দেবকুমার মুখোপাধ্যায় – কবিতা (শ্রী মধুসূদন, কৈশোরের ঘুড়ি, কথাবার্তা, কিশোরী মুখের জাদু, বন্ধুর স্বর)

শ্রী মধুসূদন

– দেবকুমার মুখোপাধ্যায়

সহসা দিগন্তে যেন বিদ্যুৎ চমক
মেঘে মেঘে দাপাদাপি ভীষণ গর্জন
বৃক্ষের শীর্ষে ঝড় কী উন্মত্ত আদিম
জলে স্থলে অন্তরীক্ষে বিপন্ন বিপ্লব।
বুঝি সব ধ্বংস হয় উদ্বেগ বিপুল
প্রাকৃত মানুয ত্রস্ত অভ্যস্ত নিগড়ে।

মিত্রাক্ষর ভেঙে যায়, মুগ্ধ কাব্যলোক
নূতন কাব্যের সৃষ্টি অমিত্র অক্ষরে।
বীররস, যুদ্ধ আর অস্ত্রের ঝঙ্কার
রামচন্দ্র নায়ক নন। যোগ্য রাবণ।

চতুর্দশপদী আনে দৃপ্ত সংহতি
কপোতাক্ষ, সাগরদাঁড়ি, এ বঙ্গভূমি
ভান্ডার সম্পূর্ণ কত অমূল্য সম্পদে।
ভূমিতে নিশান ওড়ে শ্রী মধুসূদন।

কৈশোরের ঘুড়ি

– দেবকুমার মুখোপাধ্যায়

কৈশোরের ঘুড়ি তুই কী অভ্রান্ত ছিলিস সেদিন
সুতো ধরে যতই টানুক
তুই কিছুতেই উড়বি না আকাশে,
দু পকেটে টোপাকুল
অবাধ্য কিশোর তবু
মাঠময় কেবলই দৌড়েছে।
আকাশে অনেক ঘুড়ি, তুই একা
মাটিতেই মুখ থুবড়ে মুখ থুবড়ে
নিজেকেই ছিঁড়ে ফেলেছিলি।

সেই থেকে সারাটি জীবন ধুলো মাখা
মাটিতেই অন্নজল, ঘরবাড়ি, শিকড়বাকড়
বস্তুত ঘাসের মতোই মাটি কামড়ে থাকা।

সিকিতে ঘুড়ির মায়া কৈশোরেই কেটে গেছে কবে
এখনও শীতের রোদে
বীণা হাতে সরস্বতী এলে
হাওয়ায় সুতোর প্যাঁচে
ভোকাট্টা ঘুড়ি উড়ে যায়।

কথাবার্তা

– দেবকুমার মুখোপাধ্যায়

সিঁড়ি ভেঙে উঠে যাও — দুই তিন চার তলা
কিংবা চলমান সিঁড়ি বেয়ে
পাঁচতলায় ওঠো,
আকাশকে কাছে পাবে
চন্দ্র, সূর্য, অগুণতি নক্ষত্রের আলো।

একতলায় সেজেগুজে তৈরি থাক পণ্যের পসরা
পথ চলতি মানুষেরা হাত বাড়ালেই পেয়ে যাবে।

মাটিও পণ্য এক,
ধুলো, কাদা, বালি ও কাঁকড়ভরা মাটি —
ও তোমার নয়,
মাটির সান্নিধ্যে থাকলে
লেগে যাবে কুকথার ছিটে।

প্রাচীনকে ভুলে গিয়ে
নব্য যা কিছু তার ধরো হাত,
ইটের মধ্যে নেই স্মৃতির বসতি,
ছেড়ে দাও পূর্ব পুরুষের তৈরি ভিটে।

এইসব কথাবার্তা বলে যাচ্ছে সম্প্রতি
বিলেতফেরত শিক্ষাবিদ
আর কিছু উলোঝুলো না-পড়া পন্ডিত,
প্রান্তিক মানুষ ভাবে ঠিক বিপরীত।

কিশোরী মুখের জাদু

– দেবকুমার মুখোপাধ্যায়

কোথাও না কোথাও দেখা হয়​
একান্তে নতজানু,​
সাক্ষাতে উদ্ধত শির​
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ নির্বাক, তন্ময়।​
বোবা চোখ — দৃষ্টি দূরে দূরে​
ক্লান্ত হয়, ব্যর্থ ঘুরে ঘুরে।​

কোথাও না কোথাও দেখা হলে​
মনের গোপনে কথা মাথা কোটে,​
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ সময় ত্রস্ত পায়ে চলে।​

অথচ অবুঝ মন​
চোখে চোখ রাখা বুঝি দায়,​
কিশোরী মুখের জাদু​
দু চোখের পল্লব কাঁপায়।

বন্ধুর স্বর

– দেবকুমার মুখোপাধ্যায়

চলভাষে সেইদিন ভেসে এলো বন্ধুর স্বর
যেন কতদিন পরে দেখা হল দুজনার সাথে,
কত পথ হেঁটে হেঁটে ফিরে গেছি নিজেদের ঘর।
চলভাষে সেইদিন ভেসে এলো বন্ধুর স্বর —
কেমন আছিস বল — দেখা নেই — তোর কী খবর?
অখন্ড সময় ছিল একদিন দুজনার হাতে।
চলভাষে সেইদিন ভেসে এলো বন্ধুর স্বর
যেন কতদিন পরে দেখা হল দুজনার সাথে।


কবি পরিচিতি

জন্ম ১৯৫০। স্নাতক। অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ককর্মী।

ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির শুরু। কবিতা, ছড়া, ছোট গল্প, অণু গল্প, নিবন্ধ লিখে থাকেন। বড়দের জন্য, ছোটদের জন্যও। কিছু কিছু অনুবাদও করেছেন, ইংরেজি থেকে বাংলায় — কবিতার, গল্পের। বিভিন্ন পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়েছে ও হচ্ছে।

প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে — আসলে আলোর জন্যে, এখানে তরঙ্গ এখানে জীবন, জলের উপমা,অপ্রিয় শব্দমালা (এককভাবে), যাঁরা কবিতা পড়েন না (দুজনে মিলে), ছড়ার মজা খাস্তা গজা ও চার মাথার মোড় (চারজনে মিলে)।