নর হলেই পুরুষ নয়
– অজিত কুমার কর
পৌরুষ না যদি থাকে কীসের পুরুষ
হাজার মুখের ভিড়ে ক’জন মানুষ।
উচ্চ শির দৃঢ়চেতা শৌর্য বীর্যবান
তাহলেই পদবাচ্য অগাধ সম্মান।
পুরুষকারের জয় হবে সুনিশ্চয়
আপদে বিপদে পথে জোগাবে অভয়।
শারীরিক শক্তি দেখে হয় না বিচার
অন্তরে না যদি থাকে, শৌক্ল্য সত্যিকার।
সুসংযত আচরণে পৌরুষ প্রকাশ
পাণ্ডিত্য বিচার্য নয়, বুদ্ধি একরাশ।
আদর্শ পুরুষ কোথা, জগতে দুর্লভ
ভূমণ্ডলে তাঁর থেকে ছড়াবে সৌরভ।
সত্যবান, বামাক্ষ্যাপা, রামকৃষ্ণ, নল
উচ্চমার্গে বিচরণ সংকল্পে অটল।
পুরুষের পৌরুষত্ব, নারীর নারীত্ব
এ যে তাঁর অলংকার, শুচিস্নিগ্ধ চিত্ত।
উচ্চবিত্ত নিম্নবিত্ত করি ভেদাভেদ
খুঁজি না পৌরুষ তাঁর, কার শূন্য ক্লেদ।
সুবাস বিলায় পুষ্প আয়ু যতক্ষণ
পৌরুষে সম্প্রীতি বৃদ্ধি অদৃশ্য বন্ধন।
রয়েছি ঠিক পিছে
– অজিত কুমার কর
আমার ছায়া পড়েনি ওই জলে
তাই বিরহে যাচ্ছো তুমি জ্বলে!
পিছনেই তো আছি
খুবই কাছাকাছি
অঙ্গভূষণ তোমার কী ঝলমলে!
ভাবছি আমি যাব অন্যদিকে
দূরে গেলে, দৃষ্টি হবে ফিকে।
নামবো চুপিসারে
ছায়ার অন্ধকারে
ডুবসাঁতারে থাকতে পারি টিকে।
শাপলাপাতা ভাসছে জলে কত
ব্যাগড়া দিচ্ছে আমায় অবিরত।
সরাচ্ছি দুই হাতে
কষ্ট হচ্ছে তাতে
একটু-আধটু ক্ষত হচ্ছে গা’তে।
হুশ করে যেই উঠবো আমি গিয়ে
দেবো তোমায় সহসা চমকিয়ে।
উঠবে তুমি হেসে
টানবো ভালোবেসে
কাটবো সাঁতার তখন তোমায় নিয়ে।
জানি আমি সাঁতার তুমি জানো
তাই বলোনি, ‘কেন আমায় টানো’।
পেলাম শালুক খুঁজে
দিলাম খোঁপায় গুঁজে
জুড়ালো গা’ জুড়িয়ে গেল প্রাণও।
কোথায় সুজন
– অজিত কুমার কর
জন্মলগ্ন থেকেই আমি যাচ্ছি খুঁজে মনের মানুষ
মায়ের গন্ধ মায়ের আদর
আমার দিকে তীক্ষ্ণ নজর
আজও তো মা তেমনি সজাগ আকাশপথে রঙিন ফানুস।
মায়ের মতো বাবাও আমার এগিয়ে যাবার সাহস জোগায়
প্রয়োজনে সর্বদা পাই
বিঘ্ন বলে পালাই পালাই
ওদের মতো আর কে আছে এমন মানুষ এ মন যা চায়।
হাটবাজারে রাস্তাঘাটে স্কুলকলেজের অঙ্গনেও
পাইনি খুঁজে মানুষ অমন
পৃথিবীতে নেইকো তেমন
মানুষ যদি না হয় মানুষ ভাবায় ভীষণ এ মনকেও।
আপন স্বার্থ দেখতে গিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে মানবিক বোধ
ভাবে না কেউ পরের কথা
তাইতো এমন জটিলতা
প্রতিহিংসায় মেতে আছে সুযোগ পেলেই নেয় প্রতিশোধ।
নাভিকুণ্ডের খোঁজে
– অজিত কুমার কর
শেষ জীবনে বৃদ্ধাশ্রমে, হয়নি ঘরে স্থান
ভেবেছিলো কাটবে সুখে, জুটল অসম্মান।
সব ছেলেরই বিশাল বাড়ি
সবার বিলাসবহুল গাড়ি
মায়ের চলে আপন অর্থে, ভালোবাসায় টান।
ক্লান্ত দিয়া নিভে গেল
শ্মশান ঘাটে পুত্র এল
উচ্চ কণ্ঠে কীর্তনিয়ার বিদায় বেলার গান।
‘পৃথিবীতে কেউ কারো নয় মিথ্যা মায়াডোর
ছিন্ন হল সেইটুকুও, মুক্তি হল তোর।’
চিতার আগুন নিভলে দেখে কেবল গরম ছাই
নাভিকুণ্ড কোথায় গেল, ছাইয়ের ভিতর নাই।
বিফল হল অনেক খুঁজে
পুত্র তখন চক্ষু বুজে
ঘোমটা মাথায় এক বুড়িমা, শুধায়, ‘কী তোর চাই?
নাড়ির টান তো ছিল না তোর
দুর্ভাবনায় এখন বিভোর!
আগেই বোঝা উচিত ছিল, এবার আমি যাই।’
তখনই সে তাকায় ফিরে শুনসান প্রান্তর
একাই ঘাটে বসে আছে, ব্যথিত অন্তর।
আমার দুর্গা
– অজিত কুমার কর
আমার দুর্গা মর্ত্যবাসী কৈলাসে তাঁর নয়কো বাস
সব থেকেও নিঃস্ব বড় ফেলছে গভীর দীর্ঘশ্বাস।
বয়স এখন আশির ওপর দিবস যেন নিকষ রাত
ব্যথাভরা কঠিন জীবন পুরো অসাড় এক পা হাত।
আমার দুর্গা খুবই ছোটো বয়স কত নয় বা দশ
বেরিয়ে পড়ে সকাল হলে খেটে খেটে হাত অবশ।
লেখাপড়ায় ঝোঁক ছিল খুব সব আশা কি পূরণ হয় ?
জোগাবে কে দু’বেলা ভাত মানুষকে পায় ভীষণ ভয়।
আমার দুর্গা অনাথিনী আপন কেহ নেইকো যার
হাজার ইগল ছোঁ মেরে যায় দুঃখে কাটে জীবন তাঁর।
কতরকম ছলচাতুরী সফেদ বেশে কুটিল মন
ধরার মানব কেন এমন বন্যরাও হয় সুজন।
আমার দুর্গা পথের শিশু পথের পাশে রাত কাটায়
খাবার জোগাড় নিজেই করে আস্তাকুঁড়ে সব সে পায়।
কুড়িয়ে পাওয়া একটা জামা শীতে ওতেই ওমের সুখ
জননী তাঁর ঝুপড়িবাসী রাত্রে কেবল দেখায় মুখ।
আমার দুর্গা দাঁড়িয়ে দেখে কেউ যখন খায় ললিপপ
কখন পড়ে মুখ থেকে তার ছুট্টে গিয়ে খপাত খপ।
কীভাবে যে দিন কেটে যায় শীর্ণ দেহ করুণ চোখ
এড়িয়ে চলে সভ্য মানুষ বুঝবে কেবা ওদের শোক।
আমার দুর্গা লক্ষ কোটি ভিন্নরূপে বিদ্যমান
ব্যথার পাহাড় জমাট বুকে বাঁচাবে কে এদের প্রাণ।
এদের কী দোষ বল মা উমা শুধু একটু শান্তি চায়
নিরাপত্তা পেটের খাবার বলনা মা গো কোথায় পায়।
মহুলবনে নিশিযাপন
– অজিত কুমার কর
ফল-মহুয়ার স্পর্শ গায়ে জাগায় শিহরন
আমার হাতের মুঠোয় এখন ওর ভরা যৌবন।
একটি দুটি পড়ছে ঝরে
ছড়িয়ে আছে পথের ‘পরে
জড়িয়ে ধরে মহুয়াকে উষ্ণ আলিঙ্গন।
হৃদয় দুয়ার খোলাই ছিল
প্রেম-পরাগে ভরিয়ে দিল
চৌপাহাড়ি ছেড়ে যেতে চাইছে না আজ মন।
বউ-কথা-কও জানায় শিসে, ধরলে আমার হাত
কেমন লাগে বুঝবে তবে জোছনামাখা রাত।
ওর কথা কি ফেলতে পারি বানাই পাতার ঘর
ভেসে এলো শুষ্ক পাতার রাগিনী মর্মর।
পাখিরা সব ফিরছে নীড়ে
হারাই আমি ওদের ভিড়ে
শুনছি বসে শব্দ-কোলাজ জনহীন প্রান্তর
নীরবতা এবার নামে
মর্ত্যভূমির স্বর্গধামে
বউ-কথা-কও ভুল বলেনি প্রফুল্ল অন্তর।
ওরাই আমায় জাগিয়ে দিল মুখর বনাঞ্চল
ধোঁয়াশা ভাব কেটে গেছে চারিদিক উজ্জ্বল।
কবি পরিচিতি

অজিত কুমার কর। জন্ম ১লা জানুয়ারি ১৯৪৬ পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কিসমৎ জগন্নাথ চক গ্রামে। মাতা রাজবালা, পিতা কালিপদ। মৌরাজল অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শুরু। ১৯৬২ সালে রামচন্দ্রপুর রাইসুদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে স্কুল ফাইনালে উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৩ তে পাঁশকুড়া বনমালী কলেজে থেকে প্রি-ইউনিভারসিটি ও ১৯৬৬ তে বিজ্ঞান বিভাগে সপ্তম স্থান অধিকার করে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক হন। ১৯৬৯ এ কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এস সি গণিতে প্রথম হওয়ার ছয় বছর পর ১৯৭৫ এ ওখান থেকেই পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। সিএসআইআর এর পোস্ট ডক্টরেল ফেলোশিপ পেয়ে পুল অফিসার হিসাবে দু’বছর গবেষণা করেন। ১৯৭৬ সালে জয়শ্রী মাইতি-র সাথে শুভ পরিণয়। এরপর হুগলি জেলার নবগ্রাম হীরালাল পাল কলেজে কুড়ি বছর অধ্যাপনার পর ২০০৫ এ গণিত বিভাগ থেকে রিডার হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।
তারপর প্রবেশ সাহিত্যের আঙিনায়, সহধর্মিণী ও কবি সুমনা প্রামাণিক এর অনুপ্রেরণায়। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ন’টি। ‘ঝিরিঝিরি বৃষ্টি তাথৈ তাথৈ নাচ’, ‘পঞ্চক’ ৪খন্ড, ‘লাঞ্ছিত গোলাপ’ এবং ‘রত্নমালা’। কবির চারটি ই-বুক ‘নীলাঞ্জনে রঞ্জিত’, ‘কে তুমি লাবণ্যময়ী’, ‘কীর্তিমান’ এবং ‘প্রেম কাননে ফুটলো ফুল’। অপ্রকাশিত ‘ছড়ার ঘড়া’, ‘ঘড়া ঘড়া ছড়া’, ‘হাঁড়ি ভরা ছড়া’ ‘এক কড়া মিঠা ছড়া’, ‘মহৌষধ বনৌষধি’, ‘শেয়ালের উপাখ্যান’ ইত্যাদি। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে কবির কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ। বর্তমানে বাংলা-কবিতাডটকম ওয়েব ব্লগ সাইটে নিয়মিত কবিতা পোস্ট করেন। ই-ম্যাগাজিনেও কবিতা প্রকাশিত হয়। অবসর জীবন কাটছে সানন্দে সারস্বত সাধনায় পাঁশকুড়ার জয়াকুঞ্জে।