আমার গাঁয়ে
– শুক্লা বোস
কে যাবি রে, আয় ছুটে মোর কুটির ঘেরা প্রাঙ্গনে,
আকাশ যেথা নুইয়ে প’ড়ে ছড়ায় হাসি অঙ্গনে।
বৃক্ষরাজি ছায়া দোলায় সবুজ শাখার স্পন্দনে,
নিবিড় স্নেহ জড়ায় মায়ায় আকুল হৃদয় বন্ধনে।
ব্যাকুল করা বাঁশি বাজে – রাখাল কাঁদে ক্রন্দনে,
সবুজ ধানের অযুত ক্ষেতে দৃষ্টি কাড়ে নন্দনে।
নেই আকাশে ধোঁয়ার কালি বুকটি ভরে শ্বাস নিলে,
সেই বাতাসের মধুর ছোঁয়ায়, সর্দি-কাশি যায় মিলে।
কলসি কাঁখে গ্রাম্য বধূ নদি থেকে জল আনে,
ভাটিয়ালী গানের সুরে প্রাণ মেতে রয় আনমনে।
মাঠের পাশে পরাণ চাষী আ’লের উপর খাচ্ছে ভাত,
এবার ক্ষেতের ফসল ভালো – পরাণ চাষীর জোর বরাত।
উদাস বাউল গাঁয়ের পথে একতারাতে সুর তোলে,
গানের সুরে মেঠো পথের সবুজ ঘাসের প্রাণ দোলে।
কাক-শালিকের ধান খাওয়া মাঠ ফসলতে যায় ছেয়ে,
টুনটুনিটা পুচ্ছ নাচায় আপন মনে গান গেয়ে।
দস্যি ছেলে মাঠে-ঘাটে আপন মনে যায় ঘুরে,
তাল-নারকেল পাতা ছুঁয়ে বাতাস বয়ে যায় দূরে।
পুকুর পাড়ে গাঁয়ের ছেলে দুষ্টু হাতে ছিপ ফেলে,
খোলসে-টাকির নেই দেখা নেই, পুঁটিমাছে ছিপ গেলে।
জোৎস্না রাতে আকুল বাতাস নদীর গায়ে যায় দুলে,
চল ছুটে চল — আমার গাঁয়ে শহর সুখের সব ভুলে।
শ্রাবণী
– শুক্লা বোস
হে শ্রাবণী! একটু থামো!
আর কেঁদোনা! কাঁদিও নাকো —
বিধুমুখী, একটু হাসো!
একটু না হয় কথা রাখো!
মাতঙ্গিনী আজকে তুমি
পাড়মাতাল ওই ঝড়ের সাথে,
বন্ধ মোরা গৃহের কারায়
বাদল ধারার এ মৌতাতে।
এতটাও কাঁদতে পারো–
ভাবিনি তো কেউ কখনো,
ঘর-দুয়ারে আঁখির প্লাবন
খাটের উপর পা গুটানো।
কান্না তোমার শোকের ধারা
উচ্ছে-পটল -আলু -বেগুন,
যায় ভেসে সব স্রোতের তোড়ে
বাজার দর যে হোলো দ্বিগুন।!
লক্ষ্মী মেয়ে! আর কেঁদোনা!
একটুখানি কান্না থামাও,
পরিবার আর পরিজনের
জীবনটা তো একটু বাঁচাও!!
জীবন
– শুক্লা বোস
জীবনটা যে পোকায় কাটা ঘুনে ধরা ঘুনসি ঘর,
ক্ষয়ে ক্ষয়ে ক্ষয়িষ্ণু দিন অস্তরবির অন্ধকার।
আশার শিশির রাতে ঝরে সূর্যালোকে হারিয়ে যায়,
সুপ্তিমগন রাতের স্বপন ভোরের আলোয় মিলায় হায়!
সাগর তটে আছড়ে কাঁদে বেদনভরা উতল ঢেউ,
সফেদ ফেনা আশার কণা — অনাগত স্বপ্ন খেই।
নীল আকাশে উড়াল মেঘে প্রাণপাখিটা উড়তে চায়,
ঝোড়ো বাতাস ঝাপটা মারে — আকাশ কুসুম লুপ্ত হয়।
তারুন্যময় তরঙ্গঘাত আঘাতঘায়ে কম্পমান,
ত্রিকালের এই কারাগৃহে রুদ্ধ দুয়ার — প্রাণ পীড়ন।
যৌবনেরই উন্মাদনায় দিন কয়েকের মত্ততা,
ফুরালো যেই, হারালো সব, – যাচাই কোরো সত্যতা।
টুকরো মেঘে স্বপ্ন যত আকাশ নীলে উড়তে চায়,
রক্তঘামে চোখের জলে, পরিহাসে জীবন ক্ষয়।
অলক্ষিতে কখন কোথায় জীবন বুঝি হারিয়ে যায়,
উৎস হতে ঝংকৃত প্রাণ উৎস পানে আবার ধায়।
হাল-চাল
– শুক্লা বোস
এই পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে কতই খেলার রং বাহার,
কামধেনুটা ধনীর ঘরে – গরীব পেটে ভুখার ভার।
রাজনীতিতে কুলুপকাঠি, ভব্য ধুতির কোঁচায় আটা,
কুঠার মারে গোপন কুঠি – আশার ভাষণ দিব্য ছটা।
কারবারির ওই কারদানিটা সকাল-সাঁজে কেতন ওড়ায়,
কুচক্রিরা সদলবলে যখন তখন ডিগবাজি খায়।
পুলিশ ধরে ছিঁচকে চোরে, রাঘববোয়াল পগার পার,
রাজার নীতির লেবাস এঁটে পাতিনেতার কী বাহার!
ত্রি-ধারাতে চলছে জগৎ, কাম-কাঞ্চন-ক্ষমতা লাভ,
অবাক সুধা বাড়ায় ক্ষুধা – মদের বোতল সারাৎসার।
কাদম্বিনীর কান্নাকাটি, আঁখির ধারায় ভেসেই যায়,
কাম-কুহকের নখর থাবায় বলাৎকার-ই জয়ী হয়।
সৎ মানুষের একটাই দোষ, বোকার স্বর্গে করছে বাস,
কুখ্যাতি তার “ভালো মানুষ” — সুখের নীতির সর্বনাশ।
তপোবনে তপস্বী কই? অরণ্যানী আলোকময়,
বৃক্ষরাজি দেয়না ছায়া – রাজার ঘরে শোভার জয়।
কুল-কামিনীর কুলোৎপাটন, সৌখিনতার নেইকো শেষ,
কুলদেবতা চুলোয় কাঁদে – প্যান্ট শার্টে মানায় বেশ!
দূর্গাপূজা ভীষণ মজা, সাজ-পোশাকের অন্ত নেই,
সাধন-ভজন নমস্কারে, ভ্রমণ-ভোজন-বিলাস সই।
ক্ষুন্নমনা ত্রিকালদর্শী অবাক চোখে তাকিয়ে রয়,
ক্ষোভে-রোষে ক্ষুব্ধ হৃদয় – প্রকৃতিরে লেলিয়ে দেয়।
পারছেনা আর সইতে বুঝি গুণজ্ঞদের অত্যাচার,
প্রকৃতি তাই ধ্বংসলীলায় মেতে ওঠে বারংবার।
সত্যি কথা কইতে মানা – থামাও কবি কলমটা,
চর্ব-চোষ্য-লেহ্য-পেয়, — পিয়ে চলুক জগৎটা!
কবি পরিচিতি

শুক্লা বোস। মোংলা অঞ্চলের জ্ঞানের প্রধান বিদ্যাপীঠ শেলাবুনিয়ায় অবস্থিত সেন্ট পলস্ উচ্চ বিদ্যালয়-এর স্বার্থক ও কৃতি শিক্ষিকা। সুদীর্ঘকাল শিক্ষকতার পর শিক্ষার্থীদের প্রাণপ্রিয় এই শিক্ষিকা মার্চ ৪, ২০২০সাল থেকে অবসরে আছেন।
ছেলেবেলার থেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, জীবনানন্দ দাশ সহ বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য প্রথিতযশা কবি ও সাহিত্যিকদের লেখার সান্নিধ্যে বেড়ে উঠেছেন। কখনও কখনও লিখেছেন আত্মার সন্তুষ্টির জন্য। আত্মপ্রচারে বিমুখ হওয়ায় নিজের ভিতরেই রেখেছেন নিজেকে – তেমনভাবে বাইরে প্রকাশিত হয়ে ওঠা হয়নি।
বর্তমানে অবসর জীবনের একঘেঁয়েমি কাটিয়ে জীবনযাত্রায় কিছুটা ভিন্নতা ও বৈচিত্রের ভিতর দিয়ে সময় কাটানোর জন্যই বেছে নিয়েছেন বই পড়া ও লেখালেখিকে। সাহিত্যের মাধ্যমে মানুষের আত্মশুদ্ধি হোক, মানুষ সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠুক – এই প্রত্যাশাই তার ভাবনায় জীবন জুড়ে বিকশিত।