ঘরে ফেরা
– যোষেফ হাজরা
গির্জা বাড়িতে চুনকামের কাজ শুরু হল। উপলক্ষ্য বড়দিন। প্রতিবছর যুবক কমিটির সকলে মিল প্রায় চারপাঁচশো গাছের চুনকাম করে, রাস্তায় আলপনা গাম্য মহিলাদের সহযোগিতায় করে, গির্জা ঘর সাজানো এবং প্রভু যিশু খ্রিস্টের গোশালাঘর সাজিয়ে বড়দিন উৎযাপন করে থাকে। তাদের সাথে ইতিপূর্বে আমি কখনোই চুনকাম করি নাই। যেহেতু এই বছর আমি এই অঞ্চলে নতুন এসেছি, আগে ছিলাম ঢাকা বড়বাগ চার্চে যেখানে গান যা নাম মাত্র ছিল তাতে চুনকাম করার চাপ কেউ অনুভব করত না। দুইএকটা গাছ আধ ঘন্টার মধ্যে চুনকাম করা হয়ে যেত। এই শেলবুনিয়া ক্যাথলিক চার্চে চুনকাম করতে আমাদের বিশ জনের প্রায় এক সপ্তাহ লাগত।
দুই তিন দলে ভাগ হয়ে কাজ করার সুযোগ এখানে নেই। বিশাল এলাকায় একদুজন বসে কী একটাদুটো বিড়িতে টান মারে, না গাজা খায়, নাকি প্রেম করতে বসে যায় সেই ভয়ে সকলে একসাথে একদিক থেকে কাজ শুরু করেছি। প্রথমে গির্জার সামনের রাস্তা, তারপর হল রুমের আশেপাশে, ফাদার বাড়ি এপর বোডিংয়ের জঙ্গল, বড় দুই পুকুরের আশে পাশে জঙ্গল; সেখানে মশার উৎপাত তো ছিলই আর ছিল ভুতের ভয়। ভুত বলতে একটু বেশি বলা হয়ে যায় আসলে এখানে একটি কবর আছে। করবটা ফাদার যোয়াকিমের একটুকুই নাম বলতে পারি। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি মারা যান এবং তারপরে কিছু বছর অনেকে দেখাও দিয়ে যান।
গির্জা বাড়ির চুনকাম প্রায় শেষের দিন, দ্বিতীয় বড় পুকুরের আশপাশের জঙ্গলে আমরা চুনকাম করছি। আমার সঙ্গী মিল্টন আমাকে চুন বয়ে দিচ্ছে আর সাদাচুন লাগানোর পর লাল রঙের একটি বর্ডার একে দিচ্ছে। আমি জানতামই না এখানেই ফাদার জোয়াকিমের কবরটা আছে। প্রায় ডুবে গিয়েছে মাটির সাথে। বর্ষার সময় জলে ভরে যায়। মাঝে মাঝে কোদাল দিয়ে কবরের ফ্রেমটা বাইরে বের করে আনা হয়। তখন কবরের উপরের ক্রশটা চোখে পড়ে। যেহেতু আমি ভূত বিষয়ে বিশেষত্ব ফাদার জোয়াকমের ভুত নিয়ে এত ভয় পাই না, কেউই পায় না অবশ্য। সেই কবে বাংলায় ভূতগুলো দেখা যেত, এখন তারা পরবাসী হয়ে পৃথিবী ছেড়ে পালিয়েছে। এই বিষয়ে মিল্টন আর আমি একমত। চুনকাম করার সময় মিল্টন একটু পরপর চুন আনতে যাচ্ছে অন্য বড় পুকুরের পাশে রাখা ড্রাম থেকে। সেই ফাকে মিল্টনের লাল ডিব্বা থেকে ফাদার জোয়াকিমের কবরের উপর ম্লান ক্রশটাকে লাল রং করে দিলাম। দিয়ে কিছু মুহূর্ত দাড়িয়ে বিহ্বল হয়ে চেয়ে, কী হতে পারে অতীতের এই নিয়ে ভাবছি। মিল্টন এসে গেল চুন নিয়ে বালতিতে। ক্রুশটাকে লাল রং করেছি দেখে মিল্টন বলল, “ফাদার জোয়াকিম লাল রং বড় অপচয় করতেন।” এই বলে হাসল।
আমি বললাম, “তুই বাজে বকিস না। তোর জন্ম হয়েছিল নাকি এই সময়ে, যে তুই জানবি।”
“আরে আমি খুব ভাল করে জানি। শোন কেন অপছন্দ করত আমি জানি।” আমি ওকে মজা করার সুযোগ দিলাম যেহেতু এই কাজে আমাদের একঘেয়েমি ছাড়া আর কিছু নেই, হাতের চামড়াও পুরে যায়, আর গেঞ্জি প্যান্টও ময়লা হয়ে যায়।
আমি বললাম, “ক্যান বল দেখি।”
ও বলল, “ফাদার জোয়াকিম বিয়ে করেননি কিনা তাই।”
আমি বললাম, “তুই একটা ধাড়ি ছাগল।” তারপর দুজনে হো হো করে হেসে উঠলাম।
আমাদের চুনকাম শেষ, গ্রাম্য কমিটি আর যুব কমিটির মেয়েরা রাস্তায় আল্পনা শেষ করেছে। ছেলেরা গির্জা আর গোশালা তৈরি করেছে। নিয়ন আলোয় ভরে সাইদ সাউন্ডের ডেকরেটররা। চব্বিশ তারিখ ক্রিসমাস ইভের রাত রাত বারটা থেকে একটা পর্যন্ত অর্থ্যাৎ পচিশ তারিখ পার করে বড়দিনের গির্জা হয়। সকালেও একটা হয় তবে রাতের গির্জাতেই আনন্দ বেশি হয়। নিয়ন আলোয় আমরা যোগ করি কালি পটকা আর চকলেট বোমা। ফাঁকে মাঠে ফুটতে থাকে মিনিট তিরিশেক কিন্তু সেদিন মিল্টনকে খুজে পেলাম না। আলাদার করে বন্ধু তৈরি হয় নি ওর সাথে, শুধু কাজের খাতিরে এই সময়টা একসাথে ছিলাম। পটকা পোয়ানোর পর একদল নগর কীর্তন গাইতে চলে গেল। আমি রাত জোগাড় করা লোক নই। বাড়ির পথে হাটার সময় মিল্টনের নেংটা কালের বন্ধু জিমির সাথে দেখা। জিজ্ঞাসা করলাম, “কিরে তুই গেলি না নাচতে?”
ওর বলল, “একা একা গিয়ে কী হবে, মিল্টনের জ্বর হয়েছে বেশ। বাকি যারা আছে তাদের সাথে ভাল সম্পর্ক ওর। তাই ওর সাথেই ওদের সঙ্গে আড্ডা দেই।”
শীতকালে জ্বর শুনে অবাক হলাম। আমি আশ্বাস দিলাম পরে দেখতে যাব ওকে। কিন্তু বড়দিনের ঝামেলা আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি।
বড়দিনটা গেল। ইংরেজি নববর্ষটাও খ্রিস্টান মিশনগুলতে পালিত হয়। কারণ অবশ্য বাৎসরিক ধর্মীয় ছুটি আর এটা পালন করতে আলাদা খরচ দরকার হয়না তাই। নববর্ষ গির্জার আগেও কিছুটা মেনেজমেন্টের কাজ থাকে। বড় ফাদার তমাজেল্লী আমাদের ঠেকে পাঠাল তার অফিস রুমের পাশের লাইব্রেরিতে। যেহেতু নববর্ষ উৎযাপনের মূল দায়িত্বে আমার অংশীদারিত্ব আছে। বড়দিনের প্রোগ্রামে সেটা ছিল না। আমি সবার আগে লাইব্রেরিতে ঢুকে লাইট জ্বালিয়ে আবিষ্কার করলাম একটি পোট্রেট ঝুলানো আছে পশ্চিম পাশে দেওয়ালে মাঝখানে দুটো বুক সেল্ফের ফাঁকা জায়গায়। ছবি আঁকাআকি নিয়ে কোনদিন অত মাথা ব্যাথা আমার ছিল না। তবে এই ছবিটা বেশ ভাল ভাবেই আকা হয়েছে বুঝলাম। নিচে কোন কিছু লেখা নেই কিন্তু ক্রাসাক দেখলে বোঝা যায় এটা ফাদারের পেইন্টিং। পেইন্টিংয়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রংগুলো খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছি। মনে হল স্বর্গীয় ফাদার জোয়াকিমের নয়তো। ভাবতে ভাবতে পাশের লাইনগুলো কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে, এবং ফাদার জোয়াকিমই আমার দিক তাকিয়ে হাসছে।
এরপর ঘুম ভাঙল দেখলাম আমি সেন্ট পলস হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছি। আমার হাতে স্যালাইন ঝুলছে। একজন নার্স একে জিজ্ঞাসা করল, “কী আপনার ঘুম ভাঙল? একটু পরে বড় ফাদার আসছে আমার সাথে দেখা করতে আসবে।”
তখন তিনি আমার পাশে দাড়িয়ে ছিলেন। কিছু বলতে চেয়েছিলেন হয়তো। কিন্তু আর বলা হয়ে ওঠেনি তার বড় ফাদার আসার কারণে। বড় ফাদার এলেন, তিনি কোন কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “আমার কী হয়েছিল ফাদার?”
ফাদার বললেন, “তোমাকে লাইব্রেরির রূমে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে। গত দুইদিন তুমি এখানেই আছ ভর্তি হয়ে। এখন তোমার কেমন লাগছে।”
আমি বললাম, “ভাল।”
“তুমি কি আমাকে কিছু বলতে চাও?” ফাদার জিজ্ঞাসা করলে আমি না বলে দিয়েছিলাম।
এই ঘুমের মধ্যে আমি একটা স্বপ্ন দেখলাম। দেখলাম আমি একটা প্রাসাদের সামনে দাড়িয়ে আছি। বহু শরণার্থী আমাকে ঘিরে দাড়িয়ে আছে। আমি একটি গুদাম থেকে তাদের চাল-ডাল-তেল দিচ্ছি। অনেক দুর থেকে যারা এসেছে তাদের টাকা পয়সা দিচ্ছি। দিতে দিতে হঠাৎ যেন মনে হল অন্ধকার নেমে এল। কোথায় যেন যাচ্ছি আমি একদল শীতে আগুনের তাপ নিচ্ছে। পাশে রাইফেল, পিস্তল আর হাত বোমা রয়েছে। কী মিটিং হল ঠিক মনে করতে পারছি না। আমি বললাম দিয়ে দেও। আর আমার পাশ থেকে কেউ যেন একটা গামছায় করে কী যেন একটা দিল। আমি বললাম, “বিশের মত আছে, লাগলে আর পাবে।”
ওরা একটা রসের ঠিলায় ভরে রাখল। আমি চলে গেলাম। পরে দেখি যুদ্ধ আর যুদ্ধ। অনেক মানুষ মারা গেল। তারপর দেখলাম দেখলাম শতশত নারীরা নগ্ন হয়ে দৌড়ে যাচ্ছে। আর কাপড় কাপড় বলে চিৎকার করছে। ওরা একটুকরো কাপড় চায় হয়তোবা একটি পতাকা।
আমি এরপর মাঝে মাঝে এধরনের স্বপ্ন দেখতাম আর সাহসী হয়ে উঠতাম। আমি মিল্টনে সাথে একদিন দেখা করলাম। সেইদিনের ঘটনার কথা ওর কাছে কিছু শেয়ার করলাম আর ওর মতামত চাইলাম। সে আমার বলা ঘটনাকে সমর্থন করল বিশেষত ফাদার জোয়াকিমকে ওর কাছে এখন জীবন্ত মনে হল। আমি তার কাছে শুধু সমর্থনই চেয়েছিলাম এবং কখনো আলোচনা বা প্রচারণা করিনি। হয়তো আমাদের অভিজ্ঞতা সকলের ভাল নাও লাগতে পারে। একটুই শুধু আমরা বলতাম ফাদার জোয়াকিমকে আমাদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা উচিত।
পরিচিতি

যোষেফ হাজরা। ছদ্ম নাম তারুণ্যের কবি।
আমি আমার জীবন গঠনের সময় বহু জায়গার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলাম। শহরের হাওয়া বা মফসলের জীবন এমনকি উত্তর আর দক্ষিণাঞ্চলের জীবনধারার ছোঁয়া আমি হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছি। আমার জন্মস্থান মোংলার স্বনামধন্য সেন্ট পলস হাসপাতালে। ১লা মে জন্ম হাওয়ায় ফাদার মারিনো রিগন আমার নাম যোষেফ (আধুনিকায়নে যোসেফ) রাখে। পিতা তাপস হাজরা, মাতা এন্ড্রো রিনা নাথ।
আমি প্রথম যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “আমাদের ছোট নদী” কবিতা পড়ে তার সম্পর্কে জানি তখন থেকেই তিনি আমার অনুপ্রেরণা। এ জন্য চিত্রকলা, সংগীত, আবৃত্তি, অভিনয় ও পরবর্তীতে সেন্ট পলস স্কুলের লাইব্রেরি ও বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের অপার সুযোগে লেখালেখির হাতে খড়ি দেই। সকল শিল্প-সংস্কৃতি থেকে আমি লেখালেখি করতে বেশি ভালবাসি। কারণ মনের কথা সম্পূর্ণরূপে ব্যক্ত করে, ভাষার জাদুকারিত্বে, জ্ঞান ও দর্শনের যে সমন্বয় হয়, সেই আত্মদর্শনে সম্পূর্ণ আত্মতৃপ্ত করতে সক্ষম। আমি যদিও রবীন্দ্রনাথকে গুরুদেব মানি তবুও তার ধাঁচে আমি লিখি না। আমি কাব্য ও রচনায় অন্যান্য ঢং রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করি যাতে কেউ পড়ামাত্রই বুঝতে পারে এই লেখনীর স্রষ্টা কেবলমাত্র আমি।