জয়শ্রী কর – কবিতা (সজাগ প্রহরী, বাইশে শ্রাবণ, খিচুড়ি-ইলিশ, ভারতমাতার চরণ চুমি, কালপুরুষ, আমার বর্ণময় শৈশব)

সজাগ প্রহরী

– জয়শ্রী কর

খালের পাড়ে তালের সারি​
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ চতুর্দিকে ডানা​
আকাশজুড়ে মেঘপরিরা ​ ​
​ ​ ​ ​ ​ আহ্লাদে আটখানা।​

​ ​ ​ ঝিরিঝিরি ঝরছে বারি​
​ ​ ​ ​ ​ ​ উল্লাসে প্রাণ নাচে​
​ ​ ​ ​ প্রহরীরা ঠায় দাঁড়িয়ে ​ ​
​ ​ ​ ​ ​ ​ ডাকছে যেন কাছে।​

খুশির দোলায় দুলছে পাতায় ​ ​
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ বাবুই পাখির বাসা​
​ ​ যেন উল্টো কুজোর মতো ​ ​ ​ ​
​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ দেখতে দারুণ খাসা।​

সন্ধ্যাবেলা জোনাক এনে​
​ ​ ​ ​ ঘরটি করে আলো​
​ ​ ঘুমায় সুখে নয়নমণি​
​ ঘোচায় আঁধার কালো।​

মায়ের স্নেহ আদর দিয়ে​
​ ​ ​ ​ আগলে রাখে বুকে​
​ বৃষ্টি হলেও ছানাগুলো​
​ ​ ​ ​ ​ থাকে পরম সুখে।

বাইশে শ্রাবণ

– জয়শ্রী কর

মেঘভাঙা বৃষ্টিতে নেমেছে প্লাবন
বিদায়ের সুর বাজে বাইশে শ্রাবণ।
আকাশের মুখ ভার কাটে সারাদিন
আপামর বাঙালির আনন মলিন।

বিছানায় শুয়ে কবি বেলা দ্বিপ্রহর
বিষাদের মূর্ছনা শোকার্ত ঘর ।
চিরতরে থেমে গেল কবির কলম
এ ক্ষতি অপূরণীয় কেড়ে নিল যম।

ছাতিমতলায় বসে গাহি রবি গান
তাঁর ছবি ভেসে ওঠে ভরে মন প্রাণ।
সারা গায়ে মেখে নিই পৃথিবীর ধূলি
স্মৃতিবিজড়িত স্থান কেমনে তা ভুলি।

বাঁশি বাজে মনোমাঝে আঁধার রজনি
কান পাতলেই শুনি তাঁর পদধ্বনি।
ফুলে ফুলে ভরে যায় জোড়াসাঁকো ধাম
চরণে ঠেকাই মাথা আমার প্রণাম।

বরণের মালা গাঁথি তাঁরি ফুল দিয়ে
পরম তৃপ্তি পাই শ্রদ্ধা জানিয়ে।
কবি যে রাতের তারা প্রভাতের রবি
সবার হৃদয়জুড়ে আঁকা সেই ছবি ।

সুখে-দুখে রোগে-শোকে মেলে সান্ত্বনা
জীবনের মরুঝড়ে বিলীন বেদনা।

খিচুড়ি-ইলিশ

– জয়শ্রী কর

শ্রাবণ-মেঘের বৃষ্টি ধারায়
ভরছে পুকুর-নদী-নালা
গ্রাম ও শহর ভাসছে জলে
ভাঙছে বাড়ি খড়ের চালা।

বৃষ্টিফোঁটা নাচছে পাতায়
ঝুমুর ঝুমুর বাজছে নূপুর
মাছরাঙা-বক মাছের আশায়
ডালে বসে সারা দুপুর ।

মালতির হাঁক, ‘এসো দিদি
এনেছি আজ ভালো ইলিশ’
ছোটো মাছ তো অনেক ভালো
আকাশছোঁয়া দাম যে বলিস।

আগের মতো পাই না রে স্বাদ
দাদা শুনেই বলে ওঠে
কোলাঘাটের ইলিশ কোথায়
এখনও তেল লেগে ঠোঁটে।

মায়ের হাতের খিচুড়ি আর
গরম গরম ইলিশ ভাজা
ঘ্রাণেই হতো অর্ধভোজন
জানিস, ইলিশ মাছের রাজা।

ভারতমাতার চরণ চুমি

– জয়শ্রী কর

ভারত আমার জন্মভূমি
আঁচলতলে সুখেই থাকি
মায়ের রাঙা চরণ চুমি
ধুলোমাটি অঙ্গে মাখি ।

রক্তে রাঙা স্বাধীন ভারত
দুশো বছর দুঃখভরা
বিপ্লবীদের কঠিন শপথ
কাটিয়ে দিল প্রবল খরা।

সাহস জোগায় মায়ের বুকে
বিপ্লবী আর বীরাঙ্গণা
অপার কীর্তি মুখে মুখে
ওদের গুণের নেই তুলনা।

ভয়ডরহীন আমজনতা
এনে ছিল লড়াই করে
ভারতমাতার স্বাধীনতা
মুক্তি-আলো পড়ে ঝরে।

সরস জন্মভূমির মাটি
ফুলে ফুলে মায়ের হাসি
সোনার চেয়েও বেশি খাঁটি
তাইতো জাগে পুলক রাশি।

কালপুরুষ

– জয়শ্রী কর

রাত-আকাশে খালি চোখে
কালপুরূষের মিলবে দেখা
রণংদেহি মূর্তিটি তাঁর
দাঁড়িয়ে থাকে একা একা।

আকাশজুড়ে তারার মেলায়
সবার আগে নজর কাড়ে
কল্পনাতে আঁকা ছবি
মিলিয়ে দেখে বারেবারে।

যোদ্ধা-বেশে বাঁ হাতে ঢাল
একেবারে মানব-আকার
কটিবন্ধ থেকে ঝোলে
খাপে ঢাকা এক তলোয়ার।

বিশাল তারা বাম পায়ে তাঁর
অতি উজ্জ্বল বাণরাজা নাম
রবির চেয়েও অনেক বড়
মুখে মুখে ছড়ায় সুনাম।

কালপুরুষের উজ্জ্বলতা
বাড়বাড়ন্ত আঁধার রাতে
খুব সহজে চিনতে পারি
চিত হয়ে শুই যখন ছাতে।

আমার বর্ণময় শৈশব

– জয়শ্রী কর

শৈশব কাটিয়েছি ধুলোবালি মেখে
হাতেখড়ি মা’র কাছে অ-আ-ক-খ লেখে।
আয় আয় ফিরে আয় ফেলে আসা দিন
সোনালি দিনের গান হয় না বিলীন।

স্কুলে গিয়ে বই ফেলে লুকোচুরি খেলা
ছিল না পড়ার চাপ কেটে যেত বেলা।
সহপাঠীদের সাথে হত খুনসুটি
একটু পরেই ভাব হেসে কুটিকুটি।

বগলে শিলেট বই হাতে তালচাটা
বৃষ্টিতে কচুপাতা ভিজত না গা’টা।
মাত্র মিনিট পাঁচ অদূরেই বাড়ি
খুলে ফেলি ভিজে জামা খুব তাড়াতাড়ি।

পাঁচ জন ভাইবোন মিলেমিশে থাকা
রংতুলি হাতে নিয়ে কত ছবি আঁকা।
পুকুরে সাঁতার কাটা ডুবে পাঁক তোলা
সুমধুর দিনগুলো যায় না তো ভোলা।

আমাদের কাজ ছিল ফুল তুলে আনা
মিলত নকুলদানা মা’র নজরানা।
ভুলিনি কিছুই আমি ভেসে ওঠে সব
কোথায় হারিয়ে গেল সেই শৈশব।


কবি পরিচিতি

জয়শ্রী কর। জন্ম জুন ২, ১৯৫৬তে পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় কোলাঘাট থানার অন্তর্গত চিমুটিয়া গ্রামে মাতুলালয়ে। মাতা কমলাবালা, পিতা রামপদ মাইতি।

কোদালিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার প্রথম পাঠ। ১৯৭৪ এ ভোগপুর কেনারাম মেমোরিয়াল হাই স্কুল থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর পাঁশকুড়া বনমালী কলেজে স্নাতক স্তরে কলা বিভাগে ভর্তি হন। পড়া চলাকালীন ১৯৭৬ এ ডক্টর অজিত কুমারের সঙ্গে শুভ পরিণয়। কৈশোর থেকেই খেলাধুলা, সেলাই ও শরীরচর্চার সঙ্গে তিনি যুক্ত। পরে গিটার, তবলা, যোগ ব্যায়াম এবং কাব্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন। নিজে একজন সংগীত শিল্পী ও সুরকারও বটে – বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি ও সংগীত পরিবেশন করে থাকেন।

প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘নীল আকাশের কোলে’ পাঠকমহলে খুবই সমাদৃত। রাজ্য সরকারের তরফে রাজা রামমোহন রায় লাইব্রেরীর ফাউন্ডেশন এবং বঙ্গীয় প্রকাশক ও পুস্তক বিক্রেতা সভার যৌথ উদ্যোগে তার বই কেনা হয় পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার গ্রন্থাগারগুলির জন্য। এছাড়া আরো দুটি কাব্যগ্রন্থ – ‘ভোরের বাঁশি’ এবং মায়াডোর’ – প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যে। প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তার কবিতা রচনার প্রেরণা। প্রতিদিন কবিতা লেখা, কাব্য আলোচনা আর গানবাজনা নিয়ে এখন দিন কাটছে।