সামাজিক সম্প্রীতির সূচনালগ্নে
– যোষেফ হাজরা
মানুষ সামাজিক জীব। প্রাচীন কাল থেকেই মানুষ পরিবার ও সমাজের অংশ হিসেবে নিজেকে নিরাপদ ও সঙ্ঘবদ্ধ মনে করে। মানুষ পরিবারের বাস করতে চায়। কারণ পরিবার থেকে সে পায় ভালবাসা, সম্মান, নিরাপত্তা, সহযোগিতা, সহশীলতা, ক্ষমা ইত্যাদি। পরিবারে মা-বাবা, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, ভাই-বোন, দাদি-নানির নিয়ে একত্রে বসবাস মানুষকে মানসিক তৃপ্তি দেয়। আমরা পরিবারে বিভিন্ন সদস্যের সাথে থেকে বহু ধরণের ভাব বিনিময় করি। আচার-ব্যবহার, কথা-কর্মকৌশলে প্রতিটি সদস্যের জন্য একটি বিশেষ ভাবধারা ও ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করি। আদতে আমরা মিলেমিশে বসবাস করি। পরিবার থেকে সমাজ, দেশ ও পৃথিবীর সকল মানুষের সহযোগী সংগঠন তৈরী হয়েছে। পরিবারে কখনো কখনো আমরা ভুল করি। তখন পরিবার থেকেই শিক্ষা লাভ করি, এই ভুল কীভাবে সংশোধন করা যায়। কোন সদস্যের সাথে খারাপ ব্যবহার করলেও আমরা পরক্ষণেই সে কথা ভুলে যাই এবং ক্ষমার মাধ্যমে আবার একত্রিত হই। কিন্তু পরিবার থেকে কখনো দূরে চলে যাই না। পরিবার আমাদের প্রত্যাখ্যান করে না। আমরা শিশুবেলায় মা-বাবার সাথে বুঝে বা না বুঝে যে ভুল করে থাকি সেসব মা-বাবা হাসিমুখে মেনে নেয়। কখনোবা আমাদের ভালোর জন্যই শাষণ করে। এর মাধ্যমে আমরা সঠিক পথের সন্ধান পাই এবং জীবন ধারণের জন্য কি করা উচিত বা কী করা উচিত নয় সেটা কাজে ও ব্যবহারে রপ্ত করি।
এমন পৃথিবীর কল্পনা করাই যায় যেখানে কেউ অর্থ বা সম্পদের দিকে শুধু গরিব নয় বরং মানবিক দিক থেকেও ক্ষুদ্র নয়।
পরিবারের শিক্ষা আমরা সারাজীবন পেয়ে থাকি। তবুও আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাই বিদ্যাশিক্ষা লাভ করার জন্য। আমরা সেখানে ছোট পরিবার থেকে আরো বড় পরিবারে যোগদান করি। আমাদের সকলের উপর আমাদের শিক্ষক সকল শিক্ষার্থীকে সন্তানের চোখে সমানভাবে দেখে। সেখানে কেউ ধনী-গরিব নয়, কেউ হিন্দু, কেউ মুসলিম, কেউ মেধাবী, কেউ বোকা বা দুষ্টু, ছেলে বা মেয়ে সকল ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষকের চোখে সমান। আমরা সেখানে শুধুই তাদের সন্তানতূল্য, আর তারা আমাদের অভিভাবক/গুরুজন পিতৃমাতৃতূল্য। আমরা সেখানেও অন্যায় অপরাধ করি। শিক্ষকেরা আমাদের শাস্তি দেন, প্রহার করেন আমাদের ভাল হবার জন্য। ছাত্র-ছাত্রী বা সন্তানদের শাসন করতে কেউই চায় না। আমাদের কটু কথা বলতে তাদেরও কষ্ট হয়। আমাদের শাস্তি দিতে গেলে তারাও মনে ভীষণ যন্ত্রণা অনুভব করেন। তারা চান আমরা যেন সুনাগরিক হয়ে গড়ে উঠি। দেশের ও দশের কল্যাণে কাজ করি। আমরা লিখতে বা পড়তে পারি এটা শুধুই সাক্ষরতা। এমন পৃথিবীর কল্পনা করাই যায় যেখানে কেউ অর্থ বা সম্পদের দিকে শুধু গরিব নয় বরং মানবিক দিক থেকেও ক্ষুদ্র নয়।
শৈশবে কেউ মেধাবী থাকে, কেউবা চঞ্চল কিন্তু সেই সকল চিরস্থায়ী নয়। বয়সের সাথে সাথে আমরা সমাজের থেকে অনেক কিছুই শিখি। এমন কিছু শেখা উচিত যার মাধ্যমে আমরা আরো বেশি মানবিক হয়ে উঠি। স্কুল-কলেজে বিদ্যা শিক্ষার সাথে সাথে আমরা শিখি দশজন দশরকম মত ও ভিন্নতার সাথে নিজেকে কীভাবে মানিয়ে নিতে হয়। কীভাবে একজন দুরন্ত প্রকৃতির ছাত্র অন্য ছাত্রদের সাথে একই সাথে পাঠ নেয় ও যোগাযোগ স্থাপন করে। আমরা একে অপরের সাথে মিলেমিশে থাকি অবশ্যই আমাদের প্রকৃতির বৈচিত্রতা রক্ষা করেই। কারণ আমরা কেউই বৈচিত্রতার উর্ধে নয়। স্কুল বা পাড়ায় খেলার মাঠে কেউ ধনী বা গরিব নয়। আমরা সকলেই সকলের পরিপূরক।
স্কুল কলেজ ত্যাগ করে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে বা দূরের কোন বিদ্যাতীর্থে বিদ্যালাভের জন্য যাই। স্কুল-কলেজে যেখানে আমরা একই অঞ্চলের মানুষের সাথে চলার অভিজ্ঞতা ও সহশীলতা অর্জন করেছি সেই শিক্ষা আমরা আরো বৃহৎ পরিসরে ব্যবহার করি। বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশ বা দেশের বাইরে থেকে আসা বিভিন্ন সহপাঠীর সাথে আমরা পরিচিত হই। এই পরিবেশে আমরা যত দ্রুত অন্যদের সাথে মানিয়ে নেই তত আমাদের মন-মানসিকতা, দৃষ্টিকোণ, উদারতা, সহশীলতার বৃদ্ধি ঘটে। যদি আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজের মত একাকীত্ব বরণ করি বা সংকীর্ণ হয়ে যাই, তখন যেকোন মুহূর্তে আমাদের কোন বিপদ এলে কেউ এগিয়ে আসবে না। এবং সেটা আশাও করা উচিৎ নয় যে আমি অন্যদের থেকে সহযোগিতার হাত গুটিয়ে নিয়েছিলাম সেই আমাকে কেনই বা অন্য কেউ সাহায্য করবে? তবুও সমাজের অন্য মানুষ সহযোগিতার হাত বাড়ায়। আমাদের সেই মুহূর্তে বোঝা উচিত, অনুশোচনা করা উচিত সমাজের দশজনের কাছ থেকে আমার সরে আসা উচিত হয়নি। একজন ডাক্তার মনে করতেই পারে, হ্যাঁ আমি একাই নিজের পথ চলতে পারব। আমার অর্থের কোন অভাব হবে না সুতরাং দুস্থ ও দরিদ্রের কাছ থেকে আমার সদা-সর্বদা দুরত্ব বজায় রাখা উচিত।
কিন্তু আপনি নিজের কাছে প্রশ্ন করুন। আপনি কী শুধু আপনার নিজের জন্য লেখাপড়া শিখেছেন? আপনি কী চাইলেই একজন ডাক্তার হতে পারতেন? একটা প্রতিবেদনে দেখা গিয়েছে একজন ছাত্র স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে যে টাকা-পয়সা খরচ করে, তার থেকে সরকার বেশি টাকার সুযোগ সুবিধা দিয়ে শিক্ষকদের বেতন ও স্কুল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনার ভার প্রদান করে। সেই অর্থ আসে সাধারণ মানুষ দিন মজুর, শ্রমিকদের দেওয়া ভ্যাট, ট্যাক্স থেকে। সে কথা না হয় বাদ দিলাম যুক্তি বা তর্কের খাতিরে। এখন ধরুন, আপনার এলাকায় যদি স্কুল বা কলেজ না থাকত। আপনার বাড়ি থেকে যদি স্কুলে যাবার জন্য রাস্তা ও পরিবহন না থাকত বা আপনার ইউনিফর্ম যদি কেউ তৈরি করে না দিত, হয়তো আপনার পিতা কৃষিকাজ করেন না, যদি কৃষকেরা খাদ্যশস্য শুধু নিজেদের জন্য উৎপাদন করে আপনাকে না দিত, একজন সবজি বিক্রেতা যদি সেইসকল কৃষিজাত পণ্য বাজারজাত না করত। আপনি কি তাহলে আজ যে আপনি সেই আপনি হতে পারতেন? যদি নাই পারতেন তখন কী হত? হয়তো সেই আদিযুগের মত আপনাকে কৃষিকাজ বা মৎস্য আহরণ বা শিকার করতে হত বন্যপশুদের আর আপনি পরিধান করতেন গাছ-লতা-পাতা। সে কথাও না হয় বাদ দিলাম।
আপনার ধর্ম ও পরিবার কি আপনাকে শেখায় না অন্যদের সাথে হাসিমুখে কথা বলাও সুন্নত। আমাদের স্রষ্টা বা আল্লাহ্ বা প্রকৃতি আমাদের সকলকেই অনুপম রূপ দান করেছেন। আমরা কেউ অধিক বিষয়ে অভিজ্ঞ নই। আমরা প্রত্যেকে কিছু বিষয়ে পারদর্শী হয়ে উঠি। এটাই আমাদের বিবেকের কাছে প্রশ্ন, আমরা যদি একা কিছু নাই করতে পারি তবে সকলকে ভালবাসা, সম্মান ও নিরাপত্তা দিয়ে কেন আমরা সকলের মিলে ভালবাসা ও শান্তিতে বসবাস করি না?
আমরা মানুষ আমাদের অভাববোধ আমাদের আল্লাহ্ স্বয়ং এই জগতে পূর্ণ করতে পারেন না। আমরা সর্বদা আরো অধিক পেলে হয়তো খুশি হয়ে উঠি। কিন্তু এই অভাববোধ আমরা মাত্রাতিরিক্ত করে ফেলে জীবন ও জীবিকায় ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি করে ফেলি। সকল অভাববোধ পরিমিতিবোধ আবশ্যক। যে যেখানে যে অবস্থায় আছি সেই অবস্থায় মনে করুন আপনি ও আমি সুখী। আপনি যে অবস্থানে আছেন সমাজ আপনাকে এটাই সর্বোচ্চ দিয়েছে। আপনি যদি দুইবেলা অভুক্ত থাকেন তবে মনে করুন হয়তো আপনার আমার সামাজিক জীবন ব্যহত হচ্ছে এবং আপনার চেয়েও অন্য কেউ হয়তোবা অধিক দিন অনাহারে আছে। আবার আমরা প্রত্যেকে কিছু বিষয়ে পারদর্শী হয়ে উঠি। হয়তো কেউ একজন বা আপনি আমি সময় ও সম্পদের অপব্যবহার করছি তাই এই কষ্টকর দিন আমাদের দেখতে হচ্ছে। অতিরিক্ত চাহিদার যোগান দিতে গিয়ে আপনি বা আমি হয়তো জগতের সুন্দরতম বিষয়াবলী ধর্ম-বিজ্ঞান-দর্শনকে নেতিবাচক ব্যবহার করে থাকি, তবে সে দোষ আমার ও আপনার।
আপনি নিজেকে যেমন ভালবাসেন ঠিক তেমন প্রতিবেশীকে বা আপনার শত্রুকেও ভালবাসুন।
ঠিক এই কারনেই সামাজিক সম্প্রীতি আমাদের জীবনে অত্যাবশ্যকীয় বিষয় বলে মনে করি। আপনি নিজেকে যেমন ভালবাসেন ঠিক তেমন প্রতিবেশীকে বা আপনার শত্রুকেও ভালবাসুন। সকলকে ভালবাসে তাদের সম্মান ও নিরাপত্তা দিলে আমাদের সমাজে সেই অবস্থান কখনো সৃষ্টি হবে না যে অবস্থানে আপনি বা আমি কষ্ট পাচ্ছি বা অভাববোধ তৈরি করছি। কারণ এটাই সর্বোচ্চ যা আমরা সমাজ থেকে নিতে পেরেছি এবং সমাজের পরিমণ্ডল আমাদের দিতে পেরেছে। এরচেয়ে বেশি কিছু চিন্তা করার আগে ভাবুন হয়তো আমাদের সাথে আরো খারাপ কিছু হতে পারত। কিন্তু হয়নি। মানুষের জন্ম হলে সে মারা যায় এটা অখন্ডনীয়। মৃত্যু আমাদের জীবনে পূর্ণতা দান করে। মনে বিশ্বাস করুন যে আপনি মৃত্যুবরণ করলে মানুষ আপনাকে ভাল বলবেই বলবে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে সকলকে সমান চোখে দেখতে হয়। সকলের সাথে হৃদতা বজায় থাকলে অভাববোধ মানুষের কখনোই থাকে না।
ভালবাসুন ও ভালথাকুন। সামাজিক সম্প্রীতি আপনার আমার সুরক্ষা কবজ।
পরিচিতি

যোষেফ হাজরা। ছদ্ম নাম তারুণ্যের কবি।
আমি আমার জীবন গঠনের সময় বহু জায়গার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলাম। শহরের হাওয়া বা মফসলের জীবন এমনকি উত্তর আর দক্ষিণাঞ্চলের জীবনধারার ছোঁয়া আমি হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছি। আমার জন্মস্থান মোংলার স্বনামধন্য সেন্ট পলস হাসপাতালে। ১লা মে জন্ম হাওয়ায় ফাদার মারিনো রিগন আমার নাম যোষেফ (আধুনিকায়নে যোসেফ) রাখে। পিতা তাপস হাজরা, মাতা এন্ড্রো রিনা নাথ।
আমি প্রথম যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “আমাদের ছোট নদী” কবিতা পড়ে তার সম্পর্কে জানি তখন থেকেই তিনি আমার অনুপ্রেরণা। এ জন্য চিত্রকলা, সংগীত, আবৃত্তি, অভিনয় ও পরবর্তীতে সেন্ট পলস স্কুলের লাইব্রেরি ও বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের অপার সুযোগে লেখালেখির হাতে খড়ি দেই। সকল শিল্প-সংস্কৃতি থেকে আমি লেখালেখি করতে বেশি ভালবাসি। কারণ মনের কথা সম্পূর্ণরূপে ব্যক্ত করে, ভাষার জাদুকারিত্বে, জ্ঞান ও দর্শনের যে সমন্বয় হয়, সেই আত্মদর্শনে সম্পূর্ণ আত্মতৃপ্ত করতে সক্ষম। আমি যদিও রবীন্দ্রনাথকে গুরুদেব মানি তবুও তার ধাঁচে আমি লিখি না। আমি কাব্য ও রচনায় অন্যান্য ঢং রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করি যাতে কেউ পড়ামাত্রই বুঝতে পারে এই লেখনীর স্রষ্টা কেবলমাত্র আমি।