে নিয়েছিল ওরা দল বেঁধে,
এরপর বাগেরহাট খুনি রজবের আস্তানায়।
সদ্য পোয়াতি তরুশীলের স্বপ্নটাকে
তাজা গোলাপের কুঁড়ি ছিঁড়ে চূর্ণ করে দিলো।
দামেরখণ্ডের খাল বেয়ে রুধিরাক্ত স্রোত
চলেছিল বঙ্গোপসাগরের দিকে,
কারো হাত, কারো পা, কারো মুণ্ডু, কারো
সন্তানের লাশ ভাসছিল খালে এবং পুকুরে!
রজব আলি আর তার দোসরদের
কিছুতে ক্ষমা হয় না,
এরা যুগে যুগে নিন্দিত ঘৃণিত,
ইতিহাসের জঘন্যতায় মহাপাপী,
আজও বহু বিধবার অভিশাপের গালি।
বাংলার দক্ষিণ জনপদে বাঘ কুমিরের সাথে
লড়াই করে বেঁচে থাকা মানুষ অসহায় মরেছে
রজব আলি আর তার দোসরদের হাতে,
তোমরা এদের ঘৃণা জানাবে,
নিন্দার ভাষা আমি ভুলে গেছি
সেদিন অসহায়া তরুশীলের পর্ণ কুটিরে
তাঁর গগন বিদারী চিৎকারে আর
কাঁদতে থাকা অনিন্দিত কবিতা কথামালায়!!
একজন বীরাঙ্গনার চোখের আগুনে দুইমাস
ভিজেছে বাগেরহাট কাড়াপাড়া রজব আলির
নষ্টাঙ্গিনায় পাকহানাদের লেলিহান লালসা,
পুড়েছে আমার স্বদেশ ভূমির অসংখ্য
বীরাঙ্গনা মায়ের শরীরের নির্যাতনের ক্ষতে।
এই অনিন্দিত কবিতা গল্পহোক প্রজন্মান্তারে
নিন্দিত হায়নারা ফাঁসির রজ্জু পরুক –
আর এই ইতিহাস চেতনা মালা পরুক
মানবিক মানুষের অন্তরে, যুগ-যুগান্তরে!!
জোনাকীর আলো
– মনোজ কান্তি বিশ্বাস
একটা গান শোনো রাত উজাগার গান
জোনাকির কৃষ্ণাভ আলোয়
তুমি শুনে নাও প্রাণ ভরে,
গভীর রাতে জোনাকি পোকার আলো
কার পথ, অথবা সজ্জা পাহারায় জেগে রয়?
আমাদের বিগত প্রজন্ম
ঢেকে গেছে জোনাকি আড়ালে ঘুটঘুটে
জোছনা কুমারীর গল্পের অবসরে।
তাঁদের খুঁজতে গেলে গাঢ় অন্ধকারে
হৃদয়ে আলো জ্বেলে অতীন্দ্রিয়
রজনীতে খুঁজে যেতে হবে!
যারা বর্তমান প্রজন্ম ফসলের মাঠে
উৎকণ্ঠায় পাহারারত পৃথিবীর পথে!
পৃথিবীর সব সন্তান ক্রমশ কুয়াসায় ভিজে
মাটির মায়ায় আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে!!
আমাদের চর্যাগীতি ঘুমিয়ে আছে
জোনাকির ক্ষীণ আলোয় অতন্দ্র পাহারায়।
ঘমপাহাড় ঝিমায় যখন
তবুও জোনাক আলো জ্বালে শেষরাতেও,
জোনাকীর গান শোনে কাঠবিড়ালি!
দর্পণে মুখ দেখ
– মনোজ কান্তি বিশ্বাস
সাধু সেজে হেসে বলে
আমার হিংসা নাই,
এই কথাটাও হিংসায় ভরা
কী দিয়ে তা বোঝাই?
মাথার ভিতরে কত যে অসুখ
শুধু খুঁজে ফেরা অন্যের সুখ।
দেখ একবার দর্পণে মুখ।
ব্যঙ্গ ছবিতে কেঁপে যাবে বুক।
হিংসায় আজ উন্মত্ত পৃথিবী
কেন জ্বলেপুড়ে চুপ রও?
পুড়ে মরো দিবা নিশি
কেন অন্তরে জ্বালা বও।
পরশ্রীতে চতুর্দিক লোক
সয় না সাফল্য দেখে,
বন্ধুর বুক ঈর্ষায় জ্বলে
মুখগুলো যায় বেঁকে।
একা কেন জ্বলে পুড়ে
নিঃশেষে হবে ছাই,
হিংসুক যত সকলে জ্বলে
কেউ পিছে পড়ে নাই।
ভোরের আলো
– মনোজ কান্তি বিশ্বাস
এই যে আলো ঐ যে হাওয়া
লাগল ভালো ভোরের নাচন।
মিষ্টি রোদের মিষ্টি হাসি
নেইতো তাতে মরণ-বাচন।
মিষ্টি সকাল স্বপ্ন দেখায়
নতুন ভালো বাসতে শেখায়,
নতুন আলোর পরশ নিয়ে
হাসি মুখে বাঁচতে শেখায়।
সূর্য হাসে রোজ সকালে
প্রতি দিনের নতুন হাসি,
আঁধার ঠেলে পাখির গানে
কিচির মিচির কলোরোলে।
ভোরতো আসে প্রতি দিনই
আসে না সে একই রঙে,
কারো সবুজ কারো হলুদ
কমলা রঙে নানান ঢঙে।
সবার সকাল নতুন করে
স্বপ্ন জাগাক নিত্য ভোরে,
হাত ছানিতে ডাকুক তোমায়
নতুন সকাল তোমার দ্বারে।
ছবির মত সকাল আসুক
ভুবন হাসুক তাকে দেখে,
প্রাণ জুড়াবে সেই হাসিতে
ভোরের হাসি গায়ে মেখে।।
কবি পরিচিতি

মনোজ কান্তি বিশ্বাস। জন্ম ১৯৭৫ সালে খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার মাইটভাঙ্গা গ্রামে। বটিয়াঘাটা হেড কোয়ার্টার পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, বটিয়াঘাটা কলেজ থেকে এইচএসসি এবং সরকারি ব্রজলাল কলেজ থেকে বাংলা সম্মান সহ এম এ পাস। কর্মজীবনে একজন গবেষক ও স্বনামধন্য অধ্যাপক। গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ এর দুটি গবেষণার প্রজেক্টের সাথে। বর্তমানে কর্মরত আছেন বাংলা বিভাগের প্রভাষক পদে মোংলা উপজেলায় অবস্থিত মোংলা সরকারি কলেজ-এ ২০০২ সাল থেকে।
স্কুল জীবন থেকে কবিতা লেখার সূত্রপাত। কলেজে পড়াকালীন সময়ে কবিতা ও প্রবন্ধ রচনায় বেশকিছু পুরস্কার পান তিনি। এসময় বেশকিছু দৈনিক পত্রিকায়ও তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়। এছাড়া তাঁর লেখা কবিতার বই ও শিক্ষার্থীদের জন্য বইও প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে যুক্ত আছেন বিভিন্ন সৃজনশীল লেখা-লেখির সাথে। বেশি পছন্দ কবিতা পড়া ও লেখা। নদী, প্রকৃতি, ঋতুবৈচিত্র ও জীবনবোধের প্রকাশই তাঁর কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।