ম. ম. রবি ডাকুয়া – কবিতাগুচ্ছ (জীবন ঘোলা জল, একাকীত্বের অপারগতা, কবি তুমি)

জীবন ঘোলা জল

– ম. ম. রবি ডাকুয়া

ধুলো মাখা কবিতার পাতাই সম্বল,
জীবন মানে বেঁচে থাকা নামের জঞ্জাল।
আকাশের নীল দিয়ে অহেতুক প্রেয়সীর আঁচলে রং করা,
ঝরা গোলাপের পাপড়িতে বুকের দোপাট্টায়,
বকুলের মালা জড়ানো খোপাটায় জং ধরা।
ইচ্ছে হলে বৃষ্টিরা নেচে যায়,
দুঃখগুলো হাটে হাটে বেচে যায়।
কাছে আসার উৎসব মেলায়,
মনে হয় ফিরে যাবার বেলায়।
বেঁচে থাকাই উৎসব আসল,
বেঁচে আছি বুঝতে পারি দেখে চার পাশে কোলাহল,
ধুলো মাখা জীবন ধুয়ে করি জীবনকে ঘোলা জল।
তবুও জীবন আছে জানিতো জীবন্ত,
কখনো ঘুমন্ত – জাগ্রত, কখনো প্রাণবন্ত,
জীবনের কাছে জীবিকা নামের চাহিদা অফুরন্ত।
জানিনা বুকের ভেতর
আজ রৌদ্র কে তোর।
আমিও আজ বর্ষায় ভিজে যাই,
দুঃখ না এলে তার কাছে নিজে যাই।

একাকীত্বের অপারগতা

– ম. ম. রবি ডাকুয়া

নিস্তব্ধতাও যেখানে পা রাখে
দেয়ালের চোখ খেয়াল ভোলেনা,
হাত তালির ভাষা এক,
খালি হাত কেবল ভিক্ষার,
হাসির অনুবাদ একই, অপারগতা নির্বিবাদ।
কি হবে বলো ভালবাসার ছল করে,
মল পরে।
বিবর্ণ পৃথিবী আজ যা হাসায়,
তার চেয়ে আগামী কাল অধিক জলে ভাসায়।
কত মানুষের সারি কেবল পাপের বেতন বাড়ায়,
পরিশুদ্ধ মন ময়লা কাদায় জড়ায়।
ভালবাসা কাঠের ফ্রেমে বাঁধা যায় না
মনের আয়নাতে দেখে নিতে হয়,
রাতের সংঘবদ্ধ নীরবতাও একা হয়,
একাকীত্বের সাথে তার দেখা হয়।
করুণ রক্তজবার মত ভেতরে
রক্তাক্ত করে কে তোরে।
সত্যি তুমি পারো,
আরো, একরত্তি অপারগতা সঙ্গী আমার।
ভবপারে কত মাঝি ভেড়ে বারে বারে,
তাই আমার পাড়ি দেয়ানা
তুমি মাঝি খুব সেয়ানা।
তবু একাকীত্বের কৃতিত্বের অপারগতার,
ছাপ রেখে কি হবে অযোগ্যতার।

কবি তুমি​

– ম. ম. রবি ডাকুয়া

সমস্বরে আয়োজিত মাঠে সব কিচির মিচির
কোকিলের ডাক নয়।
শত প্রবৃত্তি বয়ে চলা প্রমত্তা,
অার অব্যক্ততা উল্লাস করতে কবি আসেনি।
আয়োজিত আসরে কবিতার কথা যদি সত্যি হয়,
সমাজের সুখের ছবি এক রত্তি হয়।
মাটি পুড়ে থাকা চৈত্রের দাবদাহে
চৌচির রৌদ্র খরা,
বৌঝির মন আনকরা।
যৌবন ভ্রমে প্রেমের ওমে দেখবে
তোমরা এক ভুল মানুষকে দেখতে এসেছো,
ভুল করে।
কেউ এসেছো স্বামীর নিষেধ মানা ভেঙ্গে,
কেউ এসেছো জানা অজানা না মেনে,
কেউ বা এসেছো মাঠ থেকে গরু গোয়ালে
ঘাটে তরী বেঁধে।
কেউ এসেছো শূন্য পেটে উনুনে রেঁধে।
বুক পকেটে পয়সা শূন্য,
কারো ভ্যানিটি ব্যাগ পোরা চক চকে নোটে,
কেউ এসেছো রং মেখে ঠোটে।
সুপেয় জলে নামেনা পানকৌড়ি দলে দলে,
তবু তুমি আমি না দেখেলেও চলে।
হাড় গোড়ের মত রেখায় কাগজে
মাংস পেশী দেয়া কবির কাজ,
লবনাক্ত জলে কবি সনাক্ত করার সময় এসেছে।
বুকে পেটের ভাজে রূপের প্লেটে
কবির চটক বিজ্ঞাপন দিতে আসিনি।
বৃদ্ধাঙ্গুলি তর্জনী কেটে নাও,
হাত পা বেঁধে জলে ফেলে দাও
অপরাধীর মত অবারিত
কবিতায় যদি ঠোঁট নেড়ে ওঠে।
জনতার রোষানলে দমকা হাওয়ায় এলেমেলো
কেশে ওই এল কবি বেশে,
যার ভেতরে রক্ত ক্ষরণ সেই তো কবি।
সেফটিকে ভরা মলম পরশ বুলায় কলম,
মেঘ যখন মাটিতে নেমে আসে
তখন সে আর বৃষ্টি থাকেনা।
নিরক্ষর অন্ধের কোন দৃষ্টি থাকেনা,
কবিতার শুকনো ক্ষেতের আলে
তবু ডেকে যায় শেয়ালে।
কবির গভীর টগবগে রক্তের কবিতা কি
শেকলে বাঁধা যায়?
বিক্ষিপ্ত কবির নিক্ষিপ্ত কবিতায়
আঘাত পায়।
যুগ যুগ কবিকে শিকল পরানো হয়,
কিছু খবর নিপাত যাক,
তবু কবিতা মুক্তি পাক।
কবি তোমার কবিতায় যত ধৃষ্টতা
পাঠকের মাঝে তার চেয়ে স্পষ্ট নিকৃষ্টতা।
অগ্নি যাহার বাক্য ব্যয়ে,
মাটিতে ভাজ টেনে কাগজে,
কবিতা লেখে বৃষ্টি।
অনাবিল কাহিনী কবির কলমে অঙ্কিত,
কবির ভয়ে কেন এত গভীর শংকিত?
অশান্ত এক ব্যথার রোদন বুকে কবির,
একটু একটু করে ক্ষত ছড়ায় যত গভীর।
কবি সারাদিন কবিতার মাঠে খাটে,
তবু কবির সম্বোধন কেড়ে নিতে চায়।
আগ্নেয়গিরির প্রলয় পাঠে
বন পুড়ে ছারখার,
প্রেমে পুড়ে প্রেমিক মন যার যার।
কবি কখনো ব্যতিব্যস্ত,
ব্যাধিগ্রস্থ পরজীবী নয় তত প্রশস্ত।
কবির কবিতা থেকে মাংস চামড়া ছড়িয়ে নিলে
রক্ত ঝরবে না
কবির কবিতার কভু দর পড়বে না।
কবির সৃষ্টি কোন ধৃষ্টতা নয়
পথ ভ্রষ্টতা নয়।
কবি তুমি বন্ধুদের জন্যে কবিতা সাজাও,
মনুষ্যত্বের বন্ধুত্বের জন্যে কবিতা সাজাও।
দেখ ভুখা পেটে পথ চেয়ে আছে
কোটি কোটি উৎসুক চোখ।
মায়ের বুকে সন্তান হারা শোক।
বুকের দুধ শুকিয়ে ছটফট কেমন কাতরায়,
কবি তুমি মনুষ্যত্বের জন্যে কবিতা সাজাও,
শুধু রাজনীতির মঞ্চে নয় সে,
সঞ্চয় করো কিছু মনুষ্যত্ব।
তোমার পথ চেয়ে বসে আছে
দেখ কত আশাহত।
ভাগ্য বিলাও তোমার হাতে
যারা তোমায় ভাগ্য দিয়েছে সমনদের,
তছনছ হবার ভয়ে কবি তুমি
চেনা পথ ধরে চলে এসো
দুঃখী মানুষের ঘরে।
শেষ নিঃশ্বাসের আগে তোমাদের
আটকে রাখা বিশ্বাসের মুক্তি দিয়ে দাও,
ভুল মানুষের হাত থেকে কলম কেড়ে নাও।
আমি প্রায়শই পকেটে গুণে রাখা
টাকার নোটের সংখ্যা ভুলে যাই,
জনতা ঠোঁটের মত যা কিছু বলে যাই।
বোবার নাকি শত্রু নেই,
কবির আঙ্গুলে ঠোঁটে শত্রুতা বেড়ে ওঠে।
দুটি রুটির কবিতা দীর্ঘজীবী হোক,
ক্ষুধার কবিতা নিপাত যাক।
দারুণ প্রবল কেবল কবিতার রোল মিষ্টি নয়,
তবু দিকে দিকে দারিদ্রতার সৃষ্টি হয়।
খরিদ করা অভাব পানে তবু সমাজের দৃষ্টি রয়।
অনধিক আঠারোর নিচে
আমার কবিতা শোনা নিষিদ্ধ হোক,
রক্ত প্রবাহে চাপ বেড়ে যায়,
সিগারেটের প্রতিটি টানে যেমন।
পকেটমারের মত না লিখতে পেরেও বই বেঁচতে এসো না,
তার চেয়ে ঝুনঝুনা বেঁচুন,
কাগজের ফুল কিংবা বেলুন।
বাজার জমবে,
সিপাহী এবার কলমে কামান দাগো,
কবির জন্যে তিন আঙ্গুলের
এক চিমটি কলম যথেষ্ট,
বুকের চিমনি দিয়ে নিঃসৃত ধোঁয়াই
যথেষ্ট কবিতা।
তোমাদের এই কোলাহলের কাছে বেঁচে দেখো,
আমার মনের নিঝুম অরণ্য।
কবির হাত গভীর কবিতা লেখার হাত,
চোখ কবিতার স্বপ্ন দেখার,
ঠোঁটেও কবিতার ফুল ফোটে।
শৈশবে শিশু খেলার সাথী,
কিশোর বয়সে কিশোরী,
যৌবনে যুবতী,
বৃদ্ধ বয়সে বৃদ্ধা সহযাত্রী
এসব জোয়ার যদি বিপরীত হয়,
তবে সব ভেসে যায়,
মিশে যায় সব কেবল শূন্যতায়।


কবি পরিচিতি

ম. ম. রবি ডাকুয়া। জন্ম ১৯৮৬ সালে বাগেরহাট জেলার মোংলা উপজেলার শেহালাবুনিয়া গ্রামে। সাহিত্য জীবনে প্রবেশ ১৯৯৮ সাল থেকে – খুব অল্প বয়সে কাগজ কলম নিয়ে খেলতে শিখতে গিয়ে কবিতা রচনার অভিপ্রায় থেকেই। নিজের লেখাই তাঁর সাহিত্য জীবনের অনুপ্রেরণা। সাংবাদিকতার পেশায় দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে অসহায় ও বঞ্চিত মানুষের কথা লিখে চলছেন।