কবিতার দান
– শুক্লা বোস
মোহবন্ধের পাশ কাটা দিশা কবিতার ভালোবাসা,
কবিতাকে ঘিরে তাইতো জীবনে নিত্য নতুন আশা।
সুখ-দুঃখ আশা-নিরাশার ভাষা ফোঁটে কবিতায়,
তাই বুঝি কবি অনলস শ্রমে কবিতাটি রচে যায়।
কাব্য কাননে যত ফুল ফোটে তার সুগন্ধ ধারা,
কাব্যপ্রেমীর মনের মাঝারে বয়ে চলে দিশাহারা।
কখনো কবিতা অস্ত্র-বুলেট,কখনো মৈত্রী পতাকা,
সাদা সাদা রঙা শান্তির দূত, বয়ে আনে শুভ বারতা।
সমাজের বুকে যত অনাচার, অবিচার প্রতিবাদ
প্রতিবাদী হয়ে কবিতা শেখায় মহা শোধনের পথ।
আজকে বিশ্ব কবিতা দিবসে স্মরি আমি ভাবনায়,
বিশ্বকবির সৃজিত কাব্য, মাথা নত শ্রদ্ধায়।
কবি নজরুল, জীবনানন্দ মহাকবি কালিদাস,
অমর প্রেমের গীত রচয়িতা সেই সে চন্ডিদাস।
যাদের মহান মহিমা সৃষ্টি মৃত্যুঞ্জয়ী ভাষা,
চির অমরতা কাব্য সৃজনে,মিটায় মনের তিয়াসা।
তোমাদের দানে, তোমাদের গানে পেয়েছি লেখার ক্ষমতা,
ভক্তি প্রণাম সপে দিনু পদে, ক্ষমা কোরো ব্যর্থতা।
চেতনায় স্বাধীনতা
– শুক্লা বোস
লক্ষ প্রাণের রক্তধারায় পেলাম স্বাধীনতা,
লৌহনিগড় বন্ধনডোর ছিন্ন অধীনতা
শোষকের রাঙা রক্ত চক্ষু উপড়ে নিয়েছে জনতা
মুক্ত মনের মুক্তিযোদ্ধা দিয়েছে স্বাধীনতা।
আমরা স্বাধীন, তবুও অধীন চেতনার দাবানল-
এখনো পোড়ায়, পুড়ছে মনন আঁখিধারা অবিরল।
এখনো শত্রু আনাচে-কানাচে উঁকি মারে সারাক্ষণ
স্বাধীনতা স্বাদ বাঁধে শৃঙ্খলে বুকে জ্বলে হুতাশন।
শহীদের দান স্বাধীনতা গান, গেয়ে চলি প্রীতিভরে,
জন্মভূমি যে সবার উপরে -চেতনাটি বুকে ধরে।
অমোঘ সম্বোধন
– শুক্লা বোস
মেয়ে আমার!কল্যাণী তু্ই, পবিত্রতায় জীবন ভরা,
রাখিস ধরে আঁচল ভরে তোর সংসার, শান্তিধারা।
তোর আঁচলের স্নিগ্ধ ছায়ায় অশান্ত এই জীবনভারা,
সান্ত্বনা পায় পরমসুখে, তু্ই যে মাগো ক্লান্তিহরা।
ভোর বিহানে সূর্য রাগে উঠিস জেগে কর্মময়ী,
লড়াই করিস যুদ্ধ জেতার, আপনা জীবন আপনি ক্ষয়ী।
স্বামী-শ্বশুর-দেওর-ভাসুর পরিজনে অসীম সুখে,
রয় চেয়ে রয় মুখপানে তোর, লুটাতে চায় স্নেহের বুকে।
মগ্ন ঘুম আর জাগরণে কেবল দেখা স্বপ্নটি তোর,
কেমন করে রাখবি ধরে তোর সংসার, দায়িত্বভার।
ভালোবাসা স্নেহের দানে রাখিস কিনে আত্মজনে,
অসীম মায়া বক্ষ জুড়ে জোৎস্না ঝরায় তোর মননে।
সুকোমলা সুকৌশলা, দিবানিশি স্নেহের পীড়ন,
বাঁধে তোরে অক্টপাশে,লৌহনিগড় জীবনধারণ।
শত কঠোর পরিশ্রমে পড়িস না তু্ই আপনি নুয়ে,
অন্তহীন ওই স্নেহের ধারা চুঁইয়ে নামে আঁচল ছুঁয়ে।
একটি “মা” ডাক তোর হৃদয়ে ঝরায় সুখের প্লাবনধারা,
একটি অমোঘ সম্বোধনে -তু্ই যে মাগো আত্মহারা।
মধুময় স্মৃতি
– শুক্লা বোস
চেতনা প্রবাহ মুছে দিয়ে যায় জমে থাকা যত ঋণ,
স্তব্ধ জীবনে কে বাজালো ফের পুরনো দিনের বীণ!
পুরনো দিনের স্মৃতিমাখা সুখ দুলিছে হিয়ার মাঝে,
ক্ষণে ক্ষণে আজ মদির আবেশ বিবশা হৃদয়ে রাজে।
মধু ছেলেবেলা, খেলা আর খেলা দিবানিশি মাতামাতি,
হারানো সাথীরা স্মৃতি মাঝে মোর জাগালো সুখের প্রীতি।
আগুন ঝরানো বশেখীর দিনে আঁখিপাতে নাহি ঘুম,
অলস দুপুরে সাথীদের সাথে আম কুড়ানোর ধুম।
নুন-ঝাল-তেলে জারানো আমের কুশী-র আচারে খুশি,
ঈশানে সহসা গুরু গুরু ধ্বনি, মেঘমালা রাশি রাশি।
বিরহিনী রাই
– শুক্লা বোস
চরণচিহ্ন রেখে গেছে শ্যাম, চলে গেছে মথুরায়
ধূলিরেণুগুলি বুকে ধরে রাধা কাঁদে আজ অসহায়।
লতানো বিতানে মাধবী ফুটেছে, উতলা পবন দোলে
কদম্বশাখে কচি কিশলয় আপনা দিয়েছে মেলে।
আগুন ঢালিছে বিরহ-বেদনা একাকিনী কাঁদে রাই
কোথা আছো তুমি শ্যাম নটবর, কোথা গেলে তোমা পাই।
তৃষিত হিয়ায় ঝলিছে বেদনা দারুন অগ্নিবানে
মরুতৃষা বুকে বিরহিনী রাধা কাঁদিছে আপনমনে।
মর্মে মর্মে গুঞ্জরি কাঁদে হারানো স্মৃতির ব্যথা
বিরহী ফাগুন কাঁদে আনমনে জাগে বুকে শত কথা।
ফাগুন আকাশে ভরা পূর্ণিমা, ঝুলনের সেই রাতি
কৃষ্ণসকাশে শত গোপী সনে নিধুবনে মাতামাতি।
ঝুলন দোলায় প্রাণের মেলায় দুলেছিলো শ্যাম সনে
আবিরের রঙে রাঙা তনুমন অনুক্ষণ জাগে প্রাণে।
ফাল্গুনী সেই পূর্ণিমা রাত কস্তুরীমৃগ সম
গন্ধমাতাল পাগলিনী রাই,খুঁজে ফেরে প্রিয়তম।
রাধা রাধা নামে সাধা সেই বাঁশি বাজেনা যমুনা তটে
উদাসী পবনে উন্মনা রাই খোঁজে শ্যামে ঘাটে ঘাটে।
রাধারে ভুলেছে নিঠুরিয়া কালা, সে যে আজ মহারাজা
জ্বালিয়ে অনল রাধা হৃদি মাঝে, প্রেমেরে দিয়েছে সাজা।
কঠোর বেদনা,দুঃসহ ব্যথা বুকে ধরে কাঁদে রাই
নীল যমুনারে শুধায় অধীরে, কোথা গেলে শ্যামে পাই!
এমুন মশা!
– শুক্লা বোস
হায় রে দশা!এমুন মশা!কুটকুটাইয়া খায়,
মোর মরণ আর তর যে খাওন, পরাণ রাহা দায়!
হুল ফুটাইয়া বিষ ছরাইয়া কোতায় উরি যায়,
বিষের জ্বালাই ছুঁইটা বেরাই উরাল পবন বায়।
ভ্যানভ্যানাইয়া ক্যানক্যানাইয়া কানের পানে ধাও,
চরথাপারি কিলকিলানী ঠাওর নাহি পাও।
কহন আহো, কহন বহো ট্যারটি না তো পাই,
বিষের জ্বলন ফুলাই গতর, জ্বলন অন্ত নাই!
রক্তখেকো কুটুস দানো, নাই রে মরণ তর,
আঁধার পালি ফুঁটাস হুলি, ফোলা গতর মোর।
মশারিডায় থাহে যদি এট্টুহানি ছেঁরা,
চুপচুপাইয়া ঢুইকা পরিস, পরিস না তো দরা।
চটপটাইয়া ফটফটাইয়া যতই মারি তরে,
ফাঁক পাইলে উইরা পালাস, কেইবা তরে দরে।
ম্যালোয়ারীর জীব-জীবাণু তর ওই প্যাডে বরি,
রাত্র-দিনে কাঁপাস জ্বরে!বাঁচাও অ-মা, “হরি!”
(আঞ্চলিক ভাষায় লেখা ছন্দ কবিতা।)
কবি পরিচিতি

শুক্লা বোস। মোংলা অঞ্চলের জ্ঞানের প্রধান বিদ্যাপীঠ শেলাবুনিয়ায় অবস্থিত সেন্ট পলস্ উচ্চ বিদ্যালয়-এর স্বার্থক ও কৃতি শিক্ষিকা। সুদীর্ঘকাল শিক্ষকতার পর শিক্ষার্থীদের প্রাণপ্রিয় এই শিক্ষিকা মার্চ ৪, ২০২০সাল থেকে অবসরে আছেন।
ছেলেবেলার থেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, জীবনানন্দ দাশ সহ বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য প্রথিতযশা কবি ও সাহিত্যিকদের লেখার সান্নিধ্যে বেড়ে উঠেছেন। কখনও কখনও লিখেছেন আত্মার সন্তুষ্টির জন্য। আত্মপ্রচারে বিমুখ হওয়ায় নিজের ভিতরেই রেখেছেন নিজেকে – তেমনভাবে বাইরে প্রকাশিত হয়ে ওঠা হয়নি।
বর্তমানে অবসর জীবনের একঘেঁয়েমি কাটিয়ে জীবনযাত্রায় কিছুটা ভিন্নতা ও বৈচিত্রের ভিতর দিয়ে সময় কাটানোর জন্যই বেছে নিয়েছেন বই পড়া ও লেখালেখিকে। সাহিত্যের মাধ্যমে মানুষের আত্মশুদ্ধি হোক, মানুষ সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠুক – এই প্রত্যাশাই তার ভাবনায় জীবন জুড়ে বিকশিত।