কল্লোল সিং – কবিতাগুচ্ছ (নিজেকে নিজের পরিচয়, এসো খালি পায়ে হাঁটি, অবসর, প্রেম ফিরে ফিরে আসে)

নিজেকে নিজের পরিচয়

– কল্লোল সিং

বুকের মাঝখান থেকে একটা হাওয়াই জাহাজ ভেসে চলে মসৃণ স্রোতে
মগজের মাঝে এসে আবার ফিরে যায়, চলাচল রয় অবিরত,
উথাল পাথাল ঢেউয়ে নিজেকে অনুভূত হয়………..মনে হয় এই-ই আমি!
মাঝে মাঝে সে স্রোতেরও হদিস মেলাতে পারি না
নিজেকে তখন শূণ্য ফাঁকা লাগে – আমি কিছুই না – মনে হয়।
কখনও কখনও নিজেকে মনে হয় হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে চেয়ে থাকা নিথর মুখ
রাস্তায়, বাসস্টপে, বাজারে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া অচেনা হাজার জোড়া চোখ ।
দূর্ভাগ্য আমার, নিজেকে কখনোই রক্তমাংসের মাংসপিন্ডে খুঁজে পেলাম না!
প্রায়শই মনে হয় অপরিচিত অচেনা একটি মুখছবি নিয়ে ঘুরছি
এ-তো আমি নই, এ যেন কেউ একজন নাটকে অপছন্দের চরিত্র জোর করে সত্যি মুখের উপর সেঁটে দিয়েছে।
শুধু মনে হয়, অনুভবে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছি বিশাল সবুজের মাঠে, নীল দিগন্তে,
পাখীদের কলকাকলিতে, নদীর স্রোতে, পথের পাশে ফুঁটে থাকা ঘাস ফুলে, সৌন্দর্যে – শব্দে।
নিজে নিজে অনেক চেষ্টা চালিয়ে –
এ পর্যন্ত এসে আটকে রয়েছি, শুধু এটুকুই পরিচয় দিতে পেরেছি নিজেকে নিজে।

এসো খালি পায়ে হাঁটি

– কল্লোল সিং

কত অসহায় মানুষের চেহারা
কত অসহায় আমাদের চেহারা

রাস্তা দিয়ে হেঁটে দেখ, হেঁটে দেখ খালি পায়ে
দেখবে কারো মুখে সুখআনন্দহাসি নেই
গাড়ির ধোয়াগুমোটদূষণ বাতাস মানুষগুলোর মুখ – চেপে ধরে আছে
বুকের ভিতরের দূ:খ জমাট বেধে বের হতে না পেরে
বুকদমবন্ধবাতাসে কান্নায় প্রতি প্রশ্বাসে মরে।

রাস্তা দিয়ে হেটে দেখ, হেটে দেখ খালি পায়ে
আবর্জনা, বস্তির গলি, গালি মুখের বুলি
প্রতি কেজি চালের দামে মত উর্ধ্বগামী।

আর কত অসহায় হবে, আর কত অসহায় হব
দেখতে দেখতে চোখের জ্যোতি আলোহারা
পৃথিবীর বুকে রিক্সার তিন চাকার নিরব কষ্টের দাগ- কেটে চলা।

আমারা চালক আমরা যাত্রী
প্রতিবার পায়ের আবর্তে তিন চাকার চালকের যে শ্রম
তা পৃথিবীর কোন বড় টাকার নোট কিনে দিতে পারে?

কত অসহায় মানুষের চেহারা
কত অসহায় আমাদের চেহারা

অবসর

– কল্লোল সিং

এখনও জামাজুতা পায়নি অবসর
হেঁটে চলে, সকাল সন্ধ্যা নিয়মে অনিয়মে
পৃথিবীর বুকে ভালবেসে ছবি আঁকবার।

পুলকিত প্রতি মূহুর্ত
জীবনে বেঁচে থাকায়
টিকে থাকায়, আদর্শ আনন্দ।

মায়া মিথ্যার সংসার
হাসি আনন্দে ভরে যাক
নির্বাসন তোমায়
দূঃখ – কষ্ট দুশ্চিন্তার।

সময় রেখেছি তুলে
মৃত্যু নদী পারে
কবরে শুয়ে একা কাঁদবার
বেদনায় চোখ জলে ভেজাবার।

প্রেম ফিরে ফিরে আসে

– কল্লোল সিং

আকাশ ভরা জলবর্ষা হাওয়ার প্রেমে
সমুদ্রে যে সহস্র ঢেউ উঠে জেগে,
সকলে কি মিলতে পারে, কূলে এসে?
জগত কারে মনে রাখে,
যে হারায় গভীর সাগর জলে!

তবু প্রাণে আশা নিয়ে
অপেক্ষায় ক্ষুদ্র নদীতীরে।

ধীরে ধীরে
যে জীবন ঢেউ যায় মিলায়ে
অন্ধকারের গভীরে
কৃষ্ণ গহ্বরে।

নক্ষত্র আলো হয়ে ঠিকরে ঝ’রে
জোছনা আপন মনে যায় যে খেলে
ফিরে আসে তোমার কাছে প্রতিবারে
তরবারির রুপালী ঝলকানি ঢেউয়ের পরে।


কবি পরিচিতি

কল্লোল সিং। জন্ম জানুয়ারি ২২, ১৯৭৮ সাল। পিতা স্বর্গীয় মাইকেল সিং, মাতা কুমকুম সিং। স্থায়ী বাসস্থান – এনিও পাড়া, শেলাবুনিয়া, মোংলা, বাগেরহাট। ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত, দুই সন্তানের জনক। পড়াশুনা এম বি এ (ফিন্যান্স) এবং পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা ইন সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট। বর্তমানে কক্সবাজারে একটি আন্তর্জাতিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত।

মোংলার উপজেলার শেলাবুনিয়া এলাকার স্নেহের নোনা হাওয়া, জোয়ার ভাটার নদী জলে, আলো বাতাসে, সবুজের ছোয়ায় বেড়ে উঠেছেন। শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের বেশিরভাগ সোনালি সময় (১৯৮৫-২০০২) সেন্ট পলস হাই স্কুলে, শেলাবুনিয়া ও কাইনমারি এবং মোংলার অববাহিকায় আতিবাহিত করেছেন।

জীবনের উপলব্ধি সাদাকালো চেহারায় প্রকাশের আনন্দ অনেকের কাছে কবিতা মনে নাও হতে পারে – কিন্তু তার কাছে এই প্রকাশের আনন্দ অপরিসীম অনবদ্যতা নিয়েই উপস্থিত হয়েছে। নিজেকে কখনও কবি না ভাবলেও বা কবি হিসাবে পরিচয় দিতে কুন্ঠাবোধ থাকলেও তার লেখায় এক বিশেষ কাব্যিকতা ফুটে উঠেছে। এই সব ভাবনা ও লেখার সামান্য কিছুও যদি কারো ভলো লাগে তবে মতামত জানানোর অনুরোধ রইল – তিনি আপ্লুত হবেন। এছাড়া সবার কাছে আশীর্বাদ প্রার্থী তিনি।