শুক্লা বোস – কবিতাগুচ্ছ (কামনা, নারী অবদান, তোমার বাঁশি, ভালোবাসার বিজয়মন্ত্র, স্মৃতিময় দিন)

কামনা

– শুক্লা বোস

শব্দ সীমায় শুধু লিখে যাই মনের কামনা যত,
কিছু অগোছালো কিছু বা বেভুল অপারগ মেশা শত।

নির্ঝর দিন বহমান ক্ষীণ গহন হৃদয় নীড়ে,
ভাসে অবিরাম তবু অভিরাম জানা অজানার ভীড়ে।

যত হাসি চাই কান্না লুটায়,মনেরে শুধাই আজি-
জীবনের ক্ষত শুধু অবিরত কেন বা উঠিছে বাজি।

কারে যেন চাই কোথা গেলে পাই, দিবানিশি ক্রন্দন,
শুধু হুতাশন তিক্ত দহন বৃথা সব বন্ধন।

দীপক রাগিনী রুদ্র আঘাতে হানিছে অগ্নিবাণ,
জীমূত বাহন কোথা আবাসন এসো হে সন্নিধান।

মেঘমল্লারে বাজুক রাগিনী নিঃস্বতা পাক ধারা,
তীব্র তিয়াশা তাপিত পিয়াসা বরষায় হোক হারা।

রুনু ঝুনু ঝুনু, রিমি ঝিমি ঝিমি ঝরুক ধরণী বুকে,
আবেগী এ প্রাণে ঘন বরিষণে পিয়াসী চাতক সুখে।

নারী অবদান

– শুক্লা বোস

আমি নারী বন্দনা গাই —
যুগে যুগে যত নারী অবদান শ্রদ্ধায় স্মরি তাই।
পুরুষ দ্বেষী কভু নই আমি তবুও তাদের চিনি,
চিরকাল নারী ভালোবাসা দিয়ে পুরুষ নিয়েছে জিনি।

পুরান কেতাব ধর্ম কাহিনী একই কথা বলে চলে,
রামায়ণ জানে রামের মহিমা সতী সীতা অবহেলে।
রাবন হরিলো পতিব্রতা সতী, সীতার কী ছিলো দোষ,
রাম কিনে নিলো রাজার মহিমা, সীতার ললাটে রোষ।

স্বর্ণ সীতারে বসায়ে হৃদয়ে প্রশমিত রাম শোক,
অবলা রমণী বনে বনে ঘোরে,ক্ষোভে দুখে ভরে চোখ।
ভালো হতো যদি সাজা দিতো সীতা, রাম চলে যেত বনে,
নিজে রানী হয়ে রাম মহারাজে পাঠাত নির্বাসনে।

যে বৈশিষ্ট্য আছে নারীর শরীরে তার সবটুকু পেলে,
নিমেষে পুরুষ সব তুলে দেবে অন্য নারীর কোলে।
শকুন্তলা, দময়ন্তী আর পুরানের নারী যত,
ভালোবাসা দিয়ে সয়ে গেছে তাঁরা আপন হৃদয় ক্ষত।

নারীর সহন, নারীর দহন, যত ভালোবাসারাশি তার,
অবহেলাভরে দলিত হয়েছে চিরদিন বার বার।
সমাজ শোধন কখনো হবে না চলবেই চিরকাল–
পলে পলে নারী অবহেলা পাবে – ভালোবাসা তার কাল!

তোমার বাঁশি

– শুক্লা বোস

বাঁশি তোমার বাজিয়ে গেলে কোন সুদূরের থেকে,​
সুরের ধারা আমার প্রাণে চিহ্ন রাখে এঁকে।​
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ তোমার বাঁশির সুরে সুরে​
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ হৃদয় লোটে অচিনপুরে​
রাজাধিরাজ, আমায় কেন বাঁধলে এমন করে-​
কেমন করে রাখবো বলো আপনাকে আজ ধরে!​

​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ আমি তখন অন্যমনে​
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ছিলাম বসে ঘরের কোণে​
দূর থেকে ওই সুরলহরী গেলো আমায় ডেকে,​
প্রাণের বীণা বাজলো সুরে অসীম গগন ঢেকে।​

​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ তোমার সুরের ইন্দ্রধনু​
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ মোহন মায়ায় জড়ায় তনু​
বিবশ হয়ে রইনু কেবল পথের পানে চেয়ে,​
এলে তুমি রাজাধিরাজ, আমার ভুবন ছেয়ে!​

​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ নয়কো শুধুই বংশী ধ্বনি​
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ বাজলো নূপুর রিনিঝিনি ​
সুরের সুধায় বিবশ হৃদয় হে রাজাধিরাজ,​
একলা কাঁদি বিজন ঘরে রইলো পড়ে কাজ!

ভালোবাসার বিজয়মন্ত্র

– শুক্লা বোস

ভালোবাসার বাঁধনে বাঁধো করো হৃদয় জয়,
মনের মাঝে পাতা আসন হয় না যেন ক্ষয়।

বাজুক ভেরী হৃদয় মাঝে ভালোবাসার সুরে,
দুঃস্থজনার দুঃখদাহন যাক না সরে দূরে।

‘জীবের মাঝে শিবের সেবা’ মন্ত্রেতে প্রাণ ধরে,
শান্ত প্রীতির শান্তিধারায় উঠবে জীবন ভরে।

হৃদয়াসনে বিরাজমান পতিতপাবন প্রভু,
তাঁর ছোঁয়াতে জাগবে জীবন ব্যর্থ না হয় কভু।

বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণের অমৃতপথ ধরে,
ভালোবাসার বিজয় মন্ত্রে প্রাণটি উঠুক ভরে।

সংক্ষেপিত এই জীবনের সওদাগরের হাটে,
ভালোবাসার ফেরিওয়ালা ফেরেন বাটে বাটে।

সবাইকে যে বাঁধেন তিনি ভালোবাসার ডোরে,
সীমার মাঝে অসীম তিনি, বাঁধ না প্রেমে তাঁরে।

স্মৃতিময় দিন

– শুক্লা বোস

নদী বুকে পাল তুলে কোথা যাও নেয়ে?
স্রোতে ভেসে চলে যাও ভাটিয়ালী গেয়ে।
ভাটির দেশেতে বাও উজানেতে নাও,
উদাস সুরেতে ভাসে নদী তীর গাঁও।

মনমাঝি বৈঠাটা আর বায় না,
ভাটি দেশে ভাটি সুর আর গায় না।
সেই সুরে নাচে নাতো আর মন প্রাণ,
যন্ত্র নিয়েছে কেড়ে কণ্ঠের গান।

পাল সেতো হারিয়েছে ইঞ্জিন ভীড়ে,
শব্দের ঝালাপালা সভ্যতা নীড়ে।
অনুরণি স্মৃতিপাতা দেখি খুলে খুলে,
মানুষেরা যান্ত্রিক সভ্যতা ধুলে।

আঁধারের মাঝে ঘেরা আবছায়া কালো,
কেরোসিন বাতিটার মোলায়েম আলো।
ঘরে ঘরে আজ দেখি বিজলীর ঘটা,
আঁধারের রূপরাশি হারালো যে ছটা।

হারিয়েছি ছেলেবেলা, কোথা পাই তারে,
তার তরে মন কাঁদে আজ বারে বারে।
কোথায় হারালো সেই স্মৃতিময় দিন,
বেহাগের রাগিনীতে বাজে মন বীণ!


কবি পরিচিতি

শুক্লা বোস। মোংলা অঞ্চলের জ্ঞানের প্রধান বিদ্যাপীঠ শেলাবুনিয়ায় অবস্থিত সেন্ট পলস্ উচ্চ বিদ্যালয়-এর স্বার্থক ও কৃতি শিক্ষিকা। সুদীর্ঘকাল শিক্ষকতার পর শিক্ষার্থীদের প্রাণপ্রিয় এই শিক্ষিকা মার্চ ৪, ২০২০সাল থেকে অবসরে আছেন।

ছেলেবেলার থেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, জীবনানন্দ দাশ সহ বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য প্রথিতযশা কবি ও সাহিত্যিকদের লেখার সান্নিধ্যে বেড়ে উঠেছেন। কখনও কখনও লিখেছেন আত্মার সন্তুষ্টির জন্য। আত্মপ্রচারে বিমুখ হওয়ায় নিজের ভিতরেই রেখেছেন নিজেকে – তেমনভাবে বাইরে প্রকাশিত হয়ে ওঠা হয়নি।

বর্তমানে অবসর জীবনের একঘেঁয়েমি কাটিয়ে জীবনযাত্রায় কিছুটা ভিন্নতা ও বৈচিত্রের ভিতর দিয়ে সময় কাটানোর জন্যই বেছে নিয়েছেন বই পড়া ও লেখালেখিকে। সাহিত্যের মাধ্যমে মানুষের আত্মশুদ্ধি হোক, মানুষ সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠুক – এই প্রত্যাশাই তার ভাবনায় জীবন জুড়ে বিকশিত।