চন্দনা হালদার – বিশেষ প্রতিবেদন (কুমুদিনী হালদার – একজন জয়িতা মা)

কুমুদিনী হালদার – একজন জয়িতা মা

– চন্দনা হালদার

[ এ বছর ৯ ডিসেম্বর, ২০২১ তারিখে “রোকেয়া দিবস” উপলক্ষে মোংলা উপজেলা প্রশাসন ও মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে পাঁচজন নারীকে জয়িতা সম্মাননা দেওয়া হয় – সমাজ উন্নয়নে চাঁদপাই ইউনিয়নের দক্ষিণ কাইনমারী গ্রামের কমলা সরকার, সফল জননী চাঁদপাই ইউনিয়নের কাইনমারী গ্রামের কুমুদিনী হালদার, শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে পৌরশহরের কুমারখালির শেখ আব্দুস সালাম লেনের সালমা আক্তার, অর্থনৈতিক সাফল্যে মিঠাখালি ইউনিয়নের মৌখালি গ্রামের শিপ্রা ভক্ত এবং নির্যাতন বিভীষিকা মুছে ফেলা সফল নারী পৌরসভার নতুন কলোনির নাসিমা বেগম। জয়িতা সম্মাননায় ভূষিত এই নারীদের একজন – কুমুদিনী হালদার – সম্পর্কে লিখেছেন তার মেয়ে চন্দনা হালদার। অন্যদের সম্পর্কেও কেউ লেখা পাঠাতে ইচ্ছুক হলে যোগাযোগ করুন – vhatirdesh.com – এই ইমেইল ঠিকানায়। ]

আমার জয়িতা মায়ের নাম কুমুদিনী হালদার। মায়ের পিতা সহদেব হালদার (ঢালী) এবং মাতা চিন্তামনির জ্যেষ্ঠা সন্তান তিনি। শৈশব কেটেছে তার মোংলার ঠাকুরন (ঠারন) বাড়িতে, পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক অধিগ্রহণের মাধ্যমে স্থানটি মোংলা বন্দর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

মায়ের বাবা, মা, ঠাকুরদাদা (রাম ঢালী) শিক্ষানুরাগী ছিলেন। স্থানীয় ভাবে তখনকার সময়ে মেয়েদের শিক্ষার খুব একটা প্রচলন থাকা না সত্ত্বেও মাকে তার পরিবার সুশিক্ষিতা করতে চেয়েছিলেন। বাড়িতে বাবার কাছে মা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ১ম ভাগ এবং ২য় ভাগ বর্ণপরিচয় শিক্ষা সমাপ্ত করে সে সময়ের কেওড়াতলা পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন। পাঠশালার একমাত্র শিক্ষয়িত্রী ছিলেন গিরিবালা দিদিমনি (খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী)। প্রাথমিক শিক্ষা চলাকালীন সময়ে মায়ের পরিবারকে বাস্তুচুত হতে হয়। ১৯৫০ সালে মোংলা বন্দর প্রতিষ্ঠাকল্পে মায়ের ঠাকুরদাদা রাম ঢালীর বাস্তুভিটা সহ অন্যান্য জমাজমি সরকার কর্তৃক অধিগ্রহণের ফলে মায়ের পরিবার কাইনমারী গ্রামে আশ্রিত হন। কাইনমারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে (বর্তমান নাম- কাইনমারী সরকারী মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়) মা এবং তার ছোট ভাই প্রভাস, দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ালেখা শুরু করেন। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মা এবং তার ছোট ভাইকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভালো ফলাফল অর্জনের কারণে ডাবল প্রমোশন দিয়ে ৪র্থ শ্রেণিতে উন্নিত করেন। এর পর ৫ম শ্রেণী সমাপ্ত করে দুই ভাইবোন মোংলার শেলাবুনিয়ায় নবনির্মিত সেন্ট পলস উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। তৎকালীন গ্রামীণ সমাজে নারীদের উচ্চ শিক্ষার বিশেষ প্রসার না থাকায় বিদ্যালয়ের শিক্ষক মণ্ডলীসহ সমাজের সচেতন ব্যাক্তিবর্গ এবং পারিবারিক প্রচেষ্টায় মায়ের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন ভালই চলছিলো। এর মধ্যে গ্রীষ্মের এক প্রচণ্ড খরাতপ্ত দুপুরে হঠাৎ কলেরা আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ অবস্থায় স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে মায়ের সহপাঠী দু বছরের ছোট ভাই মারা যান। অতি আদরের ছোট ভাইকে হারিয়ে মা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। ফলে মায়ের শিক্ষা ব্যবস্থায় ছেদ পড়ে। বিশেষ কারণ বশতঃ সেসময় সেন্ট পলস উচ্চ বিদ্যালয়ে মেয়েদের শিক্ষাক্রম অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। লেখাপড়ার প্রতি মায়ের আগ্রহকে গুরুত্ব দিয়ে মায়ের পরিবার মাকে মির্জাপুরে কুমুদিনী ট্রাস্টে পড়ানোর পরিকল্পনা এবং সেমত ব্যবস্থা করেন। ভাগ্যের বিড়ম্বনায় মায়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সেই ইচ্ছা পূরণ হয়নি এবং এখানেই মায়ের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবনের অবসান ঘটে।

মোংলা উপজেলার ২০২১ সালে বেগম রোকেয়া দিবসে জয়িতা সম্মাননা প্রাপ্ত সফল জননী চাঁদপাই ইউনিয়নের কাইনমারী গ্রামের কুমুদিনী হালদার

মায়ের বিবাহ পরবর্তী জীবনে স্বামী হিসেবে আমার বাবা মনোরঞ্জন হালদারকে পেয়েছিলেন একজন শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি হিসেবে। মা তার নিজের জীবনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অপূর্ণতা তাদের সন্তানদেরকে উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করার মাধ্যমে পূর্ণতা দিতে চেষ্টা করে গিয়েছেন। এ কারণে ১৯৭১-এ সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশে নিদারুণ দুঃখ কষ্ট ও আর্থিক অনটনের মধ্য দিয়েও আমার মা-বাবা সন্তানদের সুশিক্ষিত করার লক্ষ্যে আমাদের জন্য সাধ্যমত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। তাদের সেই প্রচেষ্টার সফলতা হিসেবে তাঁদের চার মেয়ে স্নাকত্তর (সম্মানসহ স্নাতক) এবং দুই ছেলে স্নাতক শিক্ষা সম্পন্ন করতে সফল হয়। ফলে সবাই এখন নিজ নিজ কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠা অর্জন করতে সমর্থ হয়েছেন।

২০২১ সালে বেগম রোকেয়া দিবসে জয়িতা পুরস্কারপ্রাপ্ত কুমুদিনী হালদার – মোংলা সরকারি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ও মোংলা উপজেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি অধ্যাপক সুনিল কুমার বিশ্বাসের সাথে

স্থানীয় সমাজে উৎসাহী, সাহসী, উপকারী এবং প্রগতিশীল নারী হিসেবে মায়ের ভুমিকা অনন্য। স্বল্প আয়ের বিরাট সংসার পরিচালনার পাশাপাশি সমসাময়িক সামাজিক নানা কর্মকাণ্ডে আমার মা নিজেকে সব সময় নিয়োজিত রেখেছেন। বিভিন্ন সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থায় স্বেচ্ছাসেবিকা হিসেবে জীবনভর মা অবিরত কাজ করেছেন এবং করে যাচ্ছেন নিম্ন উল্লেখিত নানা প্রকল্পে।

  • বাংলাদেশ গ্রামীণ সরকারের ব্যাবস্থাপনায় এলাকার নিরক্ষর মহিলাদের স্বাক্ষরতা দান করেছেন।
  • এলাকায় শিক্ষা প্রসার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সহায়তার জন্য স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কাইনমারী সরকারী মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এবং মালগাজী গার্লস স্কুল পরিচালনার কার্যকরী কমিটিতে সদস্য এবং সভাপতি হিসেবে দীর্ঘ বছর যাবত দায়িত্ব পালন করেছেন। স্কুলের নিয়মিত শিক্ষকদের অনুপস্থিতিতে অনিয়মিত শিক্ষক হিসেবে শ্রেনিকক্ষে পাঠদান করেছেন।
  • স্থানীয় NGO কারিতাস বাংলাদেশ-এর স্বাস্থকর্মী হিসেবে দীর্ঘ দিন ধরে পেশাগতভাবে এবং স্বেচ্ছাসেবিকা হিসেবে কাজ করেছেন।
  • বাংলাদেশ সরকারের অনুদানে গ্রামীণ নারী ও পানি উন্নয়নের লক্ষ্যে স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সেমিনারে অংশ গ্রহন করেছেন এবং গ্রামীণ জনসাধারণকে পানি ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সচেতন করেছেন। ফলক্রমে, আমাদের এলাকায় খাবার পানি সচেতনতা বৃদ্ধি, পানি সংশোধন এবং সংরক্ষণে পানি শোধন ট্যাংক ব্যবস্থার প্রচলন ঘটেছে।
  • সরকারী এবং বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহয়তা দানে এলাকায় জরীপ এবং স্বাস্থ্য খাতে (শিশুদের পলিও, ভিটামিন এ খাওয়ানো কার্যক্রমে) সর্বদা স্বেচ্ছাসেবিকা হিসেবে কাজ করেছেন।
  • মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে সাহসী নারী হিসেবে স্থানীয় জনগনকে সাহস যুগিয়েছেন এবং সাহায্য করেছেন।
  • সাম্প্রতিক সময়ে স্থানীয় NGO, কারিতাস বাংলাদেশ-এর SDDB, জার্মান সরকার ফান্ড প্রকল্পের অধীনে কর্মক্ষেত্রে প্রবীণ, প্রতিবন্ধী ও মাদকাসক্ত ব্যক্তি সমন্বয় কার্যক্রমে চাঁদপাই ইউনিয়ন ‘জবা কুসুম ক্লাব’ এ পর্যায়ক্রমে হিসাব রক্ষক, সম্পাদক এবং সদস্য হিসেবে কাজ করে চলেছেন।
  • বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, মা তাঁর নিজ জীবনের শিক্ষার অপূর্ণতা তাঁর সন্তানদের শিক্ষাজীবন এবং কর্মজীবনে গতি সঞ্চার করেছেন সফল্ভাবে এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবন শেষে সন্তানদেরকে কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মায়ের জীবন পূর্ণতা পেয়েছে।

এ বছর রোকেয়া দিবসে মাকে সফল জননী হিসাবে জয়িতা সম্মাননা প্রদানের মাধ্যমে তাঁর উপরোল্লেখিত অবদান ও সাফল্যের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। মায়ের এই অর্জনে মাকে আমরা বিশেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। এছাড়া আশা করছি মায়ের এই বিশেষ সম্মাননা অর্জন সকল নারীদেরকে অনুপ্রাণিত ও উদ্ভুদ্ধ করবে বেগম রোকেয়ার আদর্শে পরিবার ও সমাজ সেবার মহান ব্রতে। মোংলা উপজেলা প্রশাসন এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও নির্বাচকমন্ডলীর প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

২০২১ সালে বেগম রোকেয়া দিবসে মোংলা উপজেলার অন্যান্য জয়িতা সম্মাননা প্রাপ্তদের এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও আয়োজনকারীদের সাথে

পরিচিতি

চন্দনা হালদার। বাবা – মনোরঞ্জন হালদার, মা – কুমুদিনী হালদার। জন্ম – বাগেরহাট জেলার মোংলা উপজেলার কাইনমারী গ্রামে। মোংলার সেন্ট পলস উচ্চ বিদ্যালয়ে শিশু শ্রেণী থেকে এস,এস,সি এবং মোংলা সরকারী কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এইচ, এস,সি পড়াশুনা। পরবর্তীতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞান বিভাগে বি,এস,সি(অনার্স) এবং এম,এস,সি – পরবর্তিতে রাজশাহী টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বি,পি,এড সম্পন্ন। পেশাগত জীবনে খুলনা, বটিয়াঘাটা উপজেলার খগেদ্রনাথ মহিলা কলেজে মনোবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপনা। বিবাহিত জীবনের শুরুতে স্বামী ড. দেবদুলাল মল্লিক (তপু) অ্যামেরিকার এমোরি ইউনিভার্সিটিতে পি,এইচ,ডি করাকালীন সময়ে নিজ পেশা ছেড়ে অ্যামেরিকাতে সংসার জীবন শুরু। জীবন পরিক্রমায় স্বামী দেবদুলাল মল্লিক অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের ডিকিন(Deakin) ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা করার সূত্রে মেয়ে খনা এবং ছেলে ঈশান কে নিয়ে বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস। কর্মজীবনে প্রত্যাবর্তন প্রয়াসে অষ্ট্রেলিয়াতেই এখন Education Support বিষয়ে কোর্সে পড়াশুনা চলছে।

মোংলার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা এবং শৈশব থেকেই কবিতা আবৃত্তি ও লেখালেখিতে হাতেখড়ি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশুনার সময়ে বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্র থেকে ছোটোদের “কলকাকলি” অনুষ্ঠানে নিজের লেখা কবিতা প্রচারিত হয়। অনুষ্ঠান প্রচারকদের উৎসাহে অনুপ্রাণিত হয়ে তখন থেকেই শখের বশে ছড়া, কবিতা, ছোট গল্প, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা লেখা শুরু হয়। তবে তা দ্বিধার গণ্ডি ছাড়িয়ে খুব একটা প্রকাশিত হয় নি কখনো! ছাত্রীকালীন সময়ে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিতা পড়া ছাড়াও নাচের চর্চা ছিল – বাংলাদেশের জাতীয় পর্যায়ে পালিত দিবসগুলো সহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অন্য সব অনুষ্ঠানগুলিতে নাচ পরিবেশন ছিল অনিয়মিত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও মোংলার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা ছিল নিয়মিত। গনশিল্পী মোংলা শাখা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সংগঠন “অরনি” এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আবৃত্তি সংগঠন “স্বনন”-এর একজন আবৃত্তি কর্মী হিসেবে আবৃত্তি চর্চা ছিল নিয়ত। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় পরবাসী জীবন যাপনের মধ্যেও মাতৃভাষা বাংলাভাষা চর্চার প্রয়াসে কবিতা পড়া – এরই একটি ক্ষুদ্র প্রয়াস।