যোষেফ হাজরা – স্বাধীনতার সাতকাহন

স্বাধীনতার সাতকাহন

– যোষেফ হাজরা

আদিতে সবুজ ছিল
“জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী”
গরীয়সী মহিমাময় বিশ্বভূমান্তলে সর্বজয়তু সর্বজয়া
পূর্বে উদিত ভানু চরাচরে বিছরিয়া পড়ে ঐশমায়া
অস্তাচলে যায় রবি, শশী ওঠে আঁধার ভেদী মুক্ত প্রকাশ
পঙ্কে ফুটিত পঙ্কজিনী দুলিত উচ্ছ্বলিত বায়ে
সোনালি শষ্যে অন্নপূর্ণা হাসিয়া খেলিয়া দুলিত রাধিকা বেশে
কৃষ্ণগাভী তড়িৎ চলিত উসরিত ধরণীতল, অমৃত জনে জনে
উত্তরে গিরিশৃঙ্গ ক্রেওকাডং আসমান-ভূমের মিলন চুম্বন
দক্ষিণে সমুদ্র-সুন্দরবন অতন্দ্রপ্রহরী গ্রীণ-হাউজ সংকটে

ওই কারা আসে
আসে আর্য-অনার্য, দ্রাবিড়-মঙ্গলীয়, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য
আমার মাটিতে মিশে আসে বহু রক্ত, সভ্যতার সংকর
কখনো যখন আলিঙ্গন করেছি বিশ্ব ভ্রাতৃত্বে
আমি জানি তুমি জানো কখনো এই রকম থাকে না
তবুও মাথা নিচু করে সহে নিতে হয় আমি বৌদ্ধ, আমি খ্রিস্টান
সাত পুরুষের দেশে আছি ভাই আমিতো আলাদা নই
জন্মের পরিচয়ে আমি বিধবাকে লক্ষ্মীরূপে বরণ করেছি
মা মা-ই হয়, সখিনা বিবি আমার মা, আমার মা হরিদাসী
একদেশ আমার মাতৃশ্রেষ্ঠ যুগে-যুগান্তে পুরুষোত্তমের

আমার ভাষা যারা কেড়ে নিতে চায়
তারা সূঁচ হয়ে ঢুকেছিল এখন পুরো দেশটাকে গিলে খাবে
আমার জন্মভূমি বীরসন্তান প্রসব করতে জানে
আমরা কাতারে কাতারে দাঁড়িয়ে গেলে বুলেটও শেষ হয়ে যাবে
আমরা দাঁড়িয়ে থাকিনি, আমাদের ছাত্র-শ্রমিকের বুকে তাজা রক্ত, রণ সাজে সজ্জিত বঙ্গকন্যা
ওই রাজাকার, আলবদর, আলসামস্ প্রতিহত করে
পুণ্য রক্ত যত ঝরে বাংলার ততগুণ বেড়ে ওঠে সাহসী সৈনিক
আমরা মায়ের ভাষার কথা বলব
আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, মাটি ও মানুষ কেড়ে নিতে দেইনি, দেব না

পুড়ছে মানচিত্র, শবের মিছিলে ছেয়েছে রাজপথ-নদী-বধ্যভূমি
আর কত প্রাণ নিলে বল স্বাধীনতা পাওয়া যায়
আর কত আগুন জ্বালালে বল স্বাধীনতা পাওয়া যায়
কত বলাৎকারের পর বল স্বাধীনতা পাওয়া যায়
কত শিশুর মাথা আঁছড়ে আঁছড়ে ভাঙলে বল স্বাধীনতা পাওয়া যায়
কত সাম্প্রদায়িকতা শেষে বল স্বাধীনতা পাওয়া যায়
কত সন্ত্রাসবাদ অত্যাচারের পর বল স্বাধীনতা পাওয়া যায়
কত সাম্রাজ্যবাদী শোষণের পরে বল স্বাধীনতা পাওয়া যায়
কত মানবতার মৃত্যু হলে বল স্বাধীনতা পাওয়া যায়
আর কত গণহত্যা ও গণধর্ষণের পরে বল স্বাধীনতা পাওয়া যায়

শোন, শোন ওই যে বাংলার সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
যেদিন ডাক দিল, গর্জে উঠল আকাশ, ধরণী ফেটে ওঠে আগ্নেয়গিরি
বাংলার মানুষ এক হও, এক হও
এক হও হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ, কৃষক-কুলি-ছাত্র-আমজনতা
যুদ্ধ হবে কৃষকের লাঙল দিয়ে, মাঝির বৈঠা আর কবির কলম দিয়ে
গণজোয়ারে ঘর থেকে মানুষ, সতী-লক্ষ্মী, কিশোরে ছেয়ে গেল রাজপথ
যুদ্ধ হবে যুদ্ধ, অত্যাচারী পাকিস্তানির বিনাশে মরণপণ লড়াই
“রক্ত যখন দিয়েছি, প্রাণ যখন দিয়েছি, সম্ভ্রম যখন দিয়েছি
এদেশের মাটি শত্রুমুক্ত করে ছাড়ব। ইনশাল্লাহ।
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম
জয় বাংলা।”

বীর বাঙালি হাতে অস্ত্র, স্টেনগান, রাইফেল
একের পর এক জ্বালিয়ে দিচ্ছে পাকিস্তানের ঘাটি
অকুতোভয় বুকে শ্বাপদসংকুল নদী সাঁতরে করে পার
দিনের পর দিন আধপেটা শুকনো চিড়ে মুখে
প্রখর সূর্যতাপে হেঁটে চলে যাচ্ছে মাইলের পর মাইল চৌষট্টি হাজার গ্রাম
সেদিনের রফিক, মতিউর, প্রীতিলতা সেন
অমর অজয় কাব্য লিখে গেল সাত কোটি বাঙালির
পাক-সেনার মাথায় বুলেট গুজে দিচ্ছে
এক একটি করে পাড়া-মহল্লা-গ্রাম শত্রু মুক্ত হচ্ছে আমার দেশের
ওই যে একাত্তর বিজয় আসে মৃত্যু-ধর্ষণ লঙ্ঘি বিজয় আসে
জয় বাংলা চির অমর থাকুক সৌহার্দ্য প্রেম শান্তিতে

শ্যামলে কোমলে দিয়েছ স্থান পুণ্য ভুমি বঙ্গে
কত মায়া নিবিড় ছায়া প্রেম মাখিয়েছ অঙ্গে
আমারে দিয়েছে অন্নদায়ী মা পিতার আশ্রয়
বোনের পরমযত্ন স্নেহ বন্ধু স্বজন সুহৃদয়
আমারে দিয়েছ গৌরব মাগো, দিয়েছ মুক্ত বায়ু
শক্তি দিয়েছে, সাহস দিয়েছ, দিয়েছ পরম আয়ু
মাথায় করে রেখেছ মাগো, তোমারে রাখি শিরে
তোমাতেই যেন মরি মাগো, আসতে যদি হয় ফিরে
আবার এলে তোমার চরণে শাপলা ফুলে রবো
নিশীথ-রাতে আঁধার যদি আসে, সৌরভ ছড়াবো


কবি পরিচিতি

যোষেফ হাজরা। ছদ্ম নাম তারুণ্যের কবি। বর্তমান নিবাস – বঙ্গবন্ধুপাড়া, শেলাবুনিয়া, মোংলা, বাগেরহাট।

আমি আমার জীবন গঠনের সময় বহু জায়গার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলাম। শহরের হাওয়া বা মফসলের জীবন এমনকি উত্তর আর দক্ষিণাঞ্চলের জীবনধারার ছোঁয়া আমি হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছি। আমার জন্মস্থান মোংলার স্বনামধন্য সেন্ট পলস হাসপাতালে। ১লা মে জন্ম হাওয়ায় ফাদার মারিনো রিগন আমার নাম যোষেফ (আধুনিকায়নে যোসেফ) রাখে। পিতা তাপস হাজরা, মাতা এন্ড্রো রিনা নাথ।

আমি প্রথম যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “আমাদের ছোট নদী” কবিতা পড়ে তার সম্পর্কে জানি তখন থেকেই তিনি আমার অনুপ্রেরণা। এ জন্য চিত্রকলা, সংগীত, আবৃত্তি, অভিনয় ও পরবর্তীতে সেন্ট পলস স্কুলের লাইব্রেরি ও বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের অপার সুযোগে লেখালেখির হাতে খড়ি দেই। সকল শিল্প-সংস্কৃতি থেকে আমি লেখালেখি করতে বেশি ভালবাসি। কারণ মনের কথা সম্পূর্ণরূপে ব্যক্ত করে, ভাষার জাদুকারিত্বে, জ্ঞান ও দর্শনের যে সমন্বয় হয়, সেই আত্মদর্শনে সম্পূর্ণ আত্মতৃপ্ত করতে সক্ষম। আমি যদিও রবীন্দ্রনাথকে গুরুদেব মানি তবুও তার ধাঁচে আমি লিখি না। আমি কাব্য ও রচনায় অন্যান্য ঢং রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করি যাতে কেউ পড়ামাত্রই বুঝতে পারে এই লেখনীর স্রষ্টা কেবলমাত্র আমি।