ভোর
– শুক্লা বোস
সেদিন আমার লালিত জীবনে প্রথম ঊষার বেলা,
পুষ্পিত শাখে তনুলতা ঘিরে যৌবন করে খেলা।
ক্ষুদ্র শরীরে গোপনে নীরবে মর্মরধ্বনি বাজে,
দেখেছিনু তোমা নবীন প্রভাতে এ দুটি আঁখির মাঝে।
পাখির কূজনে আমার বিজনে মনের গোপন কোণে,
স্বগত আবেশে ভাবাবেগ বশে বলেছিলো কানে কানে।
“জনমে জনমে যার লাগি তুই কেঁদে ফিরেছিস রাধা,
এই সেই শ্যাম! নীল নটবর, যার প্রেমে তুই বাঁধা।”
মনের প্রান্তে কোন অজান্তে পাখি গেয়েছিলো গান,
সপেছিনু প্রাণ চরণে তোমার জীবন করেছি দান।
তারপর এই দীর্ঘ জীবনে কতশত পরিহাস,
নিবাতে চেয়েছে জীবন প্রদীপ, কে রাখে হিসাব তার।
রক্ত ঘামের চোখের জলের কত ইতিহাস লেখা,
ঘাত-প্রতিঘাতে ক্ষুধিত জীবন – অদৃশ্য কথায় আঁকা।
অগ্নিবর্ষী গ্রীষ্মের মাঠে -দুজনেই দুজনার,
বেপরোয়া প্রাণ, লড়াকু জীবন – কত না হয়েছে পার।
আজ… জীবনের ভারে পীড়িত হৃদয় আঁখির দৃষ্টি ঘোর,
তবু দেখি চেয়ে তোমার নয়নে, সেই পাখি ডাকা ভোর!!
স্বভাব
– শুক্লা বোস
ভাবতে কেমন লাগছে বোকা,
নিজেকেই দিচ্ছি ধোঁকা।
এই তো সেদিন সখের বশে,
খাতা-কলম ধরনু এসে।
এরই মধ্যে মনের মাঝে কবি কবি ভাব,
হা-হা-হা, পাচ্ছে হাসি, এমনি স্বভাব!
কবি আমি নইকো বটে,
বিদ্যে-বুদ্ধি নেইকো ঘটে।
সবটা আমি নিজেই জানি,
কবি তো নই তাও তো মানি।
তবু, কেউ যদি কয় স্বভাব কবি,
চমকে উঠে কেবল ভাবি,
সত্যি কী আর এমন হবে?
কেন কবি বলে তবে?
আনন্দে প্রাণ ছলকে ওঠে,
প্রাণের মাঝে কাব্য ছোটে।
পিক-পাপিয়া কুহু সুরে,
গান গেয়ে যায় মধু স্বরে।
খাতা-কলম যেই না ধরি,
হায়-হায়-হায়! ওমা হরি!
কাব্য কোথায় পালায় ছুটে,
কলমখানা পড়ে লুটে।
আসেনাকো কিচ্ছু মাথায়,
প্রাণটা ভরে নীরব ব্যথায়।
তবু, মনের মধ্যে মাঝে মাঝেই কবি কবি ভাব —
হা-হা-হা পাচ্ছে হাসি, এমনি স্বভাব!!
তোমার বিচার হোক
– শুক্লা বোস
ক্লান্তির জড়তা চোখে –
দুর্বোধ্য ধাঁধায় ঘোরে জীবনের চাকা।
মৃত লাশের স্তুপে উৎকীর্ণ প্রশ্নবাণ…
জীবন জিজ্ঞাসা নিরুত্তর।
কবে, কখন, কোথায় জীবন রুখে দেবে
মরণের নাব্যতাকে? উত্তর নিরুপায়।
অনেক নিয়েছো মৃত্যু – দিয়েছো অনেক শোক..
আজ হোক তোমার বিচার।
গঙ্গায় লাশের সারি – ইঙ্গিত দিয়েছে মহাকাল,
দিনবদলের পালায় জীবন সামিল হবে।
পিছনে রয়েছে বিশ্ব-ঘৃনায় উচ্চকিত হৃদয় উদ্দাম!
অসংখ্য হৃৎপিণ্ড উপড়ে নিয়েছো পিশাচ,
প্রতিরোধে প্রতিশোধে হোক আজ তোমার বিচার!
ঘরে, মাঠে, পথে, ঘাটে একসূত্রে গাঁথা জীবনের বাঁধ —
উদাত্ত আহ্বান আর উদ্দাম শ্লোগানে একটাই দাবী
জীবনের —
আজ হোক তোমার বিচার!!
কবি পরিচিতি

শুক্লা বোস। মোংলা অঞ্চলের জ্ঞানের প্রধান বিদ্যাপীঠ শেলাবুনিয়ায় অবস্থিত সেন্ট পলস্ উচ্চ বিদ্যালয়-এর স্বার্থক ও কৃতি শিক্ষিকা। সুদীর্ঘকাল শিক্ষকতার পর শিক্ষার্থীদের প্রাণপ্রিয় এই শিক্ষিকা মার্চ ৪, ২০২০সাল থেকে অবসরে আছেন।
ছেলেবেলার থেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, জীবনানন্দ দাশ সহ বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য প্রথিতযশা কবি ও সাহিত্যিকদের লেখার সান্নিধ্যে বেড়ে উঠেছেন। কখনও কখনও লিখেছেন আত্মার সন্তুষ্টির জন্য। আত্মপ্রচারে বিমুখ হওয়ায় নিজের ভিতরেই রেখেছেন নিজেকে – তেমনভাবে বাইরে প্রকাশিত হয়ে ওঠা হয়নি।
বর্তমানে অবসর জীবনের একঘেঁয়েমি কাটিয়ে জীবনযাত্রায় কিছুটা ভিন্নতা ও বৈচিত্রের ভিতর দিয়ে সময় কাটানোর জন্যই বেছে নিয়েছেন বই পড়া ও লেখালেখিকে। সাহিত্যের মাধ্যমে মানুষের আত্মশুদ্ধি হোক, মানুষ সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠুক – এই প্রত্যাশাই তার ভাবনায় জীবন জুড়ে বিকশিত।