যুদ্ধক্ষেত্র
– দেবকুমার মুখোপাধ্যায়
কাঁটা
সারাক্ষণ বিক্ষত করছে অন্তর বাহির।
যারা আজ পঞ্চভূতে
তারাও ক্ষতের চিহ্ন নিয়ে
চিরঘুমে হয়েছে বিলীন।
দিগন্তে তবুও জাগে ধ্বনি –
যোদ্ধা তুমি,
যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ো না কখনো।
সামনে যতই থাক রথী মহারথী
আত্মীয়স্বজনবর্গ,
ধনুর্বাণে লক্ষ্য রাখো স্থির।
শুধু বলে — মা ফলেষু।
তারা কেউ ভুলেও বলে না –
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধশেষে
কী পেয়েছিল হাতে
দুর্যোধন কিংবা যুধিষ্ঠির!
প্রতিকৃতি
– দেবকুমার মুখোপাধ্যায়
রঙিন ফুটন্ত ফুল
পশ্চাৎপদটিকে রাঙিয়ে দিয়েছে।
সাদা কালো মুখটিতে
সে রঙের কিঞ্চিৎ আভাস,
ভাঙাচোরা সেই মুখে
অনেক সর্পিল রেখা — শোকের, সুখের,
গলার চামড়া যেন
গলকম্বলের মতো লম্বমান,
দু চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ তবুও উজ্জ্বল
পরনে শুভ্র থান
ঢেকেছিল আপাদশরীর।
ক্যামেরার চোখ তাকে দেখেছিল এইভাবে
সে চায়নি এমনটি হোক।
জীবনের রঙ মুছে
যখন সে শুধু সাদা কালো
তখন এ রঙিন ছবি কেন?
ধূসর পাতাকে যেন
বর্ণে বর্ণে মিথ্যেই রাঙানো।
একটি জীবন
– দেবকুমার মুখোপাধ্যায়
ইস্কুলের পড়া তার মুখস্থ থাকত না,
পরীক্ষার ঘরে বসে কামড়াত কলম,
যোগ – বিয়োগে ভুল হত
অঙ্কেতে কোনমতে পাশ
ক্লাশগুলো পর পর টপকানো গেল না।
এখন সে দোকান করে
মনে রাখে সব দর, তার ওঠা- নামা,
যোগে তার ভুল নেই
মিলে যায় রোজকার আয় ও খরচ।
বই, কাগজের পাতা
ছিঁড়ে ফেলে নির্মম দু হাতে,
কালে কালো অক্ষর পড়েও দেখে না,
চানাচুর মুড়ে দেয়
কবিতা ও গল্পের মোড়কে।
সে জানে না —
তার হাসি কবিতার জন্ম দিতে পারে,
তার কান্না সুরে সুরে গান হয়ে যায়,
তার জীবনেও কত গল্প জমে আছে।
মাস ও বছর পার
যখন সে শ্রমে ক্লান্ত
চলে যায় দূর গাঁয়ে পর্যটনে,
চেয়ে দেখে মেঠোপথ, পাতিহাঁস, ডোবা
সে তখন কবি হয়ে যায়।
শেষ ইচ্ছে
– দেবকুমার মুখোপাধ্যায়
কোথাও আমার যাওয়া হয় না।
দেখতে দেখতে জীবন শেষ —
আর কতদিন?
দিবারাত্র মানসভ্রমণ করেই যাচ্ছি
একা একাই,
যাচ্ছি পড়ে ভ্রমণকথা
পাহাড়, সাগর, অরণ্যদেশ
স্বদেশ বিদেশ বাদ কিছু নেই।
এই জীবন কি ফিরে পাবো?
পরের জন্মে অন্য কোন নারীর গর্ভে
অন্ধকারে ঘুমিয়ে থাকা —
আর এক পুরুষ পিতা আমার,
চারপাশে সব অন্য মানুষ
তারাই হবে আপনার জন
তাদের ভাষা আমার ভাষা।
কোথাও আমার যাওয়া হয় না।
এবার যাবো তোমার সঙ্গে হরিদ্বারে —
শেষ ইচ্ছে
মিটিয়ে দেবার দায় কিন্তু রইল তোমার
এই জন্মে।
চক্ষুহীন
– দেবকুমার মুখোপাধ্যায়
চোখ আছে তবু আমরা দেখিনা কত কী!
সূর্য ওঠে প্রতিদিন
তাকে আমরা করি না নমস্কার,
সূর্য ডোবে, দিন চলে যায়
তাকে কই বলি না — বিদায়।
ফুলে ফুলে কত না ফড়িং, প্রজাপতি
উড়ে উড়ে মধু খায়,
কতজন দেখি তাকে?
এমনিধারা — চোখ থাকতে চোখ নেই যেন
শুধু কি আমরা?
সেই যুগে পাঁচ ভাই যখন বলল এসে মাকে
তোমার জন্য দেখো
এনেছি কী দুর্মূল্য সম্পদ,
কুন্তী দেখল না কিছু,
বলে দিল — ভাগ করে নাও পাঁচজনে
পাঞ্চালীর কী ভীষণ দুর্ভোগ গেল
সারাটি জীবন।
ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ ছিল,
গান্ধারীর চক্ষুষ্মতী থাকা ছিল
বড় প্রয়োজন
চোখ বেঁধে সেও অন্ধ হল।
কবি পরিচিতি

দেবকুমার মুখোপাধ্যায়। পশ্চিম বাংলা, ভারত। জন্ম ১৯৫০। স্নাতক। বর্তমানে বসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ককর্মী।
ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির শুরু। কবিতা, ছড়া, ছোট গল্প, অণু গল্প, নিবন্ধ লিখে থাকেন। বড়দের জন্য, ছোটদের জন্যও। কিছু কিছু অনুবাদও করেছেন, ইংরাজি থেকে বাংলায় — কবিতার, গল্পের।
বিভিন্ন পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়েছে ও হচ্ছে। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে — আসলে আলোর জন্যে, এখানে তরঙ্গ এখানে জীবন, জলের উপমা (এককভাবে), আর যাঁরা কবিতা পড়েন না (দুজনে মিলে), ছড়ার মজা খাস্তা গজা ও চার মাথার মোড় (চারজনে মিলে)।