ভাঙা কাঁচে
– সুমিত্র দত্ত রায়
সরোবরের স্বচ্ছলতাকে তুচ্ছ করে –
পুরাতন এক ভাঙাকাঁচে চোখ রেখে;
আত্মার বিকৃতি খুঁজছো পাগল মনে,
ফিরে দেখছো না তাঁর ক্ষয়িষ্ণু বসন।
ডুব দাও একবার স্বচ্ছতার নীরে।
যখনই আকুপাকু করবে জীবন
সে সময়ে উত্তরও মিলে যাবে ঠিক,
শুধু একবার ডুব দাও অগাধ সলিলে।
কষ্ট যা দেবে তাঁকে সব ফেরত পাবে,
শূন্যতা সংগে নিয়েই ফিরতে যে হবে।
কোন দেনা পাওনাই তাঁর জন্যে নয়,
বিত্তে ভরে না চিত্ত, গণ্ডিও মানে না যে!
ভাব, তাকে বন্দী করে রেখেছো খাঁচায়!
উড়ে গেলে তাকে আর ফিরেও পাবে না।
আজ, হলে নীলকান্তমণি বিচ্ছুরিত
বিচ্ছুরণ রুখবার সাধ্য কী তোমার!
ক্লান্তি নেই, দুঃখ নেই, নেই অবসাদ –
আনন্দ, আবেগ নেই; নেই উচ্ছ্বাসও।
জীর্ণ বসন শুধু তাঁরই খেলাঘর,
লক্ষ্য তাঁর অচঞ্চল; স্থির – সত্য – ধ্রুব।
ধুমকেতু
– সুমিত্র দত্ত রায়
চাঁদ পেরিয়ে গেছো অনেকে দিন –
এখন তুমি ধুমকেতু এলাকায়,
আমার কাছে দূরবীন তো নেই,
বলো কি করে দেখি আমি তোমায়?
সূর্য উঠলে লুকোতে তোমায় হবে,
যেমন লুকিয়ে জেগে রয় ধ্রুবতারা।
তা বলে কি দিন আসবে না ভোররাতে?
কখনো সূর্য – থাকে কি জগৎ ছাড়া?
চাঁদ-স্বপ্নের মধুর রাত আজ দূরে,
হয়তো মনের কোণায় ঘুমিয়ে আছে!
পূর্ণিমা বা অমাবস্যার গান –
এক, নীরব মনের যন্ত্রণাতে ধুঁকছে।
এখন তুমি ধুমকেতু এলাকায়,
পুচ্ছে করছো আমাকেই কশাঘাত!
অল্প তোমার ভালবাসা চেয়ে আজ –
দেখছি, আমার এ জীবনটা বরবাদ।
সবার আমি
– সুমিত্র দত্ত রায়
পারলে পাথরটা নয় আমাকে দিও,
স্থবির অনড় তবু হিমালয়সত্য –
জমাটবাধা পাথরটা আমাকে দিও।
আগলে রাখবো ওকে বুকের গভীরে,
আগুন নেভা উল্কাগুলো আগলে রাখে,
যেমন করে এই সর্বংসহা পৃথিবী।
হাল্কা হও বন্ধু, এবার বোঝাটা দাও;
দুঃখবোঝা তোমার একার কেন হবে?
বন্ধুত্বের এটাই তো প্রথম সোপান।
ধরণী
– সুমিত্র দত্ত রায়
সন্ধ্যার তিমিরে কালোমেঘের আনাগোনা,
সাঁঝতারা তবুও উজ্জ্বল, রবির কিরণ গেছে মুছে।
এরমধ্যে হঠাৎই সিঁদুরে মেঘ লাল আভা নিয়ে,
যেন একরাশ কালো চুলের বাহারে নিজেকে ঢেকে,
রক্তিম সীমন্ত রেখাকে রাঙালো।
অশনিসংকেতে দ্রুত আগমন,
পলকে পলকে আহ্বান –
লুকোচুরির রাত্রি অভিসার নিরিখে ব্যর্থ ধরণী,
দামাল ঝড়ের সেই মহা আস্ফালন।
তারপর একসময় বন্ধ বাতাস,
রুদ্ধ নিশ্বাসের মতো।
ময়ুর-ময়ুরীর পেখম তোলা নাচনে,
মাতলো নিজেই –
বৃক্ষে বৃক্ষে সঞ্চারিত প্রলয় তাণ্ডব,
ধমনিতে উষ্ণ প্রবাহ,
সর্বংসহা ব্যস্ত হলো তাণ্ডব সামলাতে।
রাঙা আভা
সীমন্ত ভেদ করে ছড়িয়ে পড়লো সর্বাঙ্গ জুড়ে,
তোলপাড় করে দিলো সব সংযম,
ভাসলো নব চেতনাতে।
থরথর কম্পিত অনিশ্চয়তায়,
এবার নামলো বৃষ্টিধারা,
কি ভীষণ রমনীয় পুলকে রঞ্জিত সেই ক্ষণ –
সে শুভ লগন।
চরম স্থিতিশীলতা ভরালো অন্তর,
এখন সে সদ্যোস্নাত মনে –
ব্যস্ত হলো আপন সজ্জায়।
ব্যস্ত হলো সবুজের প্রতীক্ষায়।
নবাগত নক্ষত্র আকাশের বুকে,
ধরণী লুকায় মহাসুখে।
জলছবি
– সুমিত্র দত্ত রায়
ছেলেবেলার জলছবি মিথ্যে হয় না,
কিছুতেই মোছাও যায় না।
জলপরী খেলতো গোলাপ বাগান ঘেঁষে,
যেখানে উড়ন্ত প্রজাপতি এসে –
নাম না জানা ঠিকানায় চিঠি নিয়ে
জেঁকে বসতো সবার আড়ালে,
নাগালের অনেক..অনেক ..বাইরে।
কিন্তু কোন উড়ো চিঠিই এলো না –
স্মৃতির নাগালে,
পিওন রোজ আসে, রোজ চলে যায়,
ওর মন জুড়ানো খবর আসে কই!
তবুও না কি স্মৃতি ওকেই ভালোবাসে!
আমার দিভাই ঠিক এমনই বোকা ছিলো।
সত্যিই কি নীল খামে আসবে না কিছু?
শেষে ওকেও কি যেতে হবে বদ্ধ গরাদে,
যেখানে ওর প্রেমিক রয়েছে বন্দী এখনো,
ভুলের মাশুল গুনছে অবিরাম দিনরাত।
হয়তো স্মৃতিরও
সেখানে যাবার ঘন্টা বেজে গেছে,
এখন ওর খুবই নিশ্চিত বিশ্রাম প্রয়োজন
নিশ্চিত বিরাম….ক্লান্ত এক ঘুম ….।
হঠাৎ জলছবি মুছে যাচ্ছে কেন?
ডিলিটে তো হাতই পড়ে নি!
তবু,
আশ্চর্য ভাবে ওরা মুছে যাচ্ছে – কেন?
মুছেই চলেছে…মুছেই চলেছে …।
আসলে কোণায় কোণায় থাকা –
কানায় কানায় ভরা জল,
তন্দ্রাবেশে জলছবিটা –
ঝাপসা করে দিলো।
কি জানি হয়তো বা
কোথাও ভাসবে আবার …
আবার ভাসবে …কোনদিনও…
কবি পরিচিতি

সুমিত্র দত্ত রায় কবির ছদ্মনাম। প্রকৃত নাম সংকেত চট্টোপাধ্যায়।
আমি ছেলেবেলা থেকে ভাগীরথী কূলে বড় হয়েছি। আমার একাধিক লেখার প্রেরণায় গঙ্গার ভুমিকা অনেক। ওখানেই দেখেছি সূর্যাস্ত বা তৎকালীন মেঘরঞ্জনী। আদি বাড়ির কথা দিদির চোখে দেখা। বরিশালের শোলক গ্রামেই পিতৃভূমি ও বাটাজোরে মাতুলালয় ছিল। পিতা ঈশ্বর যোগেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মাতা ঈশ্বর বিজনবালা দেবী। পারিবারিক জীবনে স্ত্রী রুমা চট্টোপাধ্যায় আর এক কন্যা সপ্তদ্বীপা চট্টোপাধ্যায়। ভাই নেই। দুই দিদি, গীতা মুখার্জী আর অঞ্জনা মুখার্জি। পিতা যোগেশচন্দ্র ছিলেন দেশপ্রেমিক। বরিশাল হতে বন্দী হয়ে দমদম সেন্ট্রাল জেলে বদলি হন। তাঁদের রক্তে কিছুটা দুঃসাহসী আমিও ছিলাম। কিন্তু কবিতার জগত আমার নিজস্ব মনে হত সেই দশবছর বয়সেই। আবৃত্তি, গান, ছবি আঁকা আমার খুবই পছন্দসই ছিলো। চাকুরিজীবী ছিলাম। এলাহাবাদ ব্যাংকে আধিকারিক। বদলির চাকরি। তাই ২০১২ সালে স্বেচ্ছায় অবসরের পর বাংলা কবিতা ডটকমে লেখা শুরু, আমার কন্যাপ্রতিম সোমালীর হাত ধরে। আর পিছু ফিরে তাকাই নি, এখন ওটাই ধ্যান জ্ঞান।