ভূতও ভয় পায়
– জয়শ্রী কর
ভাইকে ডেকে রুম্পা বলে চলনা চড়কমেলা
দেখতে পাবি আঁধার হলে আতশবাজি খেলা।
না-না দিদি ওপথ দিয়ে চাই না আমি যেতে
মানুষ ধরার জন্য ওরা রাখে রে ফাঁদ পেতে।
তুই তো যাবি আমার সাথে নয় তো একা একা
দিনেরবেলা বেরোয় না রে দেয় না ওরা দেখা।
বিকেল বিকেল বেরিয়ে দুজন হাঁটছে তাড়াতাড়ি
চড়কমেলায় পৌঁছে দেখে দোকান সারি সারি।
এদিক-ওদিক ঘুরছে ওরা কিনছে এটা ওটা
নিজে খেল আধখানা চপ ভাইকে দিল গোটা।
সারা আকাশ উঠল রেঙে ফাটল আতশবাজি
মেঘবালিকার হাতে যেন পুষ্পভরা সাজি।
কী রে দিদি নামল আঁধার ফিরব কেমন করে
পা চালিয়ে চল তাহলে আমার হাতটা ধরে।
চোখের সামনে লম্বা কী এক দাঁড়িয়ে পথপাশে
আতঙ্কে ভাই জড়িয়ে ধরে অশ্রুজলে ভাসে
নাকি সুরে শুধায় ওদের খাবার কিছু আছে
দিদি বলে ঝুলির ভিতরে পাঁপরভাজা আছে।
দিদি ওটাই বাড়িয়ে দিল তখন ভুতের হাতে
ভয়ে ভীষণ কাঁপছে ওরা শিরশিরানি গা-তে।
ভূতবাবাজি পাঁপর নিয়ে উঠলো গাছের ডালে
ওরা তখন দৌড় লাগানো প্রাণপণে ফাঁকতালে।
মাকে ওরা বলল সবাই যখন ঘরে এল
পাঁপর পেতে হাসিমুখে ভূতটা চলে গেল।
সৃষ্টির মূলে নারী
– জয়শ্রী কর
হৃদয়ে নিহিত আছে কত রূপ তাঁর
আঁখি দুটি মায়াময়
বিপদে কাটায় ভয়
নারীর বিশ্বজয় একটি আধার।
কখনো জননী সে যে কখনো দুহিতা
স্নেহসুধারস ঝরে
ভরা আছে অন্তরে
অহরহ চোখে পড়ে সকলে জানি তা।
জায়ারূপে প্রতি সাথে কাটায় জীবন
সুখের সৌধ গড়ে
স্বামীর হস্ত ধরে
দুখ-সুখ ভাগ করে একীভূত মন।
নারীর আকাশ জয় কখনো সেনানী
আবার ধাত্রী রূপে
কাজ করে নিশ্চুপে
যমের অন্ধকূপে দড়ি টানাটানি।
জগত বাঁচাতে চাই নর আর নারী
প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা
নারীরা জোগায় আশা
ছড়ায় বিঘ্ননাশা শান্তির বারি।
খাপছাড়া
– জয়শ্রী কর
১
খোকনসোনা ঠিক দুপুরে
কাটছে সাঁতার মাঝ-পুকুরে।
মারল গুঁতো বোয়ালছানা
দেখতে পেলেই দিচ্ছে হানা।
২
রবির কিরণ পড়ছে জলে
মাছের খেলা জলের তলে।
ভুবন হাসে সাতসকালে
মাকড়সা জাল বুনছে ডালে।
৩
এবার দিদার করুণ দশা
পৌষালী হিম মারছে কশা।
উলের পোশাক গায়ে দিয়ে
জপে ব্যস্ত মালা নিয়ে।
৪
খালে বিলে সন্ধে হলে
বিন্দু বিন্দু জোনাক জ্বলে।
জমা জলে মশার বাসা
টিয়া পাখির রংটা খাসা।
৫
বর্ষা হলে ভর্তি ডোবা
ব্যাঙের হর্ষ রয় না বোবা।
বৃষ্টিভেজা হাঁচি কাশি
উদবিড়ালের মিষ্টি হাসি।
৬
পাঁচশো হাজার টাকা নিয়ে
বিশাল লাইন ব্যাংকে গিয়ে।
এটিএম এর ভিতরে ফাঁকা
রিজার্ভ ব্যাংকে শূন্য টাকা।
চতুর শেয়াল কুপোকাত
– জয়শ্রী কর
শিয়ালভায়া চতুর বড় বাঁশবাগানে বাস
সন্ধে হলে হুক্কা-হুয়া গঞ্জে বারোমাস।
গাছের ডালে খাবার মুখে খাচ্ছে পিঠে কাক
ওকে দেখে শিয়াল বলে, ‘বড়ই মধুর ডাক।
তোমার ভারী মিষ্টি গলা গাওনা শুনি গান
শোনাও যদি খুশি হব রাখছি পেতে কান।’
প্রশংসাতে বেজায় খুশি গান ধরেছে যেই
মুখের খাবার পড়ল নীচে শিয়াল নাচে ধেই।
সন্ধেবেলা সাগর-চরে রোজ আসে বিড়াল
বালির ভিতর ঠান্ডা ঘরে কাঁকড়া আছে লাল।
দেখতে পেল খাবার নিয়ে শিয়াল আসে ওই
শেয়ালভায়া নাড়ল মাথা, ‘কেমনে কথা কই’।
বিড়াল বলে,’তাড়া কীসের, সামনে তো জঙ্গল
সঙ্গে তোমার ভাগ্নে যাবে ও’ বড় চঞ্চল।
ঠিক তখনই কাঁকড়া এসে চিপটে ধরে পায়
মুখ থেকে মাছ পড়ল ভুঁয়ে কাতর যন্ত্রণায়।
কার কপালে কী লেখা রয় জানে তা ঈশ্বর
শিয়ালভায়া মাছ হারিয়ে দুঃখে গেল ঘর।
একুশ উনিশ
– জয়শ্রী কর
অমর মাতৃভাষা দিবস
ফাগুন মাসের আট
শহিদ-রক্তে সিক্ত হলো
সেদিন ঢাকার মাঠ।
ভারতবর্ষে ভাষা-শহিদ
কোন নারী প্রথম
উনিশে মে দেখেছিল
কমলার বিক্রম ।
এপার বাংলা ওপার বাংলা
বেদনা নিঃসীম
রফিক-সালাম এঁকে দিল
আলপনা রক্তিম।
অন্য ভাষার প্রবল চাপে
বাংলা মৃতপ্রায়
জাগো জাগো বাঁচাও বাংলা
জননী তাই চায়।
দাদু-দিদার স্নেহ
– জয়শ্রী কর
দিদার কাছে কাটলো ক’দিন দারুণ মজা করে
ফিরে যাবার সময় হলে আঁখিতে জল ঝরে।
দিদা-দাদুর আদর স্নেহ খুশির ঝরনাধারা
আমরা ওদের নয়নমণি আকুল পাগলপারা।
সারাটাদিন ব্যস্ত কাজে তবুও নজর রাখে
যে যা খেতে ভালোবাসে বানিয়ে দেবে তাকে।
ডাক দেবে ঠিক একটুখানি চোখের আড়াল হলে
দেখতে পেলে বলবে দিদা, ‘যাসনি কেন বলে।’
ভাতের থালা বাড়িয়ে দিত মাছের মুড়ো দিয়ে
যত্ন করে খাইয়ে দিত আমায় কোলে নিয়ে।
উঠোনটুকু মাধবী আর শিউলি ফুলে ছাওয়া
সকালবেলা বইত মৃদু মিষ্টি মধুর হাওয়া।
শিউলিতলায় ফুল কুড়িয়ে কাটত আমার বেলা
মালাগাঁথা সাঙ্গ হলে এক্কাদোক্কা খেলা।
বৃষ্টি হলেই টুনটুনিরা ভীষণ খুশি হতো
পাতার জলে সিনান করে লুটত মজা কতো।
ছড়া লেখার কী আনন্দ বুঝে গেলাম আজই
নিত্য কিছু লিখে ফেলা এখন আমার কাজই।
দাদু-দিদা ছায়ার মতো আমার সহচরী
বলোনা মা ওদের এ-ঋণ কীভাবে শোধ করি।
কবি পরিচিতি
জয়শ্রী কর। জন্ম জুন ২, ১৯৫৬তে পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় কোলাঘাট থানার অন্তর্গত চিমুটিয়া গ্রামে মাতুলালয়ে। মাতা কমলাবালা, পিতা রামপদ মাইতি।
কোদালিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার প্রথম পাঠ। ১৯৭৪ এ ভোগপুর কেনারাম মেমোরিয়াল হাই স্কুল থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর পাঁশকুড়া বনমালী কলেজে স্নাতক স্তরে কলা বিভাগে ভর্তি হন। পড়া চলাকালীন ১৯৭৬ এ ডক্টর অজিত কুমারের সঙ্গে শুভ পরিণয়। কৈশোর থেকেই খেলাধুলা, সেলাই ও শরীরচর্চার সঙ্গে তিনি যুক্ত। পরে গিটার, তবলা, যোগ ব্যায়াম এবং কাব্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন। নিজে একজন সংগীত শিল্পী ও সুরকারও বটে – বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি ও সংগীত পরিবেশন করে থাকেন।
প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘নীল আকাশের কোলে’ পাঠকমহলে খুবই সমাদৃত। রাজ্য সরকারের তরফে রাজা রামমোহন রায় লাইব্রেরীর ফাউন্ডেশন এবং বঙ্গীয় প্রকাশক ও পুস্তক বিক্রেতা সভার যৌথ উদ্যোগে তার বই কেনা হয় পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার গ্রন্থাগারগুলির জন্য। এছাড়া আরো দুটি কাব্যগ্রন্থ – ‘ভোরের বাঁশি’ এবং মায়াডোর’ – প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যে। প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তার কবিতা রচনার প্রেরণা। প্রতিদিন কবিতা লেখা, কাব্য আলোচনা আর গানবাজনা নিয়ে এখন দিন কাটছে।