ভুলের মাশুল
– শুক্লা বোস
জানা পিনকোডে শেষ শব্দটা ভুল হয়েছিল তাই,
ভালোবাসা হাড়ে স্বপ্ন ফসিল অজান্তে হল ছাই।
ভুলের মাশুল করেছি গণনা সারাটি জনম ভর,
স্বপনের নিশা হারালো যে দিশা ভালোবাসা হল পর।
অমৃতলহরী ভালোবাসারাশি কাঁদে ফসিলের ঘরে,
অমরাবতীর অমরাঙ্গনা ভাসেনা স্বপন পরে।
নীরব বেদনা হতাশায় কেনা ঝরে অভিমানী হৃদে,
জীবন নাটকে তবু অভিনয় তিক্ত দহনে বিঁধে।
ফসিলের ছাই শুধু মাখামাখি হৃদয়ের চোরা ঘাসে,
বদ্ধ পাগল আজও অবিচল পরশমনির আশে।
নটবর বেশে নটরাজ হেসে বলে, “ধুলোখেলা শেষে –
ভালোবাসা দিয়ে বরে নেব তোরে প্রাপ্যতা অবশেষে।
নব ফুলদলে ভরা অঞ্চলে পূজার অর্ঘ্য ডালি,
যদি দিবি মোরে, তোর অগোচরে ভালোবাসা দেবো ঢালি।
অপূর্ণ প্রাণ পূর্ণতা পাবে জীবনের অবসানে –
জীবনের গান হবে অবসান, আয় চলে সাবধানে।
ছুটে চলা
– শুক্লা বোস
ছুটে চলা বুকে নিশিদিন তার
নীরব ব্যথার ভার,
পয়োনিধি কেন রাখেনি খবর
সমুদ্র দয়িতার।
বুকের গভীরে যে কথা লুকানো
যে কথা হয়নি বলা,
সঙ্গম সুখ, স্বপ্ন আবেশে
অবিরাম ছুটে চলা।
কলানিধি সম অম্বর বুকে
জ্যোৎস্না ঝরানো গানে,
নিঃসীম সুখে প্রণয়ের টানে
ছোটে সাগরের পানে।
প্রণয় আবেশে চিত্ত দোদুল
মানেনা সে কোন বাঁধা,
তরঙ্গঘায়ে দু-কূল প্লাবিয়া
উদ্দাম গতি সাধা।
তারাদের বুকে অনিমিখ আঁখি
মুগ্ধ আবেগ ঘোর,
খেয়ালী হৃদয়ে এলোমেলো কথা
বাঁধিবে প্রণয় ডোর।
অতল বারিধি আত্মমগ্ন
আপনার সুখাবেশে,
দয়িতারে বুকে টেনে নিলো শেষে
হাসি মুখে ভালোবেসে।
আমার গাঁ
– শুক্লা বোস
ওই যে দূরে আকাশ তলে ছোট্ট আমার গাঁয়,
যাবে নাকি শহর বাবু সেথায় বন ছায়?
গাঁয়ের বুকে ঘুমায় সুখে ছোট্ট কুটিরখানি,
সোনা মাটির সোনা দিয়ে লেপা অঙ্গন জানি।
মাটির দেওয়াল, ছাউনি খড়ের, রবির করে ধোয়া,
নিমেষ মাঝে প্রাণটি কাড়ে দিনের আলোর ছোঁয়া।
সবুজ বীথির শ্যামল ছায়া যেথায় মাথার পরে,
জুড়ায় পরাণ, পাখির কূজন হৃদয়রতন হরে।
গেরুয়া মাঠে অযুত ফসল ফলছে ক্ষেতের বুকে,
সবুজ-সোনা রঙ ঝরিয়ে হাসছে যেন সুখে।
মাঠের পরে মাঠ চলেছে বুকে ধানের রাশি,
সবুজ শোভা বুকে ধরে ছড়িয়ে গেছে হাসি।
রাস্তা ধরে যাচ্ছে সেথা বলদ টানা গাড়ি,
আড়াল তলে গ্রাম তনয়া চলল বাপের বাড়ি।
হৈ হটাহট, ক্যাঁচর ক্যাঁচর শব্দে ফিরে ফিরে,
ক্লান্ত পায়ে বলদ দুটি টানছে গাড়ি ধীরে।
এই তো আমার সোনার গাঁয়ের সোনা ঝরা ছবি,
বর্ণনাতে আমি বুঝি হয়েই গেলাম কবি!
বিবর্ণ আয়ু
– শুক্লা বোস
কোন গ্রহ থেকে এসেছিলে তুমি, ফিরে যাবে কোন নভে,
কখন জনম, কখন মরণ খোঁজ রাখে কেবা কবে!
আকাশ প্রান্তে কোথায় কখন ঠাঁই নেবে তব প্রাণ,
অচেনার পথে অজানার ভীড়ে একলা চলার গান।
আজকের কথা পড়ে রবে হেথা, সমুখে নিবিড় নিশা,
বিভেদ নিষেধ বেড়াজাল ভেঙে কঠিন চলার দিশা।
এ জীবন শুধু নিশার স্বপন কেবলি জড়ানো মায়া,
জীবন প্রান্তে মরণের ছোঁয়া ফেলে রাখে কালো ছায়া।
কামনার ধুম লৌহ নিগড়, জীবনের বাঁকে বাঁকে,
মরণ যেখানে আলপনা আঁকে বাসনার ফাঁকে ফাঁকে।
মৃত্যুযজ্ঞে সবাই শামিল আত্মাহুতির লাগি,
তবু নিশিদিন বাজে মনোবীণ, বিবর্ণ আয়ু মাগি।
বেদুঈন মন
– শুক্লা বোস
হারিয়ে গেছে সুখের ছায়া, সেই যে সুখের আসর,
কাল গোনে আর জাল বোনে আজ মৃত্যুছোঁয়া বাসর।
বাঁধন ছেঁড়া স্মৃতিঘেরা বিপুল সুখের রাশি,
ব্যথার কাজল নয়নতীরে নিত্য ওঠে ভাসি।
শীতের শিশির যায় মিলায়ে তরুণ তপন রাগে,
হিমেল হাওয়া কাঁদন জাগায় বসন্তের ওই বাগে।
স্বপন মাঝে মগন বুঝি তরুণ সুখের ছোঁয়া,
শীত কুহেলীর মর্মরেতে আঁখির নীরে ধোয়া।
অতীত ছায়া গোপন কায়া, জড়িয়ে থাকে বুকে,
কৃপণ বুকে গচ্ছিত ধন লুকিয়ে রাখার সুখে।
পেছন ফেরা রাত্রি টানে লক্ষ তারার ভীড়ে,
শত মুখের উজল হাসি ডাকে সুখের নীড়ে।
মরুতৃষায় বুক যে ফাটে তবুও কুহেলিকা,
বলিরেখায় আঁকিবুকি, কেবল প্রহেলিকা।
জীবন পাঁচালিটা বুঝি আজ আলেয়ার আলো,
বেদুঈন মন খুঁজে ফেরে ভালোলাগার ভালো।
কবি পরিচিতি

শুক্লা বোস। মোংলা অঞ্চলের জ্ঞানের প্রধান বিদ্যাপীঠ শেলাবুনিয়ায় অবস্থিত সেন্ট পলস্ উচ্চ বিদ্যালয়-এর স্বার্থক ও কৃতি শিক্ষিকা। সুদীর্ঘকাল শিক্ষকতার পর শিক্ষার্থীদের প্রাণপ্রিয় এই শিক্ষিকা মার্চ ৪, ২০২০সাল থেকে অবসরে আছেন।
ছেলেবেলার থেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, জীবনানন্দ দাশ সহ বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য প্রথিতযশা কবি ও সাহিত্যিকদের লেখার সান্নিধ্যে বেড়ে উঠেছেন। কখনও কখনও লিখেছেন আত্মার সন্তুষ্টির জন্য। আত্মপ্রচারে বিমুখ হওয়ায় নিজের ভিতরেই রেখেছেন নিজেকে – তেমনভাবে বাইরে প্রকাশিত হয়ে ওঠা হয়নি।
বর্তমানে অবসর জীবনের একঘেঁয়েমি কাটিয়ে জীবনযাত্রায় কিছুটা ভিন্নতা ও বৈচিত্রের ভিতর দিয়ে সময় কাটানোর জন্যই বেছে নিয়েছেন বই পড়া ও লেখালেখিকে। সাহিত্যের মাধ্যমে মানুষের আত্মশুদ্ধি হোক, মানুষ সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠুক – এই প্রত্যাশাই তার ভাবনায় জীবন জুড়ে বিকশিত।