পরিযায়ী শ্রমিক
– অজিত কুমার কর
যাদের ছবি পড়ছে চোখে ওরা শ্রমিক পরিযায়ী
ওদেরও ঘরবাড়ি আছে এই ভারতে চিরস্থায়ী।
পেয়েছে বেশ গালভরা নাম
বেড়েই গেল ওদের সুনাম
লকডাউনে কী দুর্দশা প্রশাসন না, ওরাই দায়ী?
নিজামুদ্দিন, বিয়েবাড়ী স্টেশন বান্দ্রা হিল্লি-দিল্লি
সর্বক্ষেত্রে নিয়ম ভঙ্গ
দেখবো কত এমন রঙ্গ
সুরক্ষিত আমলা মন্ত্রী, মরুক শ্রমিক ছুঁচো বিল্লি।
দিল-কী-বাতের কী মহিমা শুনতে ছোটে হুমড়ি খেয়ে
বিকাশ না হয় নিকাশ হবে করোনা যে যাচ্ছে ছেয়ে।
কী যে ধান্দা ওদের মনে
শলা চলে খুব গোপনে
তদারকির নামে হুঙ্কার বারে বারে আসছে ধেয়ে।
সদিচ্ছা নেই ফিরুক ঘরে কত রকম ফক্কিবাজি
লক্ষ কোটির গল্প শোনায়
শ্রমিক তোমার দম আছে পা’য়
ঠান্ডা খাঁচায় বিশাল ভাড়া হাঁটার জন্য তৈরি পা-জি।
হাঁটার জন্য আকাশ তো নয় লাগে শুধু শক্ত মাটি
চালক তোমায় পিষতে পারে মনে রেখো এই কথাটি।
সকল জীবের মৃত্যু হবে
দুর্ভাবনা কীসের তবে
যুক্তি তর্কে লিপ্ত ওরা কাড়বে না কেউ এখন রা-টি।
পা চালিয়ে এগিয়ে চলো অনেকটা পথ এখন বাকি
যতই কষ্ট হোক না তোমার
আলো বাতাস ধরিত্রী মা’র
শুনতে তুমি পাচ্ছ নাকি আপনজনের ডাকাডাকি।
একলা বৈশাখ
– অজিত কুমার কর
পয়লা বৈশাখ একলা এবার ভয়ে গা ছমছম
সাতাশ ছিল এমনতরো এটা নয় প্রথম।
প্রতিবছর এমন দিনে সবার অবকাশ
এবারও সেই বিবর্ণ রূপ চৌদ্দোশো আটাশ!
হালখাতা নেই, মিষ্টি প্যাকেট, নতুন ক্যালেন্ডার
ভেবেছিলাম কদিন পরেই কাটবে অন্ধকার।
কৃষ্ণপক্ষের তৃতীয়া আজ সন্ধ্যা বিষাদময়
চাঁদ উঠেছে দা-এর মতো হয়নি পাপক্ষয়।
মাঠেই মারা গেল সবই কোথায় গেল সেল
নতুন জামার আশায় ছিলাম বড়ই বেয়াক্কেল।
একলা কারো ভালো লাগে, সকলেই বিরূপ
দিদিও আর খায় না চুমু খোলে না মুখ, চুপ।
ধরাছোঁয়ার বাইরে বাবা হাত ধরে না কেউ
সর্বদা মা ধরত এ হাত আসত যখন ঢেউ।
মা বলেছে আলদা শু’বি পাবি না আর কোল
কোলে শু’লে চুলকাবে কি, নয় মা বুনো ওল।
রাত্রে একা ঘুম আসে না গুনছি কড়িকাঠ
ঘুমের ঘোরে পেরোই আমি তেপান্তরের মাঠ।
পাঠশালা নেই পড়ছি ঘরে খেলার সাথি কই
এক্কাদোক্কা খেলি একাই করি না হইচই।
মোবাইলে অঙ্ক পাঠায় কেবল যোগ-বিয়োগ
নামতা আমি ভালোই জানি গুণ মানে তো যোগ।
বাবা এখন যায় না অফিস ঘরে বসেই কাজ
আনাজ কাটে, বাসন মাজে বারমুডা তাঁর সাজ।
আমার বাসন মাজি আমি গাছেও দেই জল
দিদির কাছে আঁকা শিখি রং দিলে ঝলমল।
পড়ছি রোজই সবকটা বই পরীক্ষা নেই পাস
জানি না স্কুল খুলবে কবে কাটল বছর মাস।
পাখি উড়াল দিল আজই
– অজিত কুমার কর
সূর্য তুমি আগুন ঝরাও কেন
খাঁচার পাখি উড়াল দিল আজই
মেঘবালিকা তুমিও যে মৌন রয়ে গেলে
পারলে না তো এক পশলা বৃষ্টি দিতে ঢেলে
ঠান্ডা রাখতে তুমিই পার করলে না সেই কাজই।
নিরবতা গ্রাস করেছে বাড়ি
এ ঘর এখন শূন্য একেবারে
আঙিনাতে এখনো তাঁর চরণচিহ্ন আঁকা
পাখি ছাড়া ঘর ও বাহির ভীষণ রকম ফাঁকা
উড়ুক উড়ুক ইচ্ছেমতো উড়ুক অন্য পারে।
নিষ্প্রভ বেশ সকল তারার আলো
ও চাঁদ তুমি জ্যোৎস্না দিয়ো রাতে
কেমন করে রইবে একা তখন আলো ছাড়া
ঊর্ধ্বপানে চেয়ে ও যে হবে আত্মহারা
ভুলো না চাঁদ দেখ কিন্তু কষ্ট না হয় যাতে।
রৌদরতাপে জীবন ওষ্ঠাগত
বাতাস তুমি ঠান্ডা হয়ে যেয়ো
তা না হলে গরমে ওর ভীষণ কষ্ট হবে
যায়নি বলে, জানি না তাই ফিরবে আবার কবে
পারলে তুমি সামনে পাখির প্রেমেরই গান গেয়ো।
আমি তো নই একা
– অজিত কুমার কর
দুপুর বড় একা
সত্যি বড় একা
এই সময় ঘরবন্দী সব
গাছের ডালে পাখির কলরব
ওরা জীবনরেখা।
সামনে ডোবা ভরা কচুরিপানা
কত প্রাণীর অভয় বসবাস
পানকৌড়ি ডাহুক মেলে ডানা
পাড়ে বেজির গুহা
এবার দেবে দেখা।
ওদের দেখে দুপুরটা ফুরায়
এমনি করে সময় কেটে যায়
ওরা আমার একান্ত আপন
আমি তো নই একা।
জ্যোৎস্নাভরা সোহাগরাত
– অজিত কুমার কর
সোহাগরাতে পাশাপাশি দুজনে শুয়ে খাটে
থালার মত চাঁদ উঠেছে বিনিদ্র রাত কাটে।
তোমাকে আজ লাগছে দারুণ ঘোমটা এবার তোলো
কেমন করে দেখলে তুমি, কালো চশমা খোলো।
আমার চোখে ঘুম আসেনি বসেই আছে জেগে
ঘুমের ঘোরে বললে কি সব, ‘বউ গিয়েছে ভেগে।’
এইতো আমি পাশেই আছি সেই শাড়িটা পরে
আসবে না তো ফিরে এ রাত জীবনে আর পরে।
তোমার রং তো দুধে-আলতা আমি ভীষণ কালো
ভাগ্য আমার সহায় ছিল বউ পেয়েছি ভালো।
অমন করে বলছ কেন রূপ কি ধুয়ে খাবে
ভালোবাসার টানে দেখো জীবন কেটে যাবে।
তুমি আসার পরেই এ ঘর পুরো বদলে গেছে
ঘরে-বাইরে মনের কোণে নতুন রং লেগেছে।
হনিমুনে আমরা যাব সমুদ্রসৈকতে
কাল বিকালে রওনা হব যাব সড়কপথে।
মা-হারা নই আমি
– অজিত কুমার কর
মানবো না মানবো না আমি মা নাকি আর নাই
ফিরতে আমার দেরি হল নীরব বুঝি তাই।
আমার কত কাজ
ডেকেছ তাই রওনা হলাম খুব সকালে আজ।
তোমাকে না বলে আমি কখন কোথাও যাই?
‘যাসনে খোকা’, বল যদি বাতিল যাত্রাটাই।
তুমিই আমার সব
তোমার কোলে স্থান পেয়েছি সে আমার গৌরব।
মা মানেই তো জগন্মাতা নেই কোনো তফাৎ
সকল কাজে সাফল্য পাই মাথাতে মা’র হাত।
মা আমার শিক্ষক
মার আশিসে ভাঁড়ার পূর্ণ এ জীবন সার্থক।
মা-হারা তো হইনি আমি রোজই দেখায় পথ
সত্য পথে হাঁটবো আমি এই আমার শপথ।
মা আমার দর্শন
মা-ই ধর্ম মা-ই সত্য মা বোঝে এই মন।
কবি পরিচিতি

জন্ম ১লা জানুয়ারি ১৯৪৬ পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কিসমৎ জগন্নাথ চক গ্রামে। মাতা রাজবালা, পিতা কালিপদ। মৌরাজল অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শুরু। ১৯৬২ সালে রামচন্দ্রপুর রাইসুদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে স্কুল ফাইনালে উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৩ তে পাঁশকুড়া বনমালী কলেজে থেকে প্রি-ইউনিভারসিটি ও ১৯৬৬ তে বিজ্ঞান বিভাগে সপ্তম স্থান অধিকার করে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক হন। ১৯৬৯ এ কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এস সি গণিতে প্রথম হওয়ার ছয় বছর পর ১৯৭৫ এ ওখান থেকেই পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। সিএসআইআর এর পোস্ট ডক্টরেল ফেলোশিপ পেয়ে পুল অফিসার হিসাবে দু’বছর গবেষণা করেন। ১৯৭৬ সালে জয়শ্রী মাইতি-র সাথে শুভ পরিণয়। এরপর হুগলি জেলার নবগ্রাম হীরালাল পাল কলেজে কুড়ি বছর অধ্যাপনার পর ২০০৫ এ গণিত বিভাগ থেকে রিডার হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।
তারপর প্রবেশ সাহিত্যের আঙিনায়, সহধর্মিণী ও কবি সুমনা প্রামাণিক এর অনুপ্রেরণায়। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ন’টি। ‘ঝিরিঝিরি বৃষ্টি তাথৈ তাথৈ নাচ’, ‘পঞ্চক’ ৪খন্ড, ‘লাঞ্ছিত গোলাপ’ এবং ‘রত্নমালা’। অপ্রকাশিত ‘ছড়ার ঘড়া’, ‘ঘড়া ঘড়া ছড়া’, ‘হাঁড়ি ভরা ছড়া’ ‘এক কড়া মিঠা ছড়া’, ‘কীর্তিমান’, ‘মহৌষধ বনৌষধি’, ‘শেয়ালের উপাখ্যান’, ‘প্রেম কাননে ফুটলো ফুল’ ইত্যাদি। কবির তিনটি ই-বুক ‘নীলাঞ্জনে রঞ্জিত’, ‘কে তুমি লাবণ্যময়ী’ এবং ‘কীর্তিমান’। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে কবির কবিতা, অনুগল্প ও প্রবন্ধ। বর্তমানে বাংলা-কবিতাডটকম ওয়েব ব্লগ সাইটে নিয়মিত কবিতা পোস্ট করেন। ই-ম্যাগাজিনেও কবিতা প্রকাশিত হয়। অবসর জীবন কাটছে সানন্দে সারস্বত সাধনায় পাঁশকুড়ার জয়াকুঞ্জে।