ঋতু আসে ঋতু যায়
– দেবকুমার মুখোপাধ্যায়
আজকাল কেউ আর ঠিক ঠিক সময়ে আসে না,
দেরি করে আসা আর তাড়াতাড়ি চলে যাওয়াতে
সবাই অভ্যস্ত আজ, এইটাই যেন বা রেওয়াজ
সময়ের দাম নেই, ঘড়িটা মিছেই ঘুরে চলে।
কেউ কেউ এলে আর চলে যেতে যায় না সহজে
যেমন গ্রীষ্মের কাল _আম জাম লিচু চলে যায়,
কমে না রোদের তেজ, ফোঁটা ফোঁটা ঘাম শুধু ঝরে,
পথ চেয়ে বসে থাকা কবে বৃষ্টি নামবে অঝোরে।
বৃষ্টির দিনগুলো কখনো বিলম্ব করে আসে,
ঝিরঝির ঝমঝম তারপর ভাসিয়ে বন্যায়
ঘরবাড়ি… যেন তারা খড়কুটো বৈ কিছু নয়
দাপটে এলাকা ছাড়ে চারিদিকে ক্ষতচিহ্ন এঁকে।
রোদের আমেজ নিয়ে শীত আসে, সময়ের বোধ
তারো নেই, পাতা ঝরে তারপর চলে যায় দ্রুত,
শিউলি ফোটার দিন, উৎসবের নন্দিত বাঁশি
হিমঝরা হেমন্তের কাল আসে, বলে যাই যাই।
শিমুল, পলাশ যদি লাল রঙে লাগায় আগুন
নিমগাছে কচি পাতা যদি পরে লোহিতের সাজ
দক্ষিণ দিক থেকে যদি বয় মনোরম হাওয়া
এও বেশি দিন নয়, আমি জানি, সেও চলে যাবে।
দিগভ্রান্ত
– দেবকুমার মুখোপাধ্যায়
বারবার দিগভ্রম হয়।
পথে নেমে এক পথ থেকে অন্য পথে চলে যাই,
উত্তর দক্ষিণ সব তালগোল পাকিয়ে যায়,
জাহাজের কম্পাসের মতো একটা কিছু থাকলে হত
এমনটা ভাবি আর ঘুরে ঘুরে ঘুরপথে
গন্তব্য দূরে চলে যায়।
এমনটি হয় কি তোমার কিংবা আর কারও?
পথগুলো সোজা নয়, বড় বাঁকা, এলোমেলো
শাখাপ্রশাখায় বড় জট বাঁধা
সোজাসাপ্টা নয় কেউ, নিশানাবিহীন।
মাঝপথ থেকে তাই ফিরে আসতে হয় ঘরে,
নিজস্ব নির্মাণে;
গোপনে গোপনে কুঁকড়ে যাই
কাউকেই বলা যায় না এই ভ্রান্তি।
তুমিও তো ‘ধরিত্রী বাঁচাও’ বলে পথে নেমে
ভুলে গেলে পথ কোন্ ভুলে,
চোরা ঘুর্ণির টানে ক্রমশঃ তলিয়ে যাচ্ছ নিচে
আর বলছ ‘এ পৃথিবী দীর্ঘজীবী হোক’।
সুবর্ণরেখা
– দেবকুমার মুখোপাধ্যায়
ঘাটশিলার এক সাঁওতাল মেয়ে
সুবর্ণরেখাকে দেখিয়ে বলেছিল _ ঐ তো সুবর্ণ!
ঠিক যেমন বাপ মা তাদের ছেলেমেয়ের
একটা ডাকনাম রাখে,
সারা দিনভর কতবার যে সেই নাম ধরে ডাকা!
বাবা সবাইকেই একটা আলাদা নামে ডাকতেন
কেউ খুদে, কেউ চিংড়ি, কেউ ফড়িং,
বাবা ছাড়া আর কেউ সে-নামে ডাকতে পারবে না_
এমনই ছিল ব্যাপারটা।
কী ভালো যে লাগত!
সাঁওতাল মেয়েটি ‘সুবর্ণ’ বলে ডাকতেই
পাহাড়, নদী,জঙ্গল সবাই যেন খুব কাছে চলে এলো
আর ডেকে উঠল _ সূবর্ণ সূবর্ণ সুবর্ণ।
রুমাল
– দেবকুমার মুখোপাধ্যায়
ও রুমালে কোন শোক অশ্রু নেই।
চতুর কৌশল আছে
ভোটতন্ত্রে বিনিয়োগ,
মানুষ এখনও ভোলে
একই বুলি বকম বকমে,
সভায় অগুনতি মাথা
জোড়া হাতে হাততালি দেয়,
দল বাঁচানোর যত কর্মসূচি মানে,
স্বেচ্ছাচারী নায়কেরা
একাধিক রুমাল রাখে কাছে
কোনটায় মোছে চোখ,
কোনটায় ঘাম,
কোনটায় সুগন্ধ পোষে
দর বুঝে কোনটা নিলাম।
এই সময়
– দেবকুমার মুখোপাধ্যায়
ঘুম ভেঙে উঠে শুনি ভাঙনের শব্দ
ঘর ভাঙে, সংসার, পরিচয় জব্দ।
চড়ুয়ের বাসা নেই উড়ে যায় শূন্যে
দৃকপাত কারো নেই কোন পাপ পুণ্যে।
গঙ্গার পাড় ভাঙে, তীর ভাঙে তিস্তা
তাই নিয়ে ছাপা হয় কাগজের দিস্তা।
মায়ের হৃদয় পোড়ে, ছেলে প্রতিপক্ষ
স্বদেশের জল খেয়ে বিদেশেই লক্ষ্য।
তবু্ও নতুন শিশু বেড়ে ওঠে গর্ভে
তাকে নিয়ে বুক বাঁধি, ভরে উঠি গর্বে।
কবি পরিচিতি

জন্ম ১৯৫০। স্নাতক। অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ককর্মী।
ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির শুরু। কবিতা, ছড়া, ছোট গল্প, অণু গল্প, নিবন্ধ লিখে থাকেন। বড়দের জন্য, ছোটদের জন্যও। কিছু কিছু অনুবাদও করেছেন, ইংরেজি থেকে বাংলায় — কবিতার, গল্পের। বিভিন্ন পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়েছে ও হচ্ছে।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে — আসলে আলোর জন্যে, এখানে তরঙ্গ এখানে জীবন, জলের উপমা,অপ্রিয় শব্দমালা (এককভাবে), যাঁরা কবিতা পড়েন না (দুজনে মিলে), ছড়ার মজা খাস্তা গজা ও চার মাথার মোড় (চারজনে মিলে)।