বিভূতি দাস – কবিতা (ভেবে দেখো বন্ধু, কিছু তার, চুপ থাক, কবি মন, অন্তরালে কৈশোর)

ভেবে দেখো বন্ধু

– বিভূতি দাস

ভেবে দেখো বন্ধু ফেলে দেওয়া কথাগুলো একবার, মনে মনে
সেবাই পরম ধর্ম, এই ধারণার শুরু কোথায়, বনে নাকি গৃহকোণে?
কাদের ভালবাসার দানে শিশু মানুষ হয়, হয়ে ওঠে বিদ্যান জ্ঞানী
শুধু নিজ মনের শান্তির কথা ভেবে সন্যাস নিয়ে হলে নাকি ঋণী!

নানা বেশে নানা নামে বিলাও একই পুকুরের পানি, নানা মতে ভাবে
খ্যাতি পাও নতুন যজ্ঞে শিক্ষার গুণে, যা পেয়েছিলে আদি গুরুর ত্যাগে
দীক্ষা গুরুর আদেশ শিরধার্য নেই সংশয়, দুর্জ্ঞেয় জ্ঞানের পিপাসায় অন্তর
ভেবে দেখো শান্তি কি পেয়েছ হৃদে! নাকি শত কর্মের মাঝেও সে দুস্তর।

ভাবলে না তাঁদের কথা! যাঁদের দানে, ত্যাগে আজো সোজা মেরুদণ্ড
যাঁরা আগলিয়ে রেখেছিল বিস্তর সময়, কাটতে দেয়নি বেড়ে ওঠার ছন্দ
পরমার্থ লাভে সরে গেলে দায় এড়িয়ে নিজ মনের করতে সেবা,
পৃথিবীর আলো দেখানোর কারিগর রইল পড়ে অসময়ে একা একা!

কিছু তার

– বিভূতি দাস

তোমার মেঘনা যমুনা আর পদ্মায়
খুঁজে ফিরি বসন্ত রং নানা অছিলায়
খুশী হতাম, যদি কিছু তার দাও আমায়
তোমার মেঘনা যমুনা আর পদ্মায়।

শিহরণে ভেসে যাই প্রতিদিন; শুধু তোমায় দেখে
আঁচল ভরা সুরভিত স্বপ্নের পরশ মেখে
তুমি যে দুঃখ জয়ের মদিরা; বিষণ্ণ মজনু চোখে
যদি ধরা দাও মনে, হারিয়ে যাবো সব সরিয়ে রেখে।

জানি জীবনের ধারাপত মেলেনা, ভিন্ন খাতেই সে বয়ে যায়
তবু রুমাল ভেজানো পানিতেই, মন তোমাকে পেতে চায়
যদি ভুল করে থাকি আমার এই ক্ষুদ্র চাওয়ায়
মেনে নিও ভালোবেসে; কিছু তার দিয়ে আমায়।

চুপ থাক

– বিভূতি দাস

চুপ থাক বাছা, চুপ থাক, দরজার বাইরে ঘুরছে হায়না
দেশ ভক্তি না প্রতিবাদী, এ সবের ওরা কিচ্ছু বোঝে না
রজত মুল্যে কেনা গোলাম, বিরুদ্ধ মত ওরা সয় না
কালির মূল্য শূন্যই জ্ঞানে, অকাতরে মুছে দেয় সুস্থ ভাবনা
গন্ধ পেলেই রক্ত চক্ষুর ঝঞ্ঝা, উন্মাদ এরা বোঝে শুধু প্রেরণা
চুপ থাক বাছা, চুপ থাক, করিসনে আর বেয়াদপি বায়না।

চুপ থাক বাছা চুপ থাক, পারলে খুলে রাখ চোখ কান
লোভের নেশায় হুঁশ হারা মানুষ, শুনবে না সত্যের গান
স্বার্থের জালে ঘেরা চরাচর, ফাঁস গুলো তার অতি সুক্ষ
ভাষণের টোপ মধুর সে স্বাদ, ফেঁসে যায় জ্ঞানী ও দক্ষ
সেবার আড়ম্বরে সততা ভেসে যায়, মর্দনেই মেলে মান
রথী সারথি সব গভীর জলে, চুনো পুঁটির-ই যায় জান।

কবি মন

– বিভূতি দাস

কবি মনের ভাব বেসুরো, কে তারে করবে লালন
কাল-বোশেখ যা পারেনি, পেরেছে অদেখা দহন
ভাবনারা সব দিয়েছে উড়াল, ছিঁড়েছে তার একতারা
মনে নেই শব্দ বসত, কলম যেন দিশেহারা
এলোমেলো ঘূর্ণি বায়ে ভেসে যায় কবি মন।

মননে যে শক্তি ছিল, তারা সব কোথায় গেলো
দেওয়ালে ঠেকলে পিঠ, ভাবনা ঢাকে আঁধার কালো
উর্বশী সুরভিত রজত রাতে হাস্নুহেনার বিষাদ যাপন
না পারে ছাড়তে তারে, দহন জ্বালায় কবি মন
হায়রে কবি এযে ভরা ডূবি, শিয়রে দাঁড়িয়ে শমন।

অন্তরালে কৈশোর

– বিভূতি দাস

ভাবনা আসে অন্তরালে, মন কেমনের পেখম মেলে
বিষণ্ণতার ফুটো নৌকায় স্মৃতির বৈঠায় হেলেদুলে।

সব বাড়িতেই বাঁধন ছিল, পরিবারের শাসন ছিল
ঘর গুলো আলাদা হলেও একই হাঁড়ির ভাত ছিল
দাওয়ার নিচেই খেলার জায়গা সব বাড়িতেই উঠোন ছিল
মা–জেটি-কাকির দুপুরে খাবার পরে খোশ গল্প ছিল
শীত দুপুরে রোদে বসে হাতে উলের কাঁটা ছিল
অন্য দুপুরে চটের আসনে নকশা তোলার ধুম ছিল।

সময় গুলো পালিয়ে গেল, বৈশাখী ঝড় যেমন যায়
কিছু ছবি তবুও সবাক, জীবন পাতার মলিন রেখায়।

ভর দুপুরে জামের ডালে আমের তলায় জটলা ছিল
টপকে বেড়া কাঁটার আঁচড়, তাতেও কি পরোয়া ছিল
কার বাগানে কি কি গাছ, সে সব প্রায় মুখস্থ ছিল
কোন পথে বিপদের গন্ধ সে সব ভালোই জানা ছিল
ধরা পড়লে কান মোলা, গাঁটটা এসব ও পাওনা ছিল
নালিশ হলে দু-চার ঘা কঞ্চির মার, সে প্রায় বাঁধা ছিল।

ক্লান্তিহীন ছটফটে মন কবে যে কোথায় হারিয়ে গেল
জানা নেই তার হদিশ, কখন দায়-দায়িত্বের ভুতে পেল।

দিনের শেষে সন্ধ্যায় বড়দের খোল করতালের বোল ছিল
সুরে না হলেও কাটাতে সময় হরিনামের দল ছিল
কুপির আলোয় কাকা জ্যাঠাদের তাস লুডোর আসর ছিল
মাটির দাওয়ায় ছালায় বসে মুড়ি খাওয়ার চল ছিল
কাঁচের গ্লাসে গুড়ের চায়ে চুমুক দেওয়ার তৃপ্তি ছিল
সামান্যতেই খুশীর বাতাস, সকল মুখেই হাসি ছিল।

সকাল না হতেই সন্ধ্যা, মনেহত বড্ড ছোট দিনের সময়
ওড়ার আকাশ রেখে বাকি ফিরতে হত আপন কুলায়।

এক আলোতেই গোল হয়ে খুদে পড়ুয়াদের পড়া ছিল
কেউ কেউ ঢুলতে থাকলে অন্যদের আড়চোখের হাসি ছিল
চিমটি দিয়ে জাগিয়ে দিলে মুখে রবি ঠাকুরের ছড়া ছিল
ঢুলতে ঢুলতেই দুইয়ের নামতায় সময় যেন বাঁধা ছিল
ঠিক করে দেখে পড়, মায়ের কড়া ধমক ছিল
লালচোখে বিরামহীন হাই তুললে দাদা দাদীর আদর ছিল।

কিশোর বেলার দুরন্তপনা কোন ভাবেই ছিলনা বাঁধা
চঞ্চল সব দুষ্টু গুলো কোথায় গেলো সেটাই মস্ত ধাঁধা।


কবি পরিচিতি

বিভূতি দাস। অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক। জন্ম ১৪ই ফেব্রুয়ারী, অভিভক্ত ২৪ পরগনার কৃষক পরিবারে।

প্রকৃতির কোল ছুঁয়ে গ্রামে বেড়ে ওঠা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। ছাত্রাবস্থা থেকেই সৃষ্টির সাথে প্রেম। নেশা-লেখালিখি এবং ভ্রমণ। বর্তমান নিবাস – সোনারপুর, কলকাতা –৭০০ ১৪৯, ভারত।