অদৃষ্ট
– বিভূতি দাস
জীবনের সব সার–অসার, মাত্র তিন অক্ষরে সীমাবদ্ধ
জানতে চেয়েও পারে কী জানতে ! কার সৃষ্ট অদৃষ্ট
নিবিড় রহস্যে ঘেরা আসা যাওয়া, সুখ-অসুখ সকল
পদে পদে ওঠা-পড়া, অস্থির যাপন; নিরাশার ধকল
একই সাথে জন্মেও পথ মত হয় ভিন্ন, সময়ের যাপন
কারো হাসি ক্ষণস্থায়ী; কেহ বা হাসে সারা জীবন।
ভালোবেসে সুখী হতে চায় না, এমন মানুষ কোথায়
নব তরঙ্গের কল্লোলিত প্রবাহ সত্যই কী সুখে ভাসায়
স্বপ্নের যত কুঁড়ি ফোটে কী যাপিত মালঞ্চে স্বহাস্যে
নাকি প্রেমময় মাটি; ক্ষারে ভরে যায় নীল নৈরাশ্যে
কত অচেনারে হয় জানা; অতি প্রিয়জন দূরে সরে যায়
কুল ভাঙে নিঃশব্দে চোরা স্রোতে; কখনো দুকুল ছাপায়।
প্রতিদিনি ওঠে নতুন সূর্য, রাত পেরিয়ে আসে সকাল
ক্ষুধার পৃথিবী আঁধারে ঢাকা, আলো দেখে না আগামীকাল
কত শিশু কাঁদে হারিয়ে মাকে, কেহ বা হারায় স্বজন
অদেখা সময়ের নিঠুর উপহাসে ছিঁড়ে যায় সব বন্ধন
অগোচরে কাঁদে বলিষ্ঠ হাত মেলে না আলোর দিশা
কীসের কারণে যাপনের পথ জুড়ে থাকে শুধু নিশা।
কেউ কী জানে ! মানুষই কেন অদৃষ্টের সহজ শিকার
ভুবন ভরা প্রাণের মাঝে নেই কী কোন অংশীদার
সকল প্রাণের আছে ক্ষুধা; তৃষ্ণা, প্রেম ভালোবাসা
সৌভাগ্যের প্রয়োজন একা মানুষের ! অন্যের নেই আশা
যাপনের রঙ্গ মঞ্ছের লুকোচুরি খেলা হয় না দৃষ্ট
ভরা নদীর স্রোতেও ভাসে না নাও, অলক্ষে অদৃষ্ট !
মাতব্বরদের বলছি
– বিভূতি দাস
সাধারণ ভাবনা ভাবুন আগে, বিশেষজ্ঞ হবার দরকার নেই
ধান ভাঙতে শিবের গীতের মতলবটা বুঝছে সবাই ।
মানুষের হাতে টাকা নেই, চাহিদা কী করে বাড়বে মশাই
সঞ্চয় যা ছিল হাতে সব গিয়েছে; কাজ বন্ধ, নেই কামাই
বে-রোজাগারে চাহিদা বাড়ে ? অর্থনীতির এ কোন দাওয়াই
জলের মত সহজ সত্য, এখনি শ্রমের বিনিময়ে নগদ চাই
ভিক্ষার দানে হয়ত ভরছে পেট, শুয়ে বসে কাটছে সময়
পরিকল্পনার অনেক হ্যাপা, গাঁট পেরোতে তিন নয় ছয়
ব্লকে ব্লকে মহল্লা ধরে কাজ করিয়ে নগদ টাকা দিলে হাতে
আস্থা আসবে দিনের শেষে, করবে খরচ বিভিন্ন খাতে
লকডাউনে যেখানে যে মাল আছে পড়ে বিকিয়ে যাবে
ব্যবসায়ী শ্রমিক কৃষক একই সাথে উপকার পাবে।
দেশে মাস মাইনের সংখ্যা কত, সেই তথ্য নয় অজানা
অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিক কত সেটা কী আছে সঠিক জানা
সংখ্যা সূত্রে করলে হিসাব কেনার ক্ষমতা এদের বেশী
এরাই যদি ভুগতে থাকে চাহিদাতে কি কাটবে নিশি
দোকান বাজার খুললে হবে ! কিনবে কে; কোথায় টাকা !
দিনের শেষে দেখা যাবে দোকানি মারছে মাছি একা একা
চারা লাগালেই হয়না ফসল, গাড়ি বাড়ি পরের ব্যাপার
ভারী ভারী নক্সা নয়; মানুষের চাই তাৎক্ষণিক উপকার।
দেশের স্বার্থে মানুষের জন্য পরিকল্পনা আসুক পিছু পিছু
মানুষ জানে সময় লাগে, হটাত করেই হয় না কিছু
জানা উচিত, কৃষি কাজ; মাছের চাষ বা অন্য যা কিছু আছে
আলাদা আলাদা দক্ষতা লাগে প্রতিপদে; এ কথা নয় মিছে
পৌঁছে গেছে বিপদ বার্তা মিডিয়ার কল্যাণে দেশের সকল কোণে
অতিমারিতে ত্রস্ত মানুষ চলবে নিশ্চয়ই সতর্ক হয়ে নিয়ম মেনে
সদিচ্ছার পথ সহজ হবে, নইলে পরিকল্পনায় ভাবের ঘরে সিঁদ
মাটিতে থেকেই বুঝতে হবে, পান্ডিত্যে নয়, নয় অর্থনীতিবিদ।
বাবু বলিলেন
– বিভূতি দাস
বিষের চারা করেছ রোপণ ছলনায় ভুলে
লালনে পালনে করেছ বড়; ভরেছে ফুলে ফলে
শিকড়েও তার বিষ, ঢালছে মাটির গভীরে
যে মাটিতে ছিল উর্বর বন্ধন; আজ অস্থির অন্তরে।
প্রতিনিয়ত অজানা শঙ্কার ছায়া কেড়েছে শান্তি
নীল আকাশ তমসায় ঢাকা; দিকে দিকে ভ্রান্তি
নিস্ফলা দিন ক্রমে বিভীষিকা; হতাশায় নবযৌবন
বিষ বৃক্ষের শ্বাসে অবিশ্বাস, চক্রান্তের নিশানায় বন্ধন।
অস্থির সবুজ অকালে হলুদ; সমাজ গুনছে প্রমাদ
বিষের শিকড় শোষণ করছে; নিঃশেষ সব আবাদ
রসহীন বুক ফেটে চৌচির; ছিন্নভিন্ন সচেতন ধারা
শ্রমিকের বাসনা নিভৃতে কাঁদে, শ্রম-স্রোতে জাগে চরা।
বিষের মহল্লায় শতরবে উল্লাস; ধনতন্ত্রে খুশীর বাতাস
লুটেরার হাতে লাঞ্ছিত মাটি; বাতাসে ভাসে দীর্ঘশ্বাস
হিংসার দাবানলে পুড়ছে মানুষ; পুড়ছে শিক্ষা সভ্যতা
ভুলের মাশুলে বিকোয় প্রীতি; একান্তে হাসে অজ্ঞতা।
কিছুই নয় চিরকালের, আসবে সময় ঘুরে ফিরে
মাটিকে দিও হাসি, বিষের শিকড় উপড়ে চিরতরে
সংশয় নয়; দূর হবে অভিশাপ নব চেতনার বন্ধনে
বন্ধা জমিতে ভরবে সবুজ, অন্তরের নিষ্কলুষ আহ্বানে।
বুঝলে রাজা
– বিভূতি দাস
রাজা সাজা নয়গো সোজা সে খুবই কঠিন সাজ
মানুষের চোখে যদি না পড়ে রাজপুরুষের কাজ।
যে মানুষ দুঃখে থাকে খাবার খোঁজে পথে ঘাটে
কী কোরে সে জানবে বল কোনটা ঠিক এই সমাজে
যে শ্রমিকের রোজাগারে চলে চারটে লোকের সংসার
কারখানাতে লাগলে তালা জীবন যে তার হয় জেরবার
কতদিন সে থাকবে ভুখা; নিত্য সইবে বিনা দোষে যন্ত্রনা
কোথায় পাবে আর একটা কাজ, কে দেবে তাকে সান্তনা
ঘরে অভাব; কেমন করে চাইবে সে সত্যের হোক জয়
নীতির অর্থ বুঝবে কখন, অন্নের চিন্তায় জাগে ভয়।
কথার প্যাঁচেই হয় কী সব, যদি না থাকে কথার মর্ম
পোশাক দিয়ে যায় না চেনা, না থাকলে রাজধর্ম।
অনেক লড়াই অনেক কষ্টে করল যারা খানিক লেখাপড়া
চাওয়াটা কী অন্যায় তার একটু নিশ্চিত জীবন গড়া
বে-রোজগারে বেকার জীবন, বাড়ছে বয়স তরতরিয়ে
স্বপ্নগুলো অধরা সব মনের জোর যায় হারিয়ে
ভাবনা ছিল; চাকরী একটা জুটিয়ে নেবে যোগ্যতার দামে
হাসি ফুটবে বাবা মায়ের, বেশী না হোক কমে
পরীক্ষা ইন্টারভিউ সবেতেই সফল, তবু চায় ঘুষের টাকা
গরীব ঘরে জন্ম যাদের, যেদিক তাকায় সেদিক ফাঁকা।
সঙ্গতিহীন জীবন যাত্রার কেউ বোঝে না ব্যাথা
আহা উহু বলে সমাজ, সবই কথার কথা।
বলতে নেই
– বিভূতি দাস
স্কুলের ছুটির শেষে পিছনে ধাক্কা খেয়ে
পড়ে গিয়ে রক্তাত হয়েছিলাম, চোখে আগুন নিয়ে উঠে
খুঁজেছিলাম, কে ধাক্কা দিয়েছে, মুখচিত্র দেখে
মা দৌড়ে এসে মুখে হাত চাপা দিয়ে, বলেছিলেন
সোনা… কিচ্ছু হয়নি, বাজে কথা বলতে নেই।
ঠাকুরের নারকোল নাড়ু চুরির দায় পড়েছিল ছোট্ট পিঠে
কাঁদতে কাঁদতে বলার চেষ্টা করেছিলাম, আমি করিনি
কেউ শোনেনি সে কথা, বলার চেষ্টা করেছিলাম কারো নাম
তখনো কাকিমা এসে চোখ মুছে দিয়ে বলেছিল
সোনা…, ঐ রকম বলতে নেই।
কৈশোরে খেলতে খেলতে অন্যায় ভাবে মারখেয়ে
যখন প্রতিদ্বন্দ্বী কে মাটিতে ফেলে মারতে উদ্যত হয়েছিলাম
তখনো পাড়ার কাকু এসে ছাড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন
তুমি তো ভালো ছেলে, এমন করতে নেই।
পরীক্ষার হলে টোকাটুকিতে নাম জড়িয়ে ছিল
প্রধান শিক্ষকের ঘরে গিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম
প্রধান শিক্ষক বাবা কে ডেকে পাঠিয়ে ছিলেন
বাবা বলেছিলেন শিক্ষকের সাথে তর্ক করতে নেই।
খেলার মাঠে রেফারির অন্যায় পেনাল্টির প্রতিবাদের ফলে
লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল
ক্লাব সভাপতির উপদেশ, এমন প্রতিবাদ না করলেই চলত
পরের খেলায় রির্জাভে রাখা হয়েছিল।
বসের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হওয়ার পুরস্কার
প্রমোশন পিছিয়ে গিয়েছিল
উনিয়নের নেতা বলেছিল, না বোল্লেই পারতে
পাড়ার দাদার অন্যায় দাবীর সাথে আপোষ না করলে
হুমকির শিকার হতেই হয় পরিবার পরিজনদের।
প্রতিবাদ হীন সত্তাই ভালোর প্রথম শর্ত
প্রতিরোধ হীন মানুষ সকলের কাছে ভালো
ন্যায় বিচার চাওয়া অন্যায়ের থেকেও বড় অপরাধ
গণতন্ত্রের চানাচুর স্বাস্থ্যকর না হলেও গিলতেই হয়
মেরুদণ্ড সোজা রাখার স্বাদ কোন কালেই মধুর নয়
এই বাক্যগুপ্তির সাথে যে মানুষের পরিচয় নেই
তাদের কথা শুনতে নেই, বলতে নেই … বলতে নেই।

কবি পরিচিতি
বিভূতি দাস। অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক। জন্ম ১৪ই ফেব্রুয়ারী, অভিভক্ত ২৪ পরগনার কৃষক পরিবারে। প্রকৃতির কোল ছুঁয়ে গ্রামে বেড়ে ওঠা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। ছাত্রাবস্থা থেকেই সৃষ্টির সাথে প্রেম। নেশা-লেখালিখি এবং ভ্রমণ। বর্তমান নিবাস – সোনারপুর, কলকাতা –৭০০ ১৪৯, ভারত।