কিস্তি মাত
– বিভূতি দাস
কে সাজালে এমন করে খেলা শেষের ঘুঁটি
ওলট পালট সব চিত্র, ভাঙলে পরিপাটি
লোক লস্কর চেনা জানা সবাই থাকে সরে
কে কোথা যায় কেউ জানে না কোন পথেতে ঘুরে
কোথায় গোসল আচার বিচার; মাটি নাকি আগুন
কেইবা শোনায় ধর্ম কথা, শেষ যাত্রার কানুন
মোড়ক খুলে কেউ দ্যাখে না, লেবেল টুকুই সব
যন্ত্রে তোলে যন্ত্রে নামায়, হয় না কলরব
চেনা-অচেনায় নেই বিবাদ, ধর্মে আঁটিসুঁটি
কে সাজালে এমন করে শেষ যাত্রার ঘুঁটি।
নানা পরিচয়ে ভিন্ন মতের যাচ্ছে সবাই একসাথে
দরজা আঁটা লোহার খাঁচায় গাদাগাদি কোনমতে
নেই অভিযোগ নেই গোঁসা, বলে না হচ্ছে কসুর
সর্বভুকের বাসর ঘরে ঠাঁই মিলবে সকল বপুর
মায়ার বাঁধন আলগা হতে গেল সকল বাঁধন টুটি
কে সাজালে এমন করে কিস্তি মাতের ঘুঁটি ।
প্রগতিশীল
– বিভূতি দাস
আমরা সব্বাই প্রগতিশীল, তার চেয়ে বেশী স্বার্থপর
ঈর্ষা লোভ মোহের থাবায় দীর্ণ মন; ছানবিন চরাচর
স্বার্থের নেশায় লুপ্ত হিতাহিত; মানবতা আসলেই মেকী
লুটের অধিকার কায়েমে মগ্ন মন, বাকী সব ফাঁকি
লুটের সম্পদ অর্থে সর্বদাই অহমিকার নিত্য দাপাদাপি
ছুঁড়ে দিই দান-খয়রাত; নতুন শিকারের খোঁজে পথ হাঁটি
লোভ হয় না নিবারিত; সুযোগের অপেক্ষায় হই ধৈর্যশীল
বাতাসে দুর্যোগের সৌরভ পেলেই, উৎফুল্ল মন হয় প্রগতিশীল।
১২টার লঞ্চ
– বিভূতি দাস
ডিজেল পোড়া একরাশ কালো ধোঁয়া বাতাসে ভাসিয়ে
১২ টার লঞ্চটা ঘাট ছেড়ে গেল; গনগনে রোদ মেখে
একটা পাক খেয়ে দক্ষিণে মুখ ঘুরিয়ে ঢেউ কেটে চলতে লাগল
একবার মাত্র দেখতে পেয়েছিলাম জানালা থেকে তুমি হাত নাড়ছ
মাতলার ঢেউ ভাঙার শব্দ ছাপিয়ে ইঞ্জিনের গোঙানি শুনছিলাম
কালো ধোঁয়ারা উড়ে এসে বলে যাচ্ছিল; তুমি কবিতার বইয়ে মগ্ন
আমি আর পারিনি, ভেসে পড়লাম গাং চিলের পাখায়, লঞ্চের পিছনে পিছনে
লঞ্চের প্রপেলারে আহত মাছের লোভে ওরা, আমি কবিতা শোনার নেশায়
বন্ধু তুমি তো কথা দিয়েছিলে, ফিরে এসে আমাকে নতুন কবিতা শোনাবে
ঢেউয়ের মাথায় নাচতে নাচতে তোমার লঞ্চ ধীরে ধীরে দৃষ্টি পথের বাহিরে
কালো ধোঁয়াও এক সময় মেঘের দেশ মিলিয়ে গেল, জন শূন্য হল লঞ্চ ঘাট
আমি একা রোদ মেখে দাঁড়িয়ে ছিলাম, দেখলাম নদীর জলে ভাটার টান
প্রতিটা ঢেউ একটা একটা পংক্তি উপহার দিচ্ছিল, যেন কবিতার বান
গোধুলি নামল নদীর বুক ছুঁয়ে, কালো কালো জেলে নৌকা গুলো জাল গোটালো।
সেই থেকে আজো অনন্ত সময় দাঁড়িয়ে আছি; ১২টার লঞ্চ ঘাটে
তোমার প্রিয় কবিতা নিয়ে, মাতলার ঢেউ গুনে চেতনে অচেতনে
ছয় ঋতুর একদিনও ভুল হয়নি জানো, যতক্ষণ দেখা যায় ততক্ষণ
গাংচিলের পাখায় ভেসে যেতে যেতে বার বার খুঁজেছি তোমায়
তোমার প্রিয় কবিতাগুলো যে আমার বুকের মাঝে, শোনানো হয়নি
জানি না; কতকাল তোমার ভালো লাগাকে এমন করে আগলাবো
আমার ছোট্ট নৌকা যদি ছাড়ার সময় হয়ে যায়, মাঝি ডাক দেয়
আমি চলে গেলে, তুমি লঞ্চ নিয়ে আমাকে খুঁজো, তোমার কবিতার জন্য।
দুর্গতির হাসি
– বিভূতি দাস
তৃণভোজী নয়, সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীবের এমন দুর্গতি !
বিরামহীন, কার শাপে; পাপে; মরছে রাশি রাশি
বাতাস পৌঁছে দেয় ঘ্রাণ, আহা গৃধ্রের ধরে না হাসি।
গৃধ্র-গৃধিনী চক্কর কেটে নেমে আসে, শুনশান মরা চরে
গুটি গুটি পায়ে বুঝে নেয় কোনটা বুড়ো, কোনটা কচি
অস্থি-চর্ম সার বুড়োকে অপছন্দ, কচিতেই স্বচ্ছন্দ গৃধ্র রুচি।
তীক্ষ্ণ চঞ্চুতে ছিঁড়ে উত্তমাঙ্গ ; গৃধ্রের স্বরে উল্লাসের হাসি
বাকিরা একযোগে খুবলে ছিঁড়ে খায় জীবনের সব স্বপ্ন
ঘাসে ঘসে চঞ্চু, গ্রীবা বেঁকিয়ে পালক খুঁটে ঝেড়ে নেয় যত্ন
সংকেতে বলে সাথীদের, আমরা নিমিত্ত মাত্র; অগতির শশী
বাসায় ফিরে স্বস্তির শ্বাস; ভাবে, সত্যিই ছিল অশেষ পুণ্য
স্রষ্টা মহান, জেনে বুঝেই করেছে গৃধ্র, দেয়নি মানব জন্ম।
প্রতারক
– বিভূতি দাস
মানুষ এখন নিজের সাথেই করে অদ্ভুত সব ছলনা
আয়নাটা উল্টে রেখে ডায়লগে করে দেবী বন্দনা
হাবে ভাবে গদগদ, ভাষাতে ভক্তির বান মন্দ না
ভালোবাসার গলা টিপে মেরে; চোখে কুমীরের কান্না
অজুহাতের সস্তা চমক শরীর জুড়ে, করে পণ্ডশ্রম
ভালো থাকার শেষ ঠিকানা, আহা তুলনাহীন বৃদ্ধাশ্রম !
নিজেই নিজের প্রতারক, মানুষ দাঁড়ায় না আয়নার সামনে
স্মৃতিচারনায় অশেষ মিথ্যা; ডায়লগে বাঁচে একটা দিনে
সুখ মৃগয়ায় সঁপে জীবন ধরে বাজী নানান উপচারে
চোখের জলে দুস্থ সময় চিন্ময়ী মা কাটায় অগোচরে
ডায়লগ সুত্রেই আসত যদি প্রতিটি সকাল শ্রদ্ধার দর্শনে
ঠিক কতটা সুখ কম হত, হিসাব মেলে না মনে ।

কবি পরিচিতি
বিভূতি দাস। অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক। জন্ম ১৪ই ফেব্রুয়ারী, অভিভক্ত ২৪ পরগনার কৃষক পরিবারে। প্রকৃতির কোল ছুঁয়ে গ্রামে বেড়ে ওঠা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। ছাত্রাবস্থা থেকেই সৃষ্টির সাথে প্রেম। নেশা-লেখালিখি এবং ভ্রমণ। বর্তমান নিবাস – সোনারপুর, কলকাতা –৭০০ ১৪৯, ভারত।