আত্মার অতিথি
– বিভূতি দাস
দখিনের সর্দার পাড়া থেকে অনেকটা পথ পেরিয়ে শিশির ভেজা মাদলের শব্দ ভেসে আসছে, প্রকৃতি এখন অন্য রকম। চারিদিকে আধপাকা ধান মাথা নুইয়ে কি ভাবছে কি জানে, উপরে এক আকাশ জ্যোৎস্না, শিশির জড়ানো শিশু হেমন্ত চুপচাপ নিশিসুধা পান করছে। রাত আরো গভীর হচ্ছে, উত্তরের পাড়া থেকে আসরে আসা দুই বন্ধু বাড়ীর পথ ধরে। পথ মানে, কখনো খানিক কাদায় ভরা মাটির রাস্তা, ধানেভরা জমির আল, ছোট ছোট নাসি, মাছ ধরার জন্য লাফার পাশে ধানগাছ গুলোকে চুলের সিঁথির মত করে দুদিকে ফেলে তার উপর দিয়ে অন্ধকারের নিজস্ব আলোয় চলা। সাপখোপের ভয় যে নেই এমন নয়, অন্য প্রাণীকে সতর্ক করতে বা নিজেদের সাহস ধরে রাখার জন্য ওরা ধুপধাপ করে চলেছে সাথে আসরের মাদকতা, ওরা এসবে অভ্যস্ত।
মাঝে মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাড়ী গুলো ঝোপের মত দেখা যাচ্ছে, নিস্তব্ধ চরাচরে কিছু নিশাচর আর দুরে ঐ মাদলের শব্দে এক অদ্ভুত নৈসর্গকিক যুগল বন্দী। সুধীর আর উপেন হাঁড়িয়ার নিমন্ত্রণ রক্ষা করে ফিরছে তিরশ বত্রিশের উঠতি গ্রাম্য যুবক, ভয়ডর ওরা পাত্তা দেয়না। আর প্রায়শই এই রকম নিমন্ত্রণ কোন না কোন পাড়ায় থাকে। বুকে সাহস, চেনা পথ, পেট ভর্তি হাঁড়িয়া, আর কি চাই। সুধীর বলে তুই যা, আমার তো এসে গেল। উপেন একবার দাঁড়ায়, বলে আচ্ছা। উপেনকে এখন মাঝের ঘেরী, দুটো নালা পেরিয়ে আসতে হবে। কাদা, জল, ধানের সিঁথি, মাছধরার লাফা ( লাফা > ধান ক্ষেতের মাঝে ছোট ছোট জায়গা কাদার আল দিয়ে ঘেরা, যেখানটায় জল থাকেনা, মাটি লেপে সমান করে দেওয়া থাকে, মাছ লাফিয়ে ঐ খানে পড়লে আর যেতে পারেনা) সব পেরিয়েই উপেন একলা আসছে। মনে হাড়িয়ার দোল, তাজা যুবক, আর এই রাত। ওর বাড়ীর সব্বাই ঘুমিয়ে আছে, মা, বাবা, ভাই, বউ, মেয়ে সব্বাই। এটাই দস্তুর, গ্রামের মানুষ সারাদিন খাটাখাটনি করে, তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে।
উপেনের মা স্বপ্ন দেখছে, উপেনের দিদিমা বলছে দ্যাখনা তোর মেজ ছেলের সাথে আমি কেমন মজা করছি, ছোঁড়ার খুব সাহস আছেরে পটল। এ ছোঁড়া ঐ সুরেনদের বাড়িতে হাঁড়িয়ার নেমতন্ন খেতে গেছল। আমার সাথে পথে দেখা হল, আমিও গপ্প করতে করতে ওর সাথে হাঁটা দিলুম। তবে একটু চোখে চোখে রাখিস, উটতি ছোঁড়া, দখিন পাড়ার আদিবাসি মাগী গুলো তো বেশ ডাগর ডোগর, তারপর মদ গিল্লে আর কারো হুঁশ থাকেনা, কে কার কাছে শুচ্ছে, কার মরদ কোথায়। পুরুষ মানুষের আর দোষ কি, গায়ে এসে পড়লে ভাব ভাবনা এক থাকে ?
উপেন নিজের মনে ফিরছে তাড়া নেই, চলতে চলতে রাউতদের ঝিলের পাশে পৌঁছে হঠাৎ খেয়াল করে একটা লাফায় কেউ বসে আছে। উপেন ভাবে, যে লাফা দিয়েছে সেই হয়ত বসে আছে, মাছ কুড়াচ্ছে। এই সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে আরো কাছাকাছি পোঁছায়, কিন্তু কোন সাড়া পায়না। উপেন ভাবে ধান পাকছে, হয়ত ওর মা কচিটা কে বসিয়ে রেখে ধান চুরি করতে গেছে। কয়েক হাত দূরথেকে অন্ধকারে যতটা বুঝতে পারছে বাচ্ছাটার গায়ের রঙ মিশমিশে কালো, ঐ যেমন ছেলে পুলে কিছুক্ষন আগেও সে ওর বন্ধুর বাড়িতে দেখে এসেছে। এবার উপেন কয়েক মুহুর্ত দাঁড়ায়, গলা খাঁকারি দেয়, তাতেও কোন হেল দোল চোখে পড়েনা। উপেন এবার খুব জোরে হাঁক দেয়, এই মাগী কেরে ধান মুলছিস, কিন্তু কোন সাড়া শব্দ নেই, তার আওয়াজ রাতের নিস্তব্ধতাকে ছিন্ন করে আবার যেন তার কাছেই ফিরে আসে। উপেন চারপাশ যতটা দেখা সম্ভব ভালো করে দেখতে থাকে, কোথাও ধানগাছ নড়ছে কিনা। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারেনা। উপেন আরো একটু এগিয়ে আসে, খুব জোরে বলে ওঠে এই কচি, তুই কেরে, তোর সাথে কে আছে ? কিন্তু সে যেমন ছিল তেমন বসে আছে, নড়ন চড়ন কিছুই নেই। উপেন এক মুহুর্ত ভাবে, নিচু হয়ে ওর মুখ দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু এরপর উপেনের শিরদাঁড়ায় শীতল স্রোত, সে যা দেখল তাতে আর নেশার ঘোর থাকার কথা নয়। বেশ কয়েকটা কই, ল্যাঠা মাছের মাথা লাফার উপর পড়ে আছে, আর যে বসে আছে তার চোখ যেন আগুনের গোলা। উপেন এবার খুব জোরে হাঁক দেয়, এই মাগীরা কে আছিস, কোথায় তোরা ?
উপেন একটু পিছিয়ে এসে পাশ কাটিয়ে কোন রকমে ধানের ক্ষেতের মধ্যেদিয়ে এগুতে থাকে, এখানে ছোটার উপায় নেই, চারিদিকে ধান আর কাদা-জল। অনেক কষ্টে নিজেদের পুকুর পাড়ে এসে পৌঁছায় উপেন, হাতে পায়ের কাদা ধুয়ে বাড়িতে ঢোকে, ততক্ষণে এই হেমন্তের রাতেও ঘেমে-নেয়ে অস্থির। বউকে ডাকে, সে না ঊঠেই বলে ওখানে ভাত ঢাকা আছে খেয়ে নাও। উপেন মাটির দাওয়ায় বসে থাকে খানিক, তারপর পিতলের ঘটিতে রাখা সব জলটা গলায় ঢালে।
এমন সময় উপেন দেখতে পায় একটা লাল কুকুর, যাকে সে আজ প্রথম দেখছে, পাঁচিলের উপর লাফালাফি করছে, একবার এদিক, একবার ওদিক। উপেন চোখ কচলে ভালো করে দেখে, আর হাতের কাছে থাকা পিতলের ঘটিটা সজোরে বাঁহাত দিয়ে ছুড়ে মারে। ঘটিটা মাটির দেওয়ালে লেগে সেখানেই গড়িয়ে পড়ে। নিস্তব্ধ চরাচরে এই সামান্য শব্দেই উপেনের মার ঘুম ভেঙ্গে যায়, স্বপ্নের কথা মনে পড়ে, ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে আসে, কেরোসিন কুপির আলোয় উপেন কে দেখে বলে তুই কি এখন এলি ? কেন যে এত রাতে ফিরিস ! যা যা শুয়ে পড়, খেয়েছিস ? উপেন উত্তর দেয়না, ভাবছে আর ঘামছে, ওর মা গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়, এবার ধমকের সুরে বলে যা এখনি শুয়ে পড়, যা বলছি। ঘরে বউ, বাচ্ছা ফেলে বন্ধুর বাড়ীতে ? চমকে ওঠে উপেন, সেতো বাড়ীর কাউকে কিছু বলেনি ।।
খুলির বালিশ
– বিভূতি দাস
কার্তিকের অমাবস্যা, রাতের পরিস্কার আকাশে সব্বাই স্বমহিমায়। পায়ের নিচে হেমন্তের হিমে ভেজা ঘাস, আদিগন্ত সদ্য প্রসবিত কাঁচা ধানের মাঠ, দূরে দু-চারটে গাছ আর খড়ের চালের বাড়ি গুলোতে লেপটে আছে অমাবস্যার মায়াবী অন্ধকার। মাত্র আটটা বাজে, দু-একটা রাতজাগা প্রাণী ছাড়া এখানে আর কেউ জেগে নেই। নিতাইয়ের ঘুম আসেনা, রাত বারোটার আগে তার ঘুমানোর অভ্যাস নেই। সে আজ দূপুরেই এসেছে, কাজের একঘেয়েমি কাটিয়ে একটু ফ্রেস হতে। একটা সিগারেট ধরিয়ে বাড়ির পিছনে কাঁচা রাস্তার উপর এসে দাঁড়ায়। এই রাস্তাটা পশ্চিম দিকের নদী বাঁধ থেকে পূর্ব দিকের নদী বাঁধে গিয়ে মিশেছে। কিছু না ভেবে সে পূর্ব দিকে এগুতে থাকে, হালদার পাড়া পেরিয়ে সোজা পূর্ব দিকের নদীবাঁধে পৌঁছে যায়। এখন রাত্রে -দূপুরে গন (জোয়ার) তাই জোয়ার লেগেছে। নদীবাঁধ ধরে একটু এগুতেই, নিতাই গাঁজার গন্ধ পায়, আরো এগিয়ে যেতেই তার কানে আসে, কে যায় ? পাতলা অন্ধকারে দেখতে পায় বাঁধের কোলে কুঁজি থেকে (পাহারা ঘর) এক ছায়া মুর্তি উঠে দাঁড়িয়েছে।
নিতাই বাঁধের উপর দঁড়িয়ে ভাল করে দেখার চেষ্টা করে। আস্তে আস্তে ছায়া মুর্তি এগিয়ে এসে, বলে কি ব্যাপার এতো রাতে ছোটভাই ! এসো এসো, একটা শুকনো ঘসের ঢিপি দেখিয়ে বসতে বলে, দু-চার কথা হয়। সে বলে, সকালে মাছ দিয়ে আসবে, ভিতরে যাও, বাইরে হিম পড়ছে, শরীর খারাপ হবে। প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে ভিতরে গিয়ে বসে নিতাই। বেশ আরাম দায়ক জায়গাটা। নিতাই বুঝতে পারে, শুকনো চুঁচকো ঘাসের উপর একটা খেঁজুর পাতার চ্যাটাই বিছানো, এতক্ষনে সে হাতের টর্চ লাইটা একবার জালায়, দেখে নেয়। বিদঘুটে রকম গন্ধ নাকে আসে তার, অনেকটা মাছ বা শামুক পচা গন্ধের মত। নিতাই বলে, একটা পচা গন্ধ আসছে না ! লোকটি উত্তর দেয় ঐ মাছ-টাছ পড়ে আছে, জাল শুকাচ্ছে, হবে হয়ত। নিতাই কথা বলতে বলতে একটু কাত হয়ে শুয়ে পড়ে, শুনতে পায় একটা অদ্ভুত আওয়াজ। সে কিছু না বলে, অন্ধকারে আধা শোয়া অবস্থায় বোঝার চেষ্টা করে, ঠিক কী ঘটছে।
আরো কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, বুঝতে পারে মাথার দিকে কিছু একটা আছে। নিতাই জিজ্ঞাস করে, এই ঘাসের নিচে কি রেখেছ? লোকটা খানিক চুপ থাকে – বলে, না কিছু না, ওই মাটির উপর শুকনো ঘাস। কিছুক্ষন দুজনেই চুপচাপ, কেবল নিশ্বাস আর নদীর জলের শব্দ। ছোটভাই, ফিরবে তো! মেজবাবু জানে ? তুমি এখানে? নিতাই উঠে বসে, হামা গুড়ি দিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ায়। লোকটা খিক খিক করে হেসে ওঠে, নিতাই ঘুরে দাঁড়িয়ে টর্চ মেরে দেখতে পায় লোকটা ময়লা কাপড়ে জড়ান কিছু একটা নিয়ে নিয়ে চালার বাইরে আসছে। লোকটা বলে আলোটা নেভাও ছোটভাই। লোকটা বাইরে এসে কাপড় টা সরায়, একটা মানুষের গোটা খুলি দেখিয়ে বলে এটা আমার বালিশ। ওই পাগলী বিদ্যেধরি মহালয়ার রাতের জোয়ারে ভাসিয়ে এনেছে, কে জানে কার।

পরিচিতি
বিভূতি দাস। অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক। জন্ম ১৪ই ফেব্রুয়ারী, অভিভক্ত ২৪ পরগনার কৃষক পরিবারে। প্রকৃতির কোল ছুঁয়ে গ্রামে বেড়ে ওঠা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। ছাত্রাবস্থা থেকেই সৃষ্টির সাথে প্রেম। নেশা-লেখালিখি এবং ভ্রমণ। বর্তমান নিবাস – সোনারপুর, কলকাতা –৭০০ ১৪৯, ভারত।