দেবকুমার মুখোপাধ্যায় – কবিতা (উচ্চারণ, গৃহপ্রবেশ, আমার শৈশবের কাছে, মহাজীবনের শিখা, মন কেমনের শীত)

উচ্চারণ

– দেবকুমার মুখোপাধ্যায়

তিনবার সত্যি বললে সব কিছু সত্যি হয়ে যায়?
মুখের চামড়ায় ধরা পড়ে নীলাভ আকাশ?
অমুকের পা ছুঁয়ে বলো
অমুকের দিব্যি কাটো মুখে
সত্য হাসে পরম কৌতুকে।

স্পর্শ করি জল, ভূমি, ছুঁয়ে যাই তৃণ
মুক্তির বাতাস আনে উদার দক্ষিণও —
এ সবে বিশ্বাস নেই?

মানুষের মুখের রেখায় জটিল, কুটিল দাগ
অতটা সহজ নয় তার পাঠ, তার বিশ্লেষণ
মনের পাতায় তাই চেরা দাগ, রক্তের ফোঁটা।

তিনবার সত্য উচ্চারণে কী আশ্বাস পাও
তিনবার আড়ি বললে আমি কিন্তু বিচ্ছেদ মানি না।

গৃহপ্রবেশ

– দেবকুমার মুখোপাধ্যায়

দেবতা এসেছেন ঘরে
ফলমূল উপাচারে তাঁকে আপ্যায়ন।
গৃহকর্ত্রী লাল পাড়, তসর শাড়িতে সেজে
ঘুরেফিরে দেখাচ্ছেন —
এইটি শোবার ঘর, এইটি বসার
এইখানে রান্না হবে, এইখানে খাওয়া,
এক চিলতে বারান্দায়
একটু বসে গল্পগুজব করা যাবে।

আমি দেখছি অন্যমনে
এইখানে টগর গাছ ছিল, এইখানে জবা
রোজকার পুজোর ফুল
ওরাই তো জোগান দিয়ে গেছে।
ঐ পাশে ভাঙাচোরা একটা ঘরে
পারুলদির বাস —
যুগ যুগ এ বাড়ির কাজের লোক।
পাশের ঘরটিতে
একান্নবর্তী হাঁড়ি ছড়াত ভাতের গন্ধ রোজ।

তেতো দিয়ে শুরু আর পরমান্নে শেষ
মধ্যান্হভোজন হয়ে গেলে
চোখেমুখে পরিতৃপ্তি আসে,
গৃহকর্তাকে ডেকে বলি —
বেশ ভালো ঘরবাড়ি
সব কিছু সুন্দর হয়েছে।

আমার শৈশবের কাছে

– দেবকুমার মুখোপাধ্যায়

কার হাত ধরে আজ​
আমার শৈশবের কাছে পৌঁছে যাবো!​

খেলার মাঠের বকুল গাছটা নেই,​
পঁচিশে বৈশাখের ভোরে​
তার ফুলের মালা পরাতাম​
রবিঠাকুরের গলায়।​
মাঠের একপাশে ছিল কলকে ফুলের গাছ​
সাদা ফুলের মাঝখানটায় হালকা হলুদ।​
কোমরভাঙা মানুষের মতো​
তার কান্ডটা মাটির ওপর কিছুটা উঠে​
ডালপালা মেলেছিল আকাশে।​
কয়েত বেলের গাছটাও আর নেই​
তার আচার মাখলেই জিভে আসত জল।​

কে কখন কেটে নিয়ে​
কোন চিন্হ রাখেনি তাদের।​
আর কেউ মাটিতে পোঁতেনি বকুল, কলকে​
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ কিংবা কয়েত বেলের গাছ।​

মানব সংসারে তবু পিতা পুত্র নাতিপুতি​
এসেছে, আসছে একে একে।​
পুরাতন ভিটাগুলি নিশ্চিন্হ করে দিচ্ছে তারা,​
শৈশব লুকিয়ে ছিল তাদেরও অন্দরে।​
সোমদেব, সন্তু, বিলে –​
খেলার সাথীরা সব চলে গেছে এদিকে ওদিকে।​

কেউ আছ?​
আমার শৈশবের কাছে নিয়ে যাবে​
তার সঙ্গে দুটো কথা ছিল।

মহাজীবনের শিখা

– দেবকুমার মুখোপাধ্যায়

জীবনের শিখা থেকে আগুন জ্বেলেছে,
সে – আগুন পোড়ায়নি, জ্বালিয়েছে আলো
স্নিগ্ধ দ্যুতি মনোরম বাতির শিখাটি
জ্বলে জ্বলে নিজেকেই নিঃশেষ করেছে।
কোণে কোণে জমে থাকা কত অন্ধকার
আলোকের স্পর্শে তারা ক্রমে দৃশ্যমান,
অনন্ত প্রতিজ্ঞা নিয়ে দিবস নিশীথ
অনির্বাণ শিখাটি জ্বলে দীপ্ত নির্ভীক।

দূর থেকে দেখেছিলে এই নিঃস্ব দেশ
অজ্ঞাতকুলশীল ও একাকী নির্জন,
চিরচেনা দেশ ছেড়ে স্বজাতি স্বজন
নিরন্ন ভূখন্ডে তবু বাঁধলে বসতি।
একান্ত আপনজন হলে আমাদের
মহাজীবনের শিখা তুমি নিবেদিতা।

মন কেমনের শীত

– দেবকুমার মুখোপাধ্যায়

গনগনে আঁচে ফুলে উঠছে রুটি,​
চারপাশে আমরা কজন​
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ আগুনের তাপে হাত সেঁকছি।​
সন্ধ্যেবেলা বিট, গাজর, টম্যাটো,​
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ কড়াইশুঁটির স্যালাড​
রাত্রে বেগুনপোড়া আর​
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ঝোলাগুড় দিয়ে রুটি।​

জানলার খড়খড়ি দিয়ে​
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ উত্তুরে হাওয়া আসে,​
ফাঁকে ফোকরে মা গুঁজে দিচ্ছে​
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ খবরের কাগজের টুকরো।​
মায়ের নিজের হাতে সেলাই করা​
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ কাঁথা গায়ে দিয়ে​
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ শীতের রাত্রি কখন পার হয়ে যায় –​
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ টের পাই না।​

নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যাওয়া সংসারে​
তবু কী সুখের ছিল​
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ সেই দিনগুলি রাতগুলি।​
আজ আর কোথাও সেই উষ্ণতার ছোঁয়া নেই​
কেবলই মন কেমনির শীত​
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ বছর বছর আসছে আর যাচ্ছে।


কবি পরিচিতি

জন্ম ১৯৫০। স্নাতক। অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ককর্মী।

ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির শুরু। কবিতা, ছড়া, ছোট গল্প, অণু গল্প, নিবন্ধ লিখে থাকেন। বড়দের জন্য, ছোটদের জন্যও। কিছু কিছু অনুবাদও করেছেন, ইংরেজি থেকে বাংলায় — কবিতার, গল্পের। বিভিন্ন পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়েছে ও হচ্ছে।

প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে — আসলে আলোর জন্যে, এখানে তরঙ্গ এখানে জীবন, জলের উপমা,অপ্রিয় শব্দমালা (এককভাবে), যাঁরা কবিতা পড়েন না (দুজনে মিলে), ছড়ার মজা খাস্তা গজা ও চার মাথার মোড় (চারজনে মিলে)।