কখন ভোর হবে
– সুমিত্র দত্ত রায়
প্রেক্ষাপটে ভাঙাচোরা গ্রাম্য এক রঙ্গমঞ্চ,
রাত এগারোটা থেকেই যাত্রা শুরু হয়ে গেছে,
কুয়াশায় ভরা মাঠে,চটে বসা, ছাঁউনি ছাড়া দর্শক,
নাটকটা শেষ হতে হয়তোবা রাতই ফুরিয়ে যাবে।
এখন শুধু নেশা দুচোখ জুড়ে ,শুধুই নেশা,
চলুক যাত্রাপালা আপন গতিতে নিজের মতন,
ওরা কেউ চায় না অন্তিমের অশুভ আগমন,
এসব নিয়ে ফালতু চিন্তার দরকারই বা কি?
“দেখ,দেখ,যেমন কথা, তেমনি ড্রেস!
আহা! শেফালী যেন।
হেব্বী চলছে মাইরি, কি নাচ? কি বলিস!”
রগরগে কথা,সিটি, কোমড় দুলুনি-বেশ জমজমাট।
শুধু সেই ছোট্ট ছেলেটা আধো আধো বুলি যার মুখে,
হয়ত বা ঘুম ভেঙে সবে উঠে পড়েছে
কর্কশ আওয়াজ শুনে কানে,
সেই শুধু বলে, “মা, কখন ভোর হবে?”
অচ্ছেদ বন্ধন
– সুমিত্র দত্ত রায়
একমুঠো আকাশ দিয়েছিলাম
যখন অন্ধকার মূলে;
এক সাগর ঢেউ তুলে দিলাম
যখন আন্দোলন ছুঁলে।
এক ঝোড়ো বাতাস দিয়েছিলাম
যখন পল্লবিত ছিলে,
একবুক ভালবাসাও দিলাম
চেয়েছিলে যেটা তালমিলে।
একমন বোঝা রেখেও দিলাম
প্রদীপের সাঁঝবাতি জ্বেলে,
ঝলকানো আগুন বেছে নিলাম
যাবে বলে ছেঁড়া বাস ফেলে।
শেষের প্রহর না কি প্রহরের শেষ
– সুমিত্র দত্ত রায়
খেলাঘর আজ কোথায় হারিয়ে গেছে!
এখন শুধুই ঘর থেকে ঘরে খেলা,
গাছের মাথায় ক্লান্ত কোকিল বসে
তবু নীরবতা কাটেনি, এ কালবেলা।
বসন্ত আজ দূরে বহুদূরে আছে
বৃথাই খুঁজি, পাই না তো কোনোখানে,
তোমরা যারা রয়েছো সীমানা জুড়ে
না বলা মনের বেদনারে আন মনে।
মনের কথা বোঝার মানুষ কই?
নিলামঘরে তারও দাম বেড়ে গেছে,
আমি একা তাই শূন্যতারই মাঝে
দামী কেনবার কী বা ক্ষমতা আছে!
চারপাশে শুধু ঘর আর ঘরে খেলা,
এ যে শূন্য মাঝেই মহাশূন্যের ছল,
খেলাঘরে তালা! গুটিয়ে আপন ঝোলা
নট নাট্টের বিশাল জগতে চল।
কবিতাকে
– সুমিত্র দত্ত রায়
একদিন মেদহীন টানটান
দেহ চেয়েছিলাম,
পেয়েছিলাম।
তখন বাতাসে বারুদের গন্ধ –
তোমার সুবাস নেবার অবকাশ কই?
পলকে পলকে তোমাকে দেখার
তৃষ্ণা দুচোখ ভরে,
ভাবিনি কোনও দিন
তোমার দেহবল্লরিকে
অলংকার দিয়ে সাজানোয় যায়।
কিন্তু তবুও এক মাহেন্দ্রক্ষণে
অলংকার দিয়ে সাজিয়েছিলাম।
সে এক নতুন তুমি!
কি ভীষণ মোহময়ী রূপ সে তোমার,
এরপর শুরু হলো –
সাজানোর নিরন্তর প্রয়াস,
তোমার কমনীয়তা বন্দী হলো
আঁচড়ে আঁচড়ে।
আবার নিরাভরণ হলে
এবার কিন্তু স্বেচ্ছায়, স্বতঃস্ফূর্ততায়,
নিরলঙ্কার তুমিও যে কত সুন্দর
বুঝি নি তা আগে,,
মেদহীন টানটান দেহ
আর চাই না,
কত অলংকারে অলংকৃত তুমি
বুঝেছি যখন,
কী বা প্রয়োজন আর বৃথা অলংকারে।
মনের গভীরে
– সুমিত্র দত্ত রায়
রজনীগন্ধা গন্ধে মাতোয়ারা
সে সন্ধ্যা আজও মনে পড়ে
মনে পড়ে-প্রজাপতি রং বাহার
সেই শঙ্খ ধ্বনি, সেই বাসরঘর।
তবু মনে পড়ে, সেই সকালটাও –
তুমি শুয়ে আছ তুমি ছাড়া,
ধূপের ধোঁয়া ক্লান্তি আনছে না,
সবাই বললো, ষ্ট্রোক হয়েছিল।
ভেবেছিলাম – দুনিয়া বদলে গেল,
ভেবেছিলাম – লাভ কি আর বেঁচে?
ভেবেছিলাম – বোধহয় পাগল হয়ে যাব!
শুধুই ভেবেছিলাম, কিছুই হলো না আমার।
সময় প্রকৃতপক্ষে দারুন ইরেজার।
পাশাপাশি শোকও এখন শ্রান্ত,
পৃথিবীর বুকে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা
সামলানোর দায়ে সে অভিযুক্ত।
আমি কিন্তু বেঁচে রইলাম বহাল তবিয়তে।
তোমার ছেলের ঘরে এলো বউ –
আবার এক সাজানো বাগান।
আবার স্বপ্ন দুচোখ ভরে, শুধু তুমি নেই।
মাঝে মাঝে খোলা ছাদে যাই।
তখন কিন্তু আমি কেবলই আমার,
চাঁদনী রাত হাতছানি দেয়
ও কি নিতে পারে আমায় তোমার কাছেতে।
আজ অমাবস্যা, ঘোর অন্ধকার –
তারা কিন্তু মিটিমিটি হাসে,
এখন আমিও দিন গুনি দিন ফুরোবার
আমার ঝাপসা নজরে শুধু একই প্রশ্ন ….
একবার কানেকানে বলো না আমায়
খোকার আসার কথা যেমন বলেছিলে,
কোন তিথিটারে মনে ধরি আজ –
মধুর সে রাত না ব্যাথার সকাল?
কবি পরিচিতি

সুমিত্র দত্ত রায় কবির ছদ্মনাম। প্রকৃত নাম সংকেত চট্টোপাধ্যায়।
আমি ছেলেবেলা থেকে ভাগীরথী কূলে বড় হয়েছি। আমার একাধিক লেখার প্রেরণায় গঙ্গার ভুমিকা অনেক। ওখানেই দেখেছি সূর্যাস্ত বা তৎকালীন মেঘরঞ্জনী। আদি বাড়ির কথা দিদির চোখে দেখা। বরিশালের শোলক গ্রামেই পিতৃভূমি ও বাটাজোরে মাতুলালয় ছিল। পিতা ঈশ্বর যোগেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মাতা ঈশ্বর বিজনবালা দেবী। পারিবারিক জীবনে স্ত্রী রুমা চট্টোপাধ্যায় আর এক কন্যা সপ্তদ্বীপা চট্টোপাধ্যায়। ভাই নেই। দুই দিদি, গীতা মুখার্জী আর অঞ্জনা মুখার্জি। পিতা যোগেশচন্দ্র ছিলেন দেশপ্রেমিক। বরিশাল হতে বন্দী হয়ে দমদম সেন্ট্রাল জেলে বদলি হন। তাঁদের রক্তে কিছুটা দুঃসাহসী আমিও ছিলাম। কিন্তু কবিতার জগত আমার নিজস্ব মনে হত সেই দশবছর বয়সেই। আবৃত্তি, গান, ছবি আঁকা আমার খুবই পছন্দসই ছিলো। চাকুরিজীবী ছিলাম। এলাহাবাদ ব্যাংকে আধিকারিক। বদলির চাকরি। তাই ২০১২ সালে স্বেচ্ছায় অবসরের পর বাংলা কবিতা ডটকমে লেখা শুরু, আমার কন্যাপ্রতিম সোমালীর হাত ধরে। আর পিছু ফিরে তাকাই নি, এখন ওটাই ধ্যান জ্ঞান।