বিভূতি দাস – কবিতা (কুলীন, নিত্য নবীনা, খাস জমি, মাছভাতে বাঙালি, আমার বাংলা)

কুলীন

– বিভূতি দাস

সব ক্ষেত্রে কুলীনের নাকি আলাদা বাজার আছে
সেকাল; একাল; আগামীকাল সর্ব কালের মাঝে
থাপা সে কুপিআ; দহলা-নহলা সে খানেওলা
গ্যান্-ভ্যান সে ঘর্-পার্ , চাপটাবাজ সে চাপলা।

খুনের আসামী গারাদ গুরু, খাতির মেলে সব খোপে্
নেতা পায় আলাদা যত্ন, সেবার জন্য গাহাকি জোটে
দোহাই দিয়ে ধম্মের হাতে, আশি বছরেও করতো বিয়ে
পাপের বোঝা হয় না লঘু, বোললে কিছু কৌলীন্য নিয়ে!

আচারে কুলীন, পদেও কুলীন, কুলীন হল না মননে
পোষাক গুলো বদলে গেছে; সময় নদীর ভাটির টানে
সকল অনিষ্টে সিদ্ধ হস্ত, প্রতিজ্ঞার হাত রেখে সংবিধানে
সামাজ সেবায় এত মানুষ! তবু হাল ফেরে না দীনজনে।

( থাপা > আড্ডার জায়গা, কুপিআ> জেলের সেল, দহলা-নহলা > মরালগামিনী তন্বীর ছন্দোবদ্ধ চলা , খানেওলা > নাগর , গ্যান্-ভ্যান্>পতিতা পল্লী, ঘর্র-পার্>জুয়াড়ী, চাপটাবাজ>সমকামী, চাপলা>শাগরেদ , গাহাকি > পারিশ্রমিক, খোপে > সেলে )

নিত্য নবীনা

– বিভূতি দাস

জীবন বীণার চক্রতীর্থে তোমার আসা যাওয়া
বিষাদে আনন্দে নিঃশব্দ সঞ্চার; প্রাণের যত চাওয়া
কখনো ক্রুদ্ধ; কখনো স্নিগ্ধ, হৃদ মাঝারে রঙের আলপনা
জীবনের প্রতি ক্ষণে অপলক; তোমাকে দেখি নিত্য নবীনা।

দ্বাদশ কাব্যে ছড়িয়ে রেখেছ; বিরহ মিলনের অকথিত কত বাণী
আকাশে; বাতাসে; অরণ্যে; মরুতে; সমুদ্রে; শস্যের ভরা ক্ষেতে
পেয়ালা ছাপানো সুখে; দুঃখে; অনাদি সৃষ্টির অজ্ঞাত কত পথে
বুঝতে পারিনা সবটুকু তার; তবু মালাগাঁথি, অজানারে জানি।

শুভে অশুভে; যুগ যুগান্তে; প্রচ্ছন্ন রেখে আপন কীর্তি, ভাবনা
গুপ্তসঞ্চারে জাগো গিরিশৃঙ্গে, জীবনের রঙ্গমঞ্চে, আঁকাবাঁকা পথে
আপন খেয়ালে জাগো সহস্র ফনা তুলে, দুর্বার মৃত্যুময় স্রোতে
কখনো দূরে সরিয়ে সকল ক্ষত, দেখি তোমারে মৌনী; ধ্যাননিমগ্না।

খাস জমি

– বিভূতি দাস

জীবন নামের খাসের জমি, এ জমি নয় বন্ধ্যা ভূমি
কর্ম নামের বীজ ছড়ালে ফলবে ফসল অনেক দামি
আগাছা সব উপড়ে ফেলে, সেচ দিয়ে যা মনমালী
সময় হলেই দেখতে পাবি, থাকবেনা তোর ভাঁড়ার খালি।

যতদিন আছে সময়, ফসল ওঠা যত্ন করে
ভালোবেসে রাখলে তারে, পাবি সুফল জনম ভরে
জন্মান্তর যদি হয়রে সত্যি, ফেরত পাবি নিশ্চিত করে
আসা যাওয়া সব এখানেই, কেউ যাবেনা গ্রহান্তরে।

ধানিঘাস আর ধানের চারা, হলেও দেখতে একই রকম
সময় তারে আলাদা করে, মহাকালের এটাই নিয়ম
একই মাটি আলো জলে, বাহার আনে কর্ম বীজে
যে মাটিতে বিষকাঁটা হয়, যত্নে ভরে সরসিজে।

মাছভাতে বাঙালি

– বিভূতি দাস

মাছে ভাতের বাঙালি, নিরামিষে মন উঠছেনা
এটা সেটায় ভরছে পেট, রসনা কিন্তু মানছেনা ।

ইলিশ এখন ভিন্ন গ্রহের, গলদঘর্ম বাগদা আর গলদাতে
ট্যাংরা পারসে পাশাপাশি যায়, কপালে চোখ ভেটকিতে
পাবদা, ভাঙন, আইড়, শেলে, গুলে, কেউই যায়না কম
নোনা জলের চুনো চানায়, মিলেমিশে গৃহস্থ নেয় দম
নামে ভোলা কাজে নয়, চিরকাল সমুদ্রেই তার বাস
পমফ্রেট ভাই উঠেছে জাতে, পকেট করে হাঁসপাস ।

বনেদি জাত, রুই কাতলা কালবোস, আঁতুড় ঘরেই শেষ
ভিন প্রদেশের জ্ঞাতির মাঝে, বাঙালির রসনা পায়না রেশ
শোল, বোল, ন্যাদোস, বেলে, পাঁকাল, হলুদ বুকের কই
শিঙি, মাগুর, খলসে চাঁদা সরপুঁঠি, খুঁজে না পাই থই।

পকেট হাসে ক্রসবিডে, হলেও বাঙালির রসনা বেজার
রুপচাঁদ, গ্রাসকার্প, সাঁইপোন, জাপানি পুঁঠি, সিলভার
তেলাপিয়া, মনপিয়া, নাইলন ডেকার রেখেছে বাজার
পুকুর, ডোবা, খাল, বিল সব গিয়েছে প্রমোটারের পেটে
বাঙালির করুণ দশা নিরামিষে, ভরছেনা মন হাতচেটে।

আমার বাংলা

– বিভূতি দাস

বাংলা আমার প্রথম ঠিকানা, বেড়ে ওঠার পুণ্য ভূমি
অনেক যত্নে পিতৃ পুরুষের স্মৃতিকে বক্ষে রেখেছে চুমি
বাংলা আমার কিশোর বেলায় দামালপনার সাক্ষী
উদ্যত যৌবনে সুনীল সাগর, স্মিত প্রশ্রয়ে বন্ধু ও রক্ষী ।

বাংলা আমার প্রথম প্রেম, সোহাগে স্বপ্নে করেছে ঋণী
পরিণত যৌবনে কুবেরের তরী, অবেলায় বাংলাই ভরসা জানি
বাংলা আমার ভোরের স্বপ্ন, রাতের আকাশে আলোর বন্যা
বাংলায় বলি মনের কথা, বাংলাতেই জাগে নব চেতনা।

বাংলা আমার কন্ঠ জড়িয়ে সুরের যাদুতে ভরেছে ভুবন
এই গোলোকের অন্য কোথাও, পাইনি বাংলার মত আপন
বাংলার মাটিতে শিকড় গেঁথে, আকাশ ছুঁয়েছি দুইহাতে
পরমানন্দের সময়ের ভেলা পৌঁছে দিয়েছে নিজের ঘাটে।

বাংলা আমার, আমি বাংলার, বাংলাতেই হাসি-কাঁদি
বাংলাতেই লেখা শেষের ঠিকানা মাটির বিছানায় পরিপাটি
বাংলা আমার সকল সুখের, দুঃখের সাজানো যাদুঘর
আমি জন্মাই যেন এই বাংলায়, এ মাটি যেন হয়না পর।


কবি পরিচিতি

বিভূতি দাস। অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক। জন্ম ১৪ই ফেব্রুয়ারী, অভিভক্ত ২৪ পরগনার কৃষক পরিবারে। প্রকৃতির কোল ছুঁয়ে গ্রামে বেড়ে ওঠা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। ছাত্রাবস্থা থেকেই সৃষ্টির সাথে প্রেম। নেশা-লেখালিখি এবং ভ্রমণ। বর্তমান নিবাস – সোনারপুর, কলকাতা –৭০০ ১৪৯, ভারত।