মাতলা পেরিয়ে
– বিভূতি দাস
১
১৯৮৬ র এক ছুটির সন্ধ্যায় বন্ধুরা আড্ডা দিতে দিতে পিকনিকের প্রসঙ্গ ওঠে। একথা সেকথায় চা খেতে খেতে আচমকাই ঠিক হল জানুয়ারী মাসের (1986) চতুর্থ সপ্তাহের শনিবার বাঘের ডেরায় যাওয়া হবে দুই দিন এক রাত্রির জন্য। যারা আড্ডায় ছিলাম তারা ঠিক করে নিলাম কে কাকে খবর দেবে, কি কি নেওয়া হবে, খাওয়া হবে, নৌকায় নাকি লঞ্চে যাওয়া হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। নামের লিস্ট হল, দায়িত্ব ঠিক হয়ে গেল, বেশ একটা উন্মাদনা। হাতে মাত্র এক সপ্তাহ সময়, সব ঠিক করে ফেলতে হবে। পরের দিন থেকেই শুরু করে দুই দিনের মধ্যেই সব হয়ে গেল। নৌকা ভাড়া করা, খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা, সরকারি অনুমোদন নেওয়া, খরচাপাতির হিসাব করে মাথাপিছু চাঁদার সাম্ভাব্য হার ইত্যাদি। মোট ২৬ জনের দল, কিন্তু ২২ জন অবিবাহিত, অতএব নো ঝামেলা, বাঘ দেখতে যাওয়া ঠেকায় কে।
দেখতে দেখতে শনিবার এল, সকাল সাতটার ক্যানিং লোকালের কামরায় পুরো দল সেঁধিয়ে গেল, সকলের কাছেই ব্যাগে কিছু না কিছু স্টক, ক্যানিং ষ্টেশনে পৌঁছে নৌকার কর্ণধার হৃদয় মণ্ডলের সাথে এগিয়ে চলা নদীর দিকে যেখানে বাঁধা আছে আমাদের জলযান, একটা মেশিন চালিত নৌকা, সামনের দিকটা অনেকটা লঞ্চের মতই। হৃদয় মণ্ডল শুধু মাঝিই নয় উনি একজন প্রাথমিক শিক্ষক, বেশ ভালো মানুষ। এই নৌকাটি হৃদয় মণ্ডলের নিজের এবং নিজেই এই রকম ছোট দলের ট্রিপ করেন। হৃদয় বাবু ছাড়াও আরো তিন জন আছে নৌকায় রান্না ও অন্যান্য কাজের জন্য, সর্ব মোট ৩০ জন সদস্য। তিথি অনুযায়ী এখন রাত এবং দুপুরে গন। সকালে ভাটা শুরু হয়েছে, এখন প্রায় অর্ধেক ভাটা হয়ে গেছে, তাই দেরী না করে ৯টা নাগাদ নৌকা ছেড়ে দেওয়া হল, নাহলে চরায় আটকে থাকতে হবে দুপুরের জোয়ারের অপেক্ষায়। লুচি, আলুরদম, জয়নগরের মোয়া দিয়ে সকালের টিফিন সারা হল। প্রায় একঘণ্টা নৌকা চলছে ভট ভট করে যান্ত্রিক শব্দ তুলে, যে যার মত নৌকার খোলে, ছাদে, এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে গল্প গুজবে, কেউ বা তাসে, কেউ বা ছবি তোলায়, কেউ কেউ পানে ব্যস্ত। নৌকার পিছন দিকে ছাদের এক পাশে চট ঘেরা জায়গায় রান্নার ব্যবস্থা হয়েছে, সবাই বেশ খুশী মনে সকালের রোদ্দুর গায়ে মেখে মৌতাতে।

আমাদের নৌকা নদীর ডান তীর ঘেঁসে চলছিল কিন্তু হঠাৎ বেশী পরিমাণ ধোঁয়া ছেড়ে নৌকা কাত হয়ে থেমে যায়। সবাই ভয় পেয়ে এ ওর মুখের দিকে তাকায়, কেউ কেউ বলতে লাগল এত ছোট নৌকায় লোক বেশী হয়ে গেছে, এটা ঠিক হয়নি, ডাঙ্গার জিনিস জলে পড়লে যেমন হয়। হৃদয়দা আশ্বস্ত করেন কিচ্ছু হবেনা, আপনারা বেশী দাপাদাপি করবেন না। পরে বোঝা গেল নৌকা চরায় আটকেছে, অনেক কসরতের পর নৌকা সচল হল। নৌকা এখন থেকে মাঝ নদীতে চলতে লাগল কিন্তু এখানেও বিপদ, যারা এতক্ষণ বেশ স্থির হয়ে বসে ছিল তারা কয়েক জন সুধার ঘোরে দাপাদাপি শুরু করল, নৌকাও দুলতে লাগল। কেউ কেউ আপত্তি করল বটে কিন্তু কে শোনে কার কথা। যাইহোক সকলের মধ্যেই একটা চাপা উত্তেজনা, বেশির ভাগেরই নৌকায় (ভুট ভুটিতে) ভ্রমণ এই প্রথম। নারানতলা, গোলাবাড়ি, পুরন্দর পেরিয়ে নৌকা বাসন্তীর দিকে এগিয়ে চলেছে। প্লান মত বাসন্তীর লঞ্চ ঘাটে নৌকা থামে, কথা ছিল এখানে স্নান সেরে নেওয়া হবে। গায়ে তেল মেখে তিন চার জন ঝাঁপিয়ে পড়ে নদীর নোনা জলে, কোন বারণের তোয়াক্কা না করেই। যদিও শীতকালের নদী শান্ত, হাঙরের ভয় তেমন থাকে না, তবুও কি হতে কি হয়ে যায় সেই চিন্তা তো থাকেই। বাকিরা বালতি দিয়ে জল তুলে জেঠিতে, নৌকার উপরে দাঁড়িয়ে স্নান সেরে নিল।
২
নৌকার ছাদে বসে, পিঠে শীতের রোদ্দুর লাগিয়ে সব্বাই একসাথে দুই সারিতে খেতে বসা। ভাত, মুগেরডাল, বেগুনি, ফুলকফি কষা, রুই কালিয়া, চাটনি, পাঁপর সহযোগে দুপুরের খাওয়া সারা, ততক্ষণে নৌকা বাঁদিকে পাঠানখালি পেরিয়ে গোসাবার দিকে এগিয়ে চলেছে। গোসাবায় এক ঘণ্টার যাত্রা বিরতি। এই সময়ের মধ্যে গোসাবা বাজারের শেষে হ্যামিল্টনের বাংলো্, পানীয় জলের পুকুর, কাঠ জ্বালিয়ে বিদ্যুৎ তৈরির কেন্দ্র এবং লঞ্চ ঘাটের সামনেই হ্যামিল্টনের রেস্ট হাউস দেখে আবার যাত্রা শুরু, গন্তব্য পাখির আলা হয়ে সজনেখালি। নৌকায় ফিরে সবাই বেশ খানিকটা ঝিমিয়ে পড়েছে, বেশ কয়েক জন চাদর ঢেকে শুয়ে পড়েছে, কেউ কেউ হেলান দিয়ে পা ছাড়িয়ে আধা ঘুমে, কেউ বা উদাস চোখে নদী দেখছে, বোঝা যাচ্ছে ধকল নিতে পারছে না। এখানে নদীর পরিসর তেমন বিস্তৃত নয়, ডানদিকে ত্রিভুজাকৃতি বিরাজমনি ঘাট, বাঁদিকে গোসাবাকে রেখে আমরা সোজা দক্ষিণ দিকে এগিয়ে চললাম পাখির আলার দিকে। শীতের আকাশ, আলোর পরিমাণ কম, তাড়াতাড়ি যেতে হবে, হৃদয়দা নৌকার স্পীড বাড়িয়ে দেয়।।
দেখতে দেখতে নৌকা পাখির আলা (পাখির আলয়) কে ডান দিকে রেখে আরো এগিয়ে যেতে দেখা মিলল বেশ কিছু পাখির, বানর এবং বন্য শুকরের (বরাহ), ওরা নদীর চরে খাবারের সন্ধানে ইতস্তত ঘুরছে। জানা গেল এই বানর মাছ খায়। একটু দূরে সজনেখালি ব্যাঘ্র প্রকল্পের সাইনবোর্ড দেখা যাচ্ছে। আমাদের নৌকা সজনেখালি ঘাটে পৌঁছায়। এখানে অনুমোদনের কপি দেখিয়ে টাকা জমা দিয়ে সবাই প্রকল্পের ভিতরে একটি পুকুরের পাড় দিয়ে এগিয়ে গেলাম, দেখা গেল প্রকল্পের কর্মীরা বড় বড় বালতিতে ভেজানো ছোলা নিয়ে ঐ পাড়ের উপর দাঁড়িয়ে মুখে আওয়াজ করছে এবং বালতির ডাং বালতিতে ঠুকে ঠূকে আওয়াজ করছে, বোধহয় ওরা কাউকে ডাকছে বা জানান দিচ্ছে খাবার এসে গেছে। চার দিকেই কেওড়া গাছের জঙ্গল, হাঁটু ডোবা কাদা নাসিকা মুলে সাজানো, ছোট বড় নানা সাইজের গাছ। এই গাছের ডালে ডালে বন মোরগ, বানররা হাজির ছোলার লোভে। চারদিকের নিস্তব্ধতা খান খান হয়ে যাচ্ছে বালতির আওয়াজে। কিছুক্ষণ পরে নিজেদের চোখকেও বিশ্বাস হচ্ছিলনা, সবাই অবাক হয়ে দেখলাম ছোট, বড় মিলিয়ে বেশ কিছু হরিণ কেওড়ার জঙ্গলের আড়াল থেকে ধীর পায়ে, সতর্ক চোখে বেরিয়ে আসছে ছোলা খেতে। শীতের শেষ বিকেলে এদের চেহারা, চোখ দেখে সবাই উচ্ছ্বসিত, কিন্তু কাছে যাওয়ার অনুমতি নেই। অনেকটা দূরেই পর্যটকদের আটকে দেওয়া হয়েছে। শুধু হরিণ নয়, নেমে এসেছে বানর ও মোরগের দল। বানর গুলো হরিণের পিঠের উপর বসছে, নামছে, দৌড়াচ্ছে বন্ধুর মত। আধ ঘণ্টার মধ্যে খাওয়া শেষ করে আবার জঙ্গলের মধ্যে মিলিয়ে গেল হরিণের দল এবং অন্যরাও। প্রকল্পের পুকুরে কয়েকটা ভাঙন মাছ, ছোট ছোট

ঘড়িয়াল দেখা গেল। আট দশ ফুট উঁচুতে, নদীর থেকে প্রায় দশ মিটার দূরে কয়েকটা কাঠের ঘর দেখা গেল, খোঁজ নিয়ে জানা গেল এই গুলো বনবাংলো, আগে থেকে বুকিং করলে তবেই পাওয়া যায়। দেখা শেষ, আবার নৌকায় ফেরার পালা, আরো এক সদস্য আমাদের দলের সাথে যোগ হল, পরের দিনের গাইড হিসাবে। আসলে পরের দিনেই শুরু হবে আসল জঙ্গল ও রাজ দর্শন অভিযান। বন দপ্তরকে মূল্য চুকিয়ে এই গাইড নিতে হয়, কাজে না লাগলেও।
সন্ধ্যা নামছে, নদীর তীরে, জঙ্গলের মাঝে হাল্কা কুয়াশা আরো রহস্যময় করে তুলছে সমস্ত পরিবেশ কে। আমরা নৌকায় ফিরলাম, ঘাট থেকে নৌকা ছাড়তে হল অন্ধকার হবার আগেই, এটাই নিয়ম। রাতে ঘাটে কোন জলযান থাকতে দেয়না, নিরাপত্তার কারণে। ঘাট থেকে বেশ কিছুটা দূরে মাঝ নদীতে নোঙর করল আমাদের জলযান (নৌকা), এখানেই রাত্রি বাস।
৩
নদীতে এখন ভাটার টান, পেটেও বেশ টান ধরেছে। ঘরে ভাজা সুস্বাদু মুড়ি, বেগুনি ও চা সহযোগে সন্ধ্যার টিফিন সারা হল। চারদিকে অন্ধকার, তবে জলের মাঝে অন্ধকার অতটা গাঢ় নয়, বেশ পাতলা। ঠান্ডা বাতাস দিলেও নোনা জল ও নদীর কারণে শীতটা বেশ কমই লাগছে। কিছুটা দূরে আরো কয়েকটা পর্যটক লঞ্চ নোঙর করেছে, জেনারেটারের আলো নদীর জলে পড়েছে, বেশ লাগছে এই নিস্তব্ধতার মাঝে। তবে আমাদের নৌকায় জেনারেটার নেই, আলো বলতে তিনটি হারিকেন আর গোটা দুই টর্চের আলো, অন্য লঞ্চের আলো দেখেই আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছিল। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত বাড়ছে, রাতের রান্না চলছে। সবাই গল্প গুজবে ব্যস্ত উত্তাপহীন সন্ধ্যার আকাশে তারা গোনা আর বাকি পানীয় শেষ করা।
ঠিক সাড়ে আট্টায় রাতের খাবার রেডি, ভাত, আলুভাজা, মুসুর ডাল ও মাছের কালিয়া। সাড়ে নটার মধ্যে খাবার পাঠ চুকল। নৌকার খোলে, ছাদে চট বিছিয়ে তার উপর তোষক, চাদর দিয়ে বিছানা। যার যেখানে ইচ্ছা শুয়ে পড়ল, সারা দিনের ক্লান্তি আর প্রকৃতির অপার ভালবাসার কোলে ঘুম আসতে দেরী হল না। পরের দিনের যাত্রা পথ নিয়ে, রাতে জোয়ার বাড়লে কাছিতে টান ধরবে কিনা এই সব নানান বিষয়ে হৃদয়দার সাথে কিছু আলোচনা করে সব কিছু উপর ওয়ালাকে সঁপে শুয়ে পড়লাম।
আগেই কথা হয়েছিল ভোর বেলা আমাদেরকে নদীর পাড়ে প্রাতকৃতের জন্য নামিয়ে দিয়ে হৃদয়দা খাবার, রান্নার জল আনতে যাবে। সেই মত সবাই নেমে এদিক ওদিক কাজ সারতে গেলাম। আসে পাশে লোকালয় নেই, ধান কাটার পর নেড়া জমি গুলো শীতের হিমে শুয়ে আছে, তার মধ্যে কেবল আমরাই নড়াচড়া করছি। প্রায় ৪৫মিনিট পর নৌকা ফিরল আমরাও একে একে উঠে পড়লাম, গরম চা বিস্কুট দিয়ে সকাল শুরু হল। নৌকা এখন বড় নদী ধরে নেতা ধোপানির ঘাটের পথে। যেতে যেতে একটা চরে বেশ কয়েকটা বিশালাকার কুমীরের সাথে দেখা, ওরা চরে শুয়ে শীতের রোদ পোয়াচ্ছিল, আমাদের নৌকার শব্দে নদীতে নেমে নৌকার দিকেই ভেসে রইল, কিছুটা যে ভয় লাগেনি তা নয়। এভাবে ঘণ্টা দেড়েক চলার পর নেতার ঘাটে পৌঁছালাম। এখানেও কুমীরের দেখা পেলাম, বিরাট চেহারা নিয়ে নদীতে ভেসে আছে, ঘাটের যেখানে নামলাম সেখানেই আরো একটা, কেউ একজন চিৎকার করে করল, কুমীর, কুমীর – সাবধান, সাবধান। ঘাটের পাশে দুই জন জঙ্গল রক্ষী দুনলা বন্ধুক নিয়ে দাঁড়িয়ে, আমরা জিজ্ঞাস করলাম এখানেই থাকেন রাত্রে! রক্ষীরা মাথা নেড়ে হাঁ জানাল, কোথায় থাকেন? ওরা একটা ঘরওয়ালা নৌকা দেখিয়ে দিল, আমরা অবাক হয়ে বললাম এখানেই! একজন মজা করে বলে উঠল বাঘ এসে এই বন্দুক চেয়ে নিয়ে গেলে কি করবেন? মাটির বাঁধের দুই পাশে প্রায় দশ ফুট উঁচু তারের জাল দিয়ে ঘেরা, সেখান দিয়ে এগিয়ে ওয়াচ টাওয়ারের দিকে গেলাম। প্রায় ১৫/১৬ ফুট উঁচু শালের খুঁটির উপর কাঠের তৈরি ঘর সেখান থেকে অনেকটা দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে তবে মহারাজের

দেখা নেই। তারের জালের বাহিরে তার পদচিহ্ন অবশ্য দেখেছিলাম। আমাদের গাইড মুখস্ত পড়ার মত খানিক ইতিহাস শোনাল, মিষ্টি জলের পুকুর দেখিয়ে জানাল ওখানে রাতের বেলায় মহারাজ জল খেতে আসেন। পুরো দলের ছবি তোলা হল ন্যাশানাল-৩৫, বি সি স্প্রিন্টি ক্যামেরায়। বিদায় নেতা ধোপানি, নৌকায় এসে লুচি, আলুরদম, মিষ্টি সহযোগে জলখাবার। এগিয়ে চললাম আরো দক্ষিণ দিকে পরের গন্তব্যে, অবশ্য আর কোথাও নামার অনুমোদন নেই, ব্যবস্থাও ছিলনা। কিছুটা যাবার পর খাঁড়ি পথে ঢুকে পড়লাম, এখন বেশ অনেকটা জোয়ার হয়েছে, নদী ভরে উঠছে, জেগে থাকা তীর ডুবছে, দুপাশের হেলে থাকা গাছের ডাল মাথায় লাগছে, গাছের ডালে সাপ, বাঁদরের সহবস্থান। নৌকায় এখন দুপুরের রান্নার প্রস্তুতি, মুরগি ছাড়ানো চলছে।

৪
একের পর এক খাঁড়ি পথে গা ছম ছম করা পরিবেশে আমাদের জলযান ভট ভট আওয়াজ করে এগিয়ে চলেছে, কারুর মুখে কথা নেই, নিবিড় অরণ্যরাজির রাজ্যে, জানিনা ভয়ে নাকি মুগ্ধতায়।
একটা বাঁকের মুখে গাছের ডালে সদ্য বাঁধা সাদা থান কাপড় ঝুলতে দেখে গাইডকে জিজ্ঞাস করলাম, কি ব্যাপার? সে বলল, এখানে বাঘে মানুষ মেরেছে এটা তার নিশানা, যাতে জেলেরা সাবধান হয়। এই খাঁড়ি পথে একমাত্র জেলেরাই যায়, লঞ্চ চলতে পারে না, ভাটার সময় এই সব খাঁড়িতে কাঁকড়া ধরা হয়। বিরামহীন যাত্রায় নৌকা চলছেই, গাইড মাঝে মাঝে আঙ্গুল তুলে কিছু বলছে বটে, তবে সকলের কানে সে কথা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পরে ডান দিকে নদীর কিনারা ঘেঁসে জঙ্গলের একটা জায়গায় একটা বড় টিনের পাতে তীর চিহ্ন দিয়ে লেখা বাংলাদেশ, বোঝা গেল বাম দিকটা বাংলাদেশ চলে গিয়েছে। সবাই বেশ ভয় পাচ্ছিলাম জল দস্যুর কথা ভেবে, জল সীমার কথা ভেবে, প্রায় সবাই সরকারি চাকুরে, ধরা পড়লে কেল্লা ফতে।
নৌকা এখন পশ্চিম দিকে চলছে বড় নদীর দিকে, দুপাশের তীরে নিবিড় হেতালের জঙ্গল, খেঁজুর পাতার মত পাতা, তবে ভীষন মসৃন, চকচকে। মনে হচ্ছিল হেতাল গাছ গুলো কেউ সারি দিয়ে লাগিয়েছে, হটাৎ দেখা গেল দূরে কিছু একটা ভেসে আসছে, অপর পার হতে। একজন বায়নাকুলারে দেখে বলে উঠল বাঘ, বাঘ। আমাদের নৌকাও এগোতে লাগল সেই দিকেই, আরো অনেকটা গিয়ে বোঝা গেল দুটি বরাহ একসাথে নদী পার হচ্ছে। আমরা বেড় দিলাম, ওরা নৌকার গায়ে মুখ ঘষল কিন্তু ভয় পেলনা। আমাদের একজন বলে উঠল, আরে তুলে নে, মহাভোজ হবে। গাইড বলল নিশ্চই বাঘের তাড়া খেয়ে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছে, না হলে এভাবে এত বড় নদী পার হয়না, ছবি তোলা হল এই প্রাণী দুটির।

আরো খানিক এগিয়ে যে নদীতে পড়লাম সেখানে আমাদের নৌকাটি মোচার খোলার মত দুলছে, এতটাই তার ব্যাপ্তি অপর পার দেখা যাচ্ছে না, আমাদের দুপুরের খাওয়া চলছে, নদীর জল পান্না সবুজ, টল টল করছে কিন্তু কোন ঢেউ নেই, কেবল মাথার উপর সূর্য আর আমরা এই কয়েক জন, চোখে মুখে এক অজানা আতঙ্কের ছায়া। যাইহোক, ঘণ্টা খানেক চলার পর দূরে জঙ্গল দেখা গেল, গাইড জানালো এটি কলস দ্বীপ, আমরাও এগোতে থাকলাম ফেরার পথে। তিনটে নাগাদ কয়েকটা জেলে নৌকার দেখা পাওয়া গেল, তাদের জিজ্ঞাস করা হল ক্যানিং কোন দিকে, কিন্তু আমরা যে দিক থেকে আসছিলাম সেই দিকেই দেখিয়ে দিল। হৃদয়দা বললেন, নাহ এরা ঠিক বলছে না। আমরা সুর্যকে বাঁদিকে রেখে সামনের দিকে এগোতে লাগলাম। জঙ্গলের মাথার উপর দিয়ে সূর্যটা ডুবছে, সবাই জিজ্ঞাস করছে আর কতটা সময় নেবে ক্যানিং। অনেক দূরে একটা বিশালাকৃতি খড়ের নৌকা দেখা গেল বিন্দুর মত, বুঝলাম লোকালয় আছে, আমরাও সেই দিকেই (উত্তর) দিকে এগোতে লাগলাম। সন্ধ্যা নেমেছে, খাবার জল ফুরিয়ে গেছে দুপুরের পরেই, হৃদয়দা কানে কানে বল্লেন, জালানি তেল ফুরিয়ে আসছে। হৃদয়দার পাশে বসে শীতের মধ্যেও ঘামছি, অনেকেই জিজ্ঞাস করল শরীর খারাপ লাগছে কি না? নদী পথের বিপদ সম্বন্ধে যথেষ্ট ধারণা থাকায় দুশ্চিন্তার মেঘ ঘাম ঝরাচ্ছে, কিন্তু বাকিরা ভয় পাবে তাই চুপচাপ। অবশেষে রাত্রি ৯টায় মাতলা পেরিয়ে ক্যানিং, এডভেঞ্চারের সমাপ্তিতে, সব বন্ধুর মুখে হাসি, জড়িয়ে ধরল হাত।

পরিচিতি
বিভূতি দাস। অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক। জন্ম ১৪ই ফেব্রুয়ারী, অভিভক্ত ২৪ পরগনার কৃষক পরিবারে। প্রকৃতির কোল ছুঁয়ে গ্রামে বেড়ে ওঠা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। ছাত্রাবস্থা থেকেই সৃষ্টির সাথে প্রেম। নেশা-লেখালিখি এবং ভ্রমণ। বর্তমান নিবাস – সোনারপুর, কলকাতা –৭০০ ১৪৯, ভারত।