হাত
– শুক্লা বোস
প্রথম সন্তান জন্মানোর পর মা নীলাম্বরী দেবী তার নিজের নামের সাথে মিলিয়ে আদর করে যখন ছেলের নাম রাখলেন নিখিলেশ তখন হয়তো বা নিখিলেশ্বর একটুখানি ভ্রূকুটি করেছিলেন অথবা বিদ্রুপ হাসি হেসেছিলেন।
উঠোনের একটা কোনে সারি সারি কয়েকটা ফলন্ত আমের গাছ। চারাগাছে মাত্র তিন বছরে ফল ধরেছে। প্রায় মাটি ছুঁই ছুঁই করে আমগুলি চারাগাছে ঝুলে আছে। মন মাতানো দৃশ্য। উঠোনের একপাশে পিছন বরাবর দক্ষিণমুখী টিনে ছাওয়া মাটির পোতার ঘর। চারপাশে টিনের বেড়া।ঘরের পূর্বপাশে মাটির পোতার রান্নাঘর। গোলপাতার ছাউনি, দরমার বেড়া। কাঠের উনুনের ধোঁয়ায় চালে ও বেড়ায় মলিন কালির ছোঁপ। ঘরের পশ্চিমপাশে মুরগির ঘর, তার পাশে ছোট্ট গোয়ালঘরে একটি গাভী ও ছোট্ট বাছুর। গতবছর দুইশো টাকা দিয়ে একটা টার্কিশ মুরগি কিনে এনেছে নীলু। গাভী ও মুরগি তার নিজস্ব সম্পদ। মুরগি ও তার দুটি বাচ্চাকে প্রায় প্রতিদিন রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে একটা লাঠি হাতে পাহারায় থাকে নীলু, সাথে তার চার বছরের ছেলে টুলু। রাস্তার পাশে পোকামাকড় খুঁটে খুঁটে খায় ওরা।
এ বাড়ির বড়ো ছেলে নীলু। ছোটবেলা থেকেই গোঁয়ার আর বদমেজাজি নীলু বইখাতা বগলে চেপে স্কুলে ঢুকেছিলো বটে, কিন্তু স্কুলের গণ্ডী পেরিয়ে কোন সার্টিফিকেট হাতে আর ফিরতে পারেনি সে। তাই অকাট মূর্খই রয়ে গেছে। অথচ বাড়ির আর সবাই শিক্ষিত, নিদেনপক্ষে স্কুলের গণ্ডী সবাই পেরিয়ে এসেছে। কিছুই করেনা নীলু। বাপের পয়সায় খায় দায়, অশান্তি করে, আর ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। প্রথম বউটা বিয়ের ছয় মাসের মাথায় চলে যাবার পরে আবার বিয়ে করেছে সে।
দ্বিতীয় স্ত্রী সুকন্যা। কালো-কোলো মোটাসোটা আটসাট শরীরের বাঁধন তার। ভীষণ মুখরা আর ঝগড়াটে সে। শ্বাশুড়ির সাথে বনিবনা নেই, একটা বললে দশটা শুনিয়ে দেয়। নীলু ওকে কিছু বলতে পারেনা। এই একটা জায়গায় বড্ড দুর্বল সে। ওকে দেখলেই শরীরের মধ্যে একটা আদিম ক্ষুধা চনমনিয়ে ওঠে। ঠিক ভালোবাসা নয়, কিন্তু এটাই নীলুর ভালোবাসা। যৌবনের উদগ্র কামনার বহ্নিশিখায় সারা শরীর যখন জ্বলতে থাকে তখন সেই কামনার পরিতৃপ্তির স্নিগ্ধ জলধারা নামে ওই কেলো মোটা শরীরটা বেয়ে। স্ত্রীর বশীভূত সে। শাশুড়ি ও পুত্রবধূ তাই পাড়া মাতিয়ে যখন চিৎকার চেঁচামেচি করে, কুৎসিত গালাগালি আর অকথ্য কথার বন্যা বইয়ে দেয়, তখন নীলু সবসময়েই স্ত্রীর পক্ষ নেয়। আজকাল মাকে একটুও সহ্য করতে পারে না নীলু। কথায় কথায় ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। মাকে দেখলেই গা জ্বালা করে তার। মাও নিরুপায়। ছেলের উপর যে ক্ষোভ তার সবটুকু ঢেলে দেয় পুত্রবধূর উপর। অগ্নিতে ঘৃতাহুতি হয়, সংসারে অশান্তির আগুন জ্বলতে থাকে দাউ দাউ করে।
অন্ধকার কারাপ্রকোষ্ঠ। একা একা বসে আছে নীলু। সেদিনের সেই বীভৎস দিনটির কথা বার বার মনে পড়ে তার। গত শীতকাল থেকে বৃষ্টির ছিটেফোঁটাও কোথাও নেই। মাথার উপরে বোশেখী সূর্য গনগনে আগুন ঝরাচ্ছে চারিদিকে। অসহ্য গরমে হাপরের মত হাঁপাচ্ছে জনজীবন। গভীর পুকুরগুলির জল তলানিতে ঠেকেছে। অগভীর পুকুরের তলা ফেটে ফেটে মানচিত্রের আকার ধারণ করেছে। চারিদিকে চলছে জলের জন্য হাহাকার। এমনি এক মধ্যাহ্ন দুপুরে নীলু ঘর থেকে বাইরে বেরিয়েছে। বাবা আর ভাইদের দেওয়া টাকায় ইটের গাঁথুনি দিয়ে বাড়িতে ঘর উঠছে। একজন রাজমিস্ত্রি আর দুজন মহিলা সাহায্যকারী কাজ করছে। মা তদারকি করছেন। বৌ গোবর সংগ্রহ করে উঠোনের একপাশে সারি সারি ঘুঁটে দিয়ে রেখেছে। দুপুরের খাওয়া শেষে মিস্ত্রী-মজুর দাওয়ায় বিশ্রামরত। এমন সময় দড়ি খুলে ছোট্ট বাছুরটা ছুটে এলো। সাজানো ঘুঁটের সারির উপর লাফালাফি করে সেগুলো ভেঙেচুরে তছনছ করে দিলো। নীলুর স্ত্রী হঠাৎ ঘরের বাইরে বেরিয়ে সাধের ঘুঁটেগুলির এ অবস্থা দেখে চিৎকার করে শ্বাশুড়িকে গালাগালি করতে শুরু করলো। প্রতিউত্তরে শ্বাশুড়িও গাল পাড়তে লাগলো বৌকে উদ্দেশ্য করে। শুরু হলো দক্ষযজ্ঞ। এক পর্যায়ে হাতাহাতি চুলোচুলিতে পৌঁছালো ঘটনা। ঠিক এমনি সময় উঠোনের টিনের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলো নীলু। বউ দৌড়ে এসে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে নীলুকে বলল, “তোমার মা ইচ্ছে করে আমার দেওয়া ঘুঁটেগুলি সব নষ্ট করে দিয়েছে।”
রক্ত চড়ল নীলুর মাথায়। কারো কাছে কিছুই জিজ্ঞেস না করে একছুটে রাজমিস্ত্রির কোদালখানা কুড়িয়ে নিয়ে ছুটে গেল মায়ের দিকে। কেউ কিছু বোঝার আগেই কোদাল দিয়ে উপর্যুপরি প্রবল আঘাত করলো মায়ের মাথায়। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটলো। হাজার হাজার রক্তজবা তার গাঢ় লাল রঙে রাঙিয়ে দিলো নীলুর দুটি হাত। প্রাণফাটা আর্তচিৎকারে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন মা আর একই সাথে চিরকালের মত থেমে গেল প্রাণপ্রিয় পুত্রের হাতে স্নেহকাতর মাতৃহৃদয়ের হৃদস্পন্দন। হৃদয়বিদারক এ দৃশ্য দেখে বাকি সকলে বাক্যহীন পাষাণ মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইলো মুহূর্তকয়েক। নীলু তখনও রক্তমাখা হাতে স্থানুর মত দাঁড়িয়ে – ভাবলেশহীন, নির্বিকার। ঘটনার আকস্মিকতায় সকলেই স্তম্ভিত, হতচকিত, বিমূঢ়।
পরবর্তী ঘটনা সংক্ষিপ্ত। নীলুর স্থান এখন জেলকারাগার। বয়স কম আর অকপটে সব স্বীকার করায় বিচারক নীলুকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দন্ডিত করেছেন।
বোবা কান্নার একটা তামস অনুভূতি বুকের মধ্যে দোল খাচ্ছে, পাক খেয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে দুচোখের কোণ বেয়ে, কিন্তু কাঁদতে পারছেনা নীলু। মনে হচ্ছে তীব্র চিৎকার করে বুকের মাঝের এই অসহ্য পাথরচাপা বেদনাকে বাইরে টেনে এনে ছুঁড়ে ফেলে দেয়, কিন্তু না!পারছেনা – সে পারছেনা! কোন শব্দই গলা বেয়ে বাইরে বেরিয়ে আসছে না। অসহ্য যন্ত্রণায় পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে বুকের ভিতরটা। সে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছে সারা শরীর, কিন্তু কিছুই করতে পারছেনা নীলু।
হঠাৎ নিজের হাতদুটোকে চোখের সামনে তুলে ধরে তীব্র ঘৃণার জ্বলন্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো নীলু। মৃত মায়ের নিষ্পাপ ঘুমন্ত মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল তার। এই সেই হাত! হ্যা, এই দুটো হাত দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে, মেরে ফেলেছে সে তার আপন গর্ভধারিনী মাকে – যে মা অজস্ৰ প্রশ্রয় দিয়ে, আদর দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে, বুকের সবটুকু স্নেহ উজাড় করে দিয়ে একটু একটু করে বড়ো করে তুলেছে তাকে – সেই মাকে হত্যা করেছে, মেরে ফেলেছে সে!
হঠাৎ অন্ধকার কারাপ্রকোষ্ঠ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। মায়ের হাসিমুখটা তার দিকে তাকিয়ে আছে। অপার্থিব একটা জ্যোতিতে ভরে আছে চারিদিক। তারপর আবার সব অন্ধকার! আবার কান্না পেলো নীলুর। কিন্তু কাঁদতে সে পারলো না। হঠাৎ কারা প্রাচীরের দেয়ালে নিজের হাতদুটোকে ঘষতে থাকে সে শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে। ঘষতে থাকে – ঘষতেই থাকে – যতক্ষণ না ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত টুপ্ টুপ্ করে ঝরে পড়ে কনুই বেয়ে বেয়ে।
হ্যা, হয়েছে! এবার হয়েছে!!এইতো মায়ের দেওয়া শেষ রক্তবিন্দু!! একটা নীরব তৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে নীলুর দু ঠোঁটের কোণে।
পরিচিতি

শুক্লা বোস। মোংলা অঞ্চলের জ্ঞানের প্রধান বিদ্যাপীঠ শেলাবুনিয়ায় অবস্থিত সেন্ট পলস্ উচ্চ বিদ্যালয়-এর স্বার্থক ও কৃতি শিক্ষিকা। সুদীর্ঘকাল শিক্ষকতার পর শিক্ষার্থীদের প্রাণপ্রিয় এই শিক্ষিকা মার্চ ৪, ২০২০সাল থেকে অবসরে আছেন।
ছেলেবেলার থেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, জীবনানন্দ দাশ সহ বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য প্রথিতযশা কবি ও সাহিত্যিকদের লেখার সান্নিধ্যে বেড়ে উঠেছেন। কখনও কখনও লিখেছেন আত্মার সন্তুষ্টির জন্য। আত্মপ্রচারে বিমুখ হওয়ায় নিজের ভিতরেই রেখেছেন নিজেকে – তেমনভাবে বাইরে প্রকাশিত হয়ে ওঠা হয়নি।
বর্তমানে অবসর জীবনের একঘেঁয়েমি কাটিয়ে জীবনযাত্রায় কিছুটা ভিন্নতা ও বৈচিত্রের ভিতর দিয়ে সময় কাটানোর জন্যই বেছে নিয়েছেন বই পড়া ও লেখালেখিকে। সাহিত্যের মাধ্যমে মানুষের আত্মশুদ্ধি হোক, মানুষ সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠুক – এই প্রত্যাশাই তার ভাবনায় জীবন জুড়ে বিকশিত।