শুক্লা বোস – কবিতাগুচ্ছ (নারীর কাব্য, গানের আসর, শীত কাহন ও মিলন)

নারীর কাব্য

– শুক্লা বোস

কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি-
রান্না ঘরেতে কাজ পড়ে আছে মেলা,
খোকার বাবার এখনো হয়নি খাওয়া-
এঁটো বাসনেরা বেসিনেতে হাসে
করে শুধু খুনসুটি…

কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি-
কাপড়ের রাশি বাথরুমে আছে পড়ে
কুটনো বাটনা এখনো অনেক বাকি,
খোকার গোসল, খুকির আদর
এখনো হয়নি সারা,
উনুনেতে ডাল আধেক উঠিছে ফুটি–

কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি-
ক্ষুধার উদর চায় না শুনতে পদ্য
মহা সমারোহে খাদ্যদ্রব্য গেলে,
খোকার বাবার রক্ত চক্ষু
পিছে পিছে সদা ঘোর,
আকাশে হঠাৎ মেঘমালা জমে
হানিতেছে ভ্রূকুটি–

কবিতা তোমায় আজকে দিলাম ছুটি!
কাজ সেরে ফেলি আগে
তখন না হয় হাওয়ার পাখায় এসো!
ভাবনা বিহীন পারে উড়ে গিয়ে
আমারেই ভালোবেসো!

গানের আসর

– শুক্লা বোস

খুল্লতাত গান ধরেছে – ভরাট গলার স্বর,
ভৈরবীতে ভজনখানা, অতি চমৎকার!
“ভবভয় নিবারণ” সুরটি যে তার জানা,
ভাইপো বগল বাজায় তবল – “তাক-তা-ধিনা-না-না।”
খুড়শ্বশুর আর খুড়শাশুড়ি বসলো এসে পাশে,
ভাইঝি শশী বেজায় খুশি – বসলো কাছে ঘেঁষে।
খুঁতখুঁতে এক খুড়তো পিসি – খুটুর-মুটুর স্বভাব,
খুশখুশে কাশ, ঘুষঘুষে জ্বর – নেইকো জ্বরের অভাব।
ত্রিকাল ঝরে এক কাল তার – বয়স ষাটের বেশি,
ভক্তিভরে ভক্তিমূলক ভজন শোনে বসি।
চড়লো গলা উঠল বেলা – খুড়োর গানের সুর,
দিক-বিদিকে ছড়িয়ে গেল – আহা! কী মধুর!
রসময়ের রসভরা গান – ভজন পূজন সার,
গানের তানের সুরের ধারা করছে ভব পার।
এমন সময় হুলো এলো, মেনি যে তার কাছে,
আরেক হুলো হুশহুশিয়ে ঢুকলো পাছে পাছে।
দুইটি হুলোর হুল্লোড়ে আর “মেয়াও-ওঁয়াও” সুরে,
খুড়োর ভজন তলিয়ে গেল ওদের গলার স্বরে।
হুটপাটি, হুড়া-হুড়ি, হুলু-স্থুল কারবার,
তবলা ছেড়ে পালায় বগল – ভাইঝি পগার পার!
খুড়শ্বশুর আর খুড়শাশুড়ি চেঁচিয়ে উঠে ছোটে,
ভনভনিয়ে ঘুরে বেড়ায় – লাঠি কোথায় জোটে।
হিক্কা তোলে খুড়তো পিসি – হাপুস নয়ন তার,
অশ্রু-নীরে সিক্ত হয়ে গেল ঘরের বার।
খুসকি মাথা-খুল্লতাত – চুলকে মাথা তার,
ভাবাবেগে ভাবছে বসে – এ কী রে কারবার?

শীত-কাহন

– শুক্লা বোস

শীতের বুড়ি থুত্থুড়ি সে গুটি গুটি পায়ে,
আসছে যেন – পড়লো এসে শহর এবং গায়ে।
শিশিরধোয়া পিছল পথে পিছলে যেন পা,
ভাঙলো বুঝি পা খানি তার – শিশির মাখা গা।
বসলো জেঁকে – কুয়াশা তার গায়ের চাদর খানি,
ফাগুন বাতাস গায়ে মেখে বিদায় তবে জানি।
খোলো-খোলো, খোলো এবার লেপ-তোষকের ভাঁজ,
শীতহারিণী-তাপধারিনীর নরম গরম সাজ।
খেজুরবীথির দীঘল তনু – রসে ভরা প্রাণ,
কোন সে নিঠুর চাঁচলো তারে পেতে রসের ঘ্রাণ।
ভ্রমণরত ভ্যানভ্যানানি মক্ষিকার ওই ঝাঁক,
খেজুর রসের গন্ধ-মাতাল – ছুটলো ঝাঁকে ঝাঁক।
বন-পুকুরের মন-মুকুরে অতল কালো জল,
শিশিরমাখা পাঁপড়িগুলি মেলছে শতদল।
সাইবেরিয়ার তুষার ছেড়ে লক্ষ-কোটি পাখি,
হাওয়ার পাখায় আসছে উড়ে করছে ডাকাডাকি।
বিলে-ঝিলে-সরোবরে ওদের কলধ্বনি,
ডুব সাঁতারে করছে খেলা – জুড়ায় নয়নখানি।
হিমেল হাওয়ার পরশ পেয়ে সবুজ পাতার রাশি,
হলুদ বরণ রঙটি মেখে পড়ছে খসি খসি।
ঝরা-পাতা নেড়া মাথা তরু-বীথি সব–
হাঁকড়ে গলা গান গেয়ে যায় – বসন্তবিলাপ।
পঁচাত্তুরী বুড়ো-বুড়ি থরথরিয়ে কাঁপে,
গরম পিঠের স্বাদ নিতে চায় – তাতরসের-ই ভাপে।
ঠক-ঠকিয়ে লাঠি হাতে নরম রোদের আঁচে,
তাতিয়ে নিতে বুড়ো শরীর – বসে রোদের মাঝে।
কিষাণ বধূর বাড়লো যে কাজ খেজুর রসের জ্বালে,
নলেন গুড়ের বাজার চড়া – ভরবে কলস ঠিলে।
রেশমি শাড়ি পশমী পোশাক কদর বেশি পায়,
হালকা চালের লিলেন কাপড় উধাও হয়ে যায়।
আদুল গায়ের দুঃখী ছেলের শীতের পোশাক কই?
শীত ঠেকাতে কুড়ায় পাতা – আগুন পোয়ায় ওই।

মিলন

– শুক্লা বোস

বালি বলে, “ওহে সিমেন্ট ভাই —
এসো মোরা একসাথে আজ মিলে মিশে যাই।”
সিমেন্ট বলে, “বোকার কথা শোনো!
তুমি আমি মিলবো কেন?
তোমার শক্তি নাই তো কোন!
দেখ আমি বিষম ভারী ওজন আমার কত —
তুমি তো ভাই হালকা পলকা
নয়কো মনের মতো।
নদীর চড়ায় পড়ে থাক, জীবন তোমার খালি,
মানুষকে যে ডুবিয়ে মারো–
তুমি চোরা বালি।
আমি থাকি খনির মাঝে, তুমি নদীর চরে,
তোমার আমার মিলনে কি মনটা কভু ভরে?”

বালি বলে, “গর্ব তোমার অনেক আছে জানি,
ওজনেতে ভারী তুমি তাও তো মনে মানি।
কিন্তু আজকে ভেবে দেখ আমার কাছে হারো,
আমায় ছাড়া মজবুত ভিত গড়তে কি আর পারো?
তুমি-আমি দুজন মিলে বানাই যে কংক্রিট,
তার-ই উপর গড়ে ওঠে সভ্যতার ওই ভিত।”


কবি পরিচিতি

শুক্লা বোস। মোংলা অঞ্চলের জ্ঞানের প্রধান বিদ্যাপীঠ শেলাবুনিয়ায় অবস্থিত সেন্ট পলস্ উচ্চ বিদ্যালয়-এর স্বার্থক ও কৃতি শিক্ষিকা। সুদীর্ঘকাল শিক্ষকতার পর শিক্ষার্থীদের প্রাণপ্রিয় এই শিক্ষিকা মার্চ ৪, ২০২০সাল থেকে অবসরে আছেন।

ছেলেবেলার থেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, জীবনানন্দ দাশ সহ বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য প্রথিতযশা কবি ও সাহিত্যিকদের লেখার সান্নিধ্যে বেড়ে উঠেছেন। কখনও কখনও লিখেছেন আত্মার সন্তুষ্টির জন্য। আত্মপ্রচারে বিমুখ হওয়ায় নিজের ভিতরেই রেখেছেন নিজেকে – তেমনভাবে বাইরে প্রকাশিত হয়ে ওঠা হয়নি।

বর্তমানে অবসর জীবনের একঘেঁয়েমি কাটিয়ে জীবনযাত্রায় কিছুটা ভিন্নতা ও বৈচিত্রের ভিতর দিয়ে সময় কাটানোর জন্যই বেছে নিয়েছেন বই পড়া ও লেখালেখিকে। সাহিত্যের মাধ্যমে মানুষের আত্মশুদ্ধি হোক, মানুষ সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠুক – এই প্রত্যাশাই তার ভাবনায় জীবন জুড়ে বিকশিত।