জননী
– দেবকুমার মুখোপাধ্যায়
ঐ পুত্র বেঁধেছে আমায়
ও আমার পুত্র বটে!
ওকে আমি গর্ভ থেকে এনেছি আলোকে
দিয়েছি স্তন্যের সুধা,
পরম যত্ন আর মমতায় তিল তিল ত্যাগে
ও ক্রমশ পুরুষ হয়েছে।
চারপাশ ঘিরে আছে যে মনুষ্যসমাজ
সকলেই সাক্ষ্য দেবে তার,
বাৎসল্যের নরম আলোয়
তাকে রেখেছি সর্বদা।
ও আমায় শিকলে বেঁধেছে —
যন্ত্রণার লোহার শিকল,
বন্ধ ঘরে আমাকে বন্দী রেখে
ও থেকেছে মুক্ত আলোয়।
আজ আমি শিকল ভেঙেছি
নিজ হাতে নিজস্ব শক্তিতে।
প্রহরী, দরজা খোল
ধরো তাকে,
শাস্তি দাও
আমি বলছি —
আমি মাতা, পুত্রের জননী।
মর্ত্যভ্রষ্টা
– দেবকুমার মুখোপাধ্যায়
স্বর্গভ্রষ্টা তুমি কোন্ অপ্সরা এলে।
কোন্ দেবতার অভিশাপ
টেনে আনল এই মর্ত্যে,
কী বা ছিল সেই পাপ
যার জন্যে এই শাস্তি চরম —
আমাদের এ সবের বিন্দুবিসর্গ জানা নেই।
মাত্র কটা মাসে জেনে গেলে
মর্ত্যভূমি কী নিষ্ঠুর —
হত্যার উৎসব চলে অহোরাত্র,
কন্যাজন্ম আকাঙ্ক্ষিত নয়
পিতা শুধু হতে চায় পুরুষ -পালক।
স্বর্গে ফিরে এই বার্তা জানায় অপ্সরী।
সন্তান
– দেবকুমার মুখোপাধ্যায়
জন্মের আগে থেকে সে সঙ্গী
দিনে রাতে সর্বক্ষণ
আনন্দে, বেদনায়।
বড় হতে হতে তার দূরে যাওয়া
মেঘের মতোই ওড়াউড়ি
দূর থেকে দূরের আকাশে
দিক থেকে দিগন্তে।
বৃষ্টি হয়ে নেমে আসে ঝিরঝির
মর্ত্যের উঠোনে, বাগানে
ফোঁটায় ফোঁটায়।
সে আমাদের প্রার্থনায় থাকে
নিত্যদিন
আজন্ম
আমৃত্যু।
শেষ ইচ্ছে
– দেবকুমার মুখোপাধ্যায়
রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছে ছিল —
শান্তিনিকেতনের মাটিতেই
তাঁর চিতাভস্ম ছড়িয়ে যাবে।
মহাশ্বেতার সাধ ছিল —
পুরুলিয়ার জমির নিচেই
পাতা হবে তাঁর শেষ শয্যা।
সুনীল গাঙ্গুলীর অঙ্গীকার ছিল —
হাসপাতালে কঙ্কাল হয়ে ঝুলবে
তাঁর দেহের কাঠামো।
কারও ইচ্ছেই পূর্ণ হয়নি,
সবার শেষ ইচ্ছেকেই
গ্রাস করেছে কলকাতা।
অহঙ্কারী একনায়ক,
তার ইচ্ছেই সব
তার কথাই শেষ কথা।
স্বপ্ন, ঘুমে
– দেবকুমার মুখোপাধ্যায়
মাথার বালিশের মধ্যে
স্বপ্নরা লুকিয়ে থাকে ঘুমে।
মধ্যরাত পার হয়, রাস্তার কুকুর ডাকে
বটের মাথায় অন্ধকার জট বেঁধে যায় ;
এই সব সময়েই স্বপ্নরা বেরিয়ে আসে
বালিশের মধ্য থেকে
ঢুকে পড়ে মস্তিষ্কের কোষে,
কথা বলে, পায়চারি করে,
ইশারায় হাত নেড়ে ডাক দেয় দূরে
নাচে, গায়, আনন্দে হাসে
কখনো বা সন্ত্রাস ছুঁড়ে দেয় ঘুমের দুচোখে
ঘুমটি ভাঙিয়ে দিয়ে
ফের তারা ঢুকে পড়ে বালিশের
তুলোর ভিতরে,
অধরা অদৃশ্য তারা কিচ্ছুটি জানে না,
স্বপ্নের দৃশ্যেরা পলাতক
চলে যায় দ্রুত বিস্মরণে।
কবি পরিচিতি

দেবকুমার মুখোপাধ্যায়। পশ্চিম বাংলা, ভারত। জন্ম ১৯৫০। স্নাতক। বর্তমানে বসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ককর্মী।
ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির শুরু। কবিতা, ছড়া, ছোট গল্প, অণু গল্প, নিবন্ধ লিখে থাকেন। বড়দের জন্য, ছোটদের জন্যও। কিছু কিছু অনুবাদও করেছেন, ইংরাজি থেকে বাংলায় — কবিতার, গল্পের।
বিভিন্ন পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়েছে ও হচ্ছে। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে — আসলে আলোর জন্যে, এখানে তরঙ্গ এখানে জীবন, জলের উপমা (এককভাবে), আর যাঁরা কবিতা পড়েন না (দুজনে মিলে), ছড়ার মজা খাস্তা গজা ও চার মাথার মোড় (চারজনে মিলে)।