ছলচাতুরী
– বিমল মণ্ডল
১.
অকথিত বন্দি স্বরলিপি
উপাসনা চুপিসারে অন্দরমহলে
কয়েকটি ছিপ বড়শিগাঁথা
সময়ের অন্তর অন্তর ভাজা হয়
অচেনা বার্তার অলৌকিক উচ্ছ্বাস
স্বরলিপির উজান জোয়ার
ছলচাতুরীর অকৃপণ।
২.
একটু ভেবে দেখো
খুঁজে পাবে অতীতকে
কি ভাবে মেকিত্ব জালে
জড়িয়ে ফেলেছো
তোমারই প্রিয়জনে
দুই দিকে দুই স্তর
করেছে আঁধার পবিত্রালয়ে।
৩.
ন্যুনতম ব্যবহার আশাতীত
জীবনের কল ঘুরবে সবমিলে
তোমার প্রাণের প্রিয়টিকে
কোথাও পাবে না খুঁজে জেনে
তোমার দূরে পড়ে থাকা
কয়েকটি মাথা নামানো মানুষ
বিকল্পিত দাবার ছকে
নামহীন আরাধনায় মত্ত।
৪.
চক্রাকারে ঘোরে সময় লাটিম
তুমি-তারা – সে চেয়ে আছো নীলজোছনায়
প্রতিটি চোখ রাঘব-বোয়াল
দুন্দুভি’র শব্দ
প্রতিবাদ ছুঁড়ে ফেলে লক্ষ্য লক্ষ স্বপ্ন
বিতর্কের প্রক্রিয়া তারে
বিষণ্ণ হলুদ দাঁত
লজ্জা পায়।
৫.
সম্মানইতিহাস চয়ন করো
দেখতে পাবে তোমার সম্মানকথা
দু’একটা বৃত্তের ভেতর
কখনো অন্ধকার টানো না
যা বর্তমানে পরিস্থিতির ঘাতক স্বীকার
টেবিলের চৌহদ্দি ছেড়ে
গোলটেবিলের মোহড়ায় হয়তো ক্ষমতা পাওয়া যায়
কখনো উজ্জ্বল সম্মান আসে না।
৬.
কয়েকদিন আগের কথা বলি
হয়তো তোমার সময়ে মনে আসে না
কেননা বুদ্ধিবিমুখ নজরদারি
এই গোল পৃথিবীর প্রাঙ্গণে
তোমার আসে পাশে পরামর্শক সুখসংবাদ
মান্যতার অকারণ বাদানুবাদ
তুমি নিজেকে আলাদা করতে গিয়ে
দুঃসময়ে আমাকে চাও।
৭.
ঠিকঠাক বলতে পারি না
তোমার অযৌক্তিক অজুহাত
কারণ আমার কথা না শোনার ভান করে
চলে যাও পরমুহূর্তেই অন্য টেবিলে
যেখানে হাতেরপরে, মুখেরপরে
আমাকে জব্দ করার কৌশল শেখো
শেখানো কৌশলে শেষমেশ
আমার কাছে হাত বাড়াও।
৮.
তোমার মনে জিলিপির প্যাঁচ
সাহস কিংবা ভয়ে
আমার টেবিলের আড়ালে
তোমার ভালোলাগা প্রিয়দের চোখে চোখে হাঁটো
হিসেবের সাদা খাতায় বাচালতা
ঝুঁকে পড়ে তোমার চেনা সময়
ধীরে ফিরে যাই বাড়ি
তুমি তখন পূর্ণাঙ্গ এক মানুষ।
৯.
দাঁড়াও। একসঙ্গে এতো কথা বলো না
আমার বুঝতে অসুবিধা হয়
কারণ তোমার বুদ্ধির মত আমার ততটা নয়
তাই বলি মূল কথায় এসো
এতো এনিয়ে বেনিয়ে না বলাই ভালো
তোমার হঠাৎ আসার কারণটা সবার জানা
তবুও বলি কত দিতে হবে
তোমার বুদ্ধির গড়ে?
১০.
তোমার অভ্যেস কোলে-পিঠে করা
সাহস হয় না সবার কাছে আসা
আসলে ক্ষমতার চেয়ারে বসে ধরাকে সরা জ্ঞান
আসলে ভুলে যাও তোমার সমকক্ষ উপস্থিত সবাই
তাই তো দেওয়ালের এপার-ওপার
আমি আর তুমি
কতটা দূরত্বে থাকি।
১১.
একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর
চলে যেতে হবে সবাইকে
তাই আমি যাই
তুমি ঘড়ির কাঁটার দিকে চেয়ে
গুণতে গুণতে
নিজেকে হারিয়ে ফেলো
অপরের পরিশিলিত বাগানে।
১২.
লুকোচুরি যদি নিজেদের সীমানায়
বাস্তব বিশ্বাস কখনো ফিরে যায়
তবুও তুমি বেজায় কথা রসিক
ছলচাতুরীর প্রধানতম ম্যাজিক।
১৩.
নামের এতো আদব কায়দা
গুণাবলী আকাশ ছুঁয়ে
লোভের মাত্রা অগাধ সীমানা জুড়ে
খ্যাতিতে ভূমিকম্প ছড়ায়
গতদিনের ফুল হয় না উপকরণ
সেরূপ বুঝবে তুমি বেয়াদবের কারণ।
১৪.
তোমার কাছে চেয়েছিলাম একটা সহি
ছুঁড়ে দিলে, ছিঁড়েও তার কিছুটা কিছুটা
চোখে জল ভাবনায় অস্থির
সেদিন বুকে যন্ত্রণা চেপে
আমি হেঁটে যাই
তুমি ফিরেও তাকালে না
হাসি, ঠাট্টা তামাসা চলে অন্দরমহলে
কিছুকাল পরে তুমিও এলে
সেই আমার ঘরে
কিছুটা ভিক্ষুকের ছদ্মবেশে
এতোটাই না বলাই ভালো
কারণ তোমাকে এখনো ভালোবাসি
আজ ফুরাইনি আমি
ফিরিয়ে দিইনি তোমায়
ঠিক যেমন তুমি আমার ফিরেয়ে দিয়েছিলে।
১৫.
চারদিকে দলবল নিয়ে হুড়োহুড়ি
পাড়ায় পাড়ায় মুখোশধারীদের ভীড়
নিশ্বাসে নিশ্বাসে ধ্বংসের ঘ্রাণে
ডুবন্ত আকাশের নীচে
ধাঁধা লাগানো জানালার পাশে
স্তুপ আর স্তুপ ত্রাণ ঘেরা
আশাব্যঞ্জক নিরাশা পাড়ায় পাড়ায়
অনাহারে কাটে শিশুদের পেট
ওরা মুখোশের আড়ালে
আনন্দের হাসি হাসে।
১৬.
তোমার কামনা ঘোরতর রণে
নিশ্বাসে শত সহস্রবার ভয়ে
ছোটো-বড়ো দৃষ্টি অতীত-বর্তমান
সততার মৃত্যু ছদ্মবেশ বিবেক
আশার ব্যঞ্জনে শতাংশ আবর্ত আয়োজন
এই ভাবে বুনে চলে মৃত্যুর মিছিল
প্রাত্যহিক পর্বে বাঁচাতে না পারো
স্থির হও তবে।
১৭.
তুমি যদি কখনো আসো কাছে
আমি উপহার দেবো টুটি চেপে
তোমার গায়ে অতীত ইতিহাস
আর বর্তমানে কিড়মিড় কথা
আঁধার নামে শাদা আকাশ
আমায় জাগায় মুক্ত দেওয়ালে
তুমি তখন অন্ধকারেয় কোণায়
স্বপ্নে শুধু জেগে।
১৮.
নিঃশব্দে সামাল দিই আমার জীবনকে
ভয়, রাগ, আনন্দ মাঝেমধ্যে হাসে কাঁদে
শব্দের পর শব্দ আমারই আগ্নেয়াস্ত্র
এছাড়া কর্মহীন শরীর
সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা ভাঙে
তবুও বেয়ে যায় আমার জীবন রাত।
১৯.
তুমি কাছে এলে রাতের চোখ হয়ে
আমি আলোর প্রত্যাশায়
তোমারই ভালোবাসা খুঁটে খুঁটে
তৃপ্তির সাথে লুঠ করি
তোমার হাত মাথা, বুক, চোখ, ঠোঁট
অনুভূতির চুম্বন স্পর্শ করে
আমি ভাষা পাই
সম্পূর্ণ তোমার শরীরী আদরে।
২০.
মনে পড়ে গেল
হরেক সময়ের তাকের ভেতর
পথ চলতে চলতেই অতি ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠি
অক্ষর, বর্ণ, শব্দের সমগোত্রের
আমি উল্লাসে মাখিয়েছে
প্রকৃত নিখাদ শব্দ খেলায়
উঠেছি, পড়েছি, ভেঙেছি
শেষে এলোমেলো শরীরে গড়েছি
আমার যৌবনেরই কবিতা।
কবি পরিচিতি

বিমল মণ্ডল। জন্ম পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুর জেলার খেজুরী থানার চৌদ্দচুলী গ্রামে। অভাব তাঁর নিত্য সঙ্গী। মায়ের অভাবের সাথে যুদ্ধ করে বড়ো হওয়া। মা-ই ছিল তাঁর জীবন দর্শন। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে স্কুল জীবন শেষ করে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ পাশ। বর্তমানে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার নন্দীগ্রাম থানার অন্তর্গত আশদতলা বিনোদ বিদ্যাপীঠ (উচ্চমাধ্যমিক) স্কুলের সহকারী শিক্ষক।
লেখার নেশা স্কুল জীবন থেকে। প্রিয় নেশা বই পড়া এবং আঞ্চলিক গন মানুষের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ভাষা সংগ্রহ করা। প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ – অর্পণ, ফিরে পাওয়া কবিতা, শিরোনাম নেই, আকাশ তুমি জানো, বিশ্বাসের চুপকথা, বৃষ্টি আজ মেঘের আড়ালে, সরোবরের ভেতর চাঁদ। সম্পাদিত গ্রন্থ – শব্দ যখন…। উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ – কাজী নজরুল ইসলাম, প্রসঙ্গ কবি ও কাব্য। এছাড়া অজস্র বড় ও লিটল ম্যাগাজিনে গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ প্রকাশিত করে চলেছেন নিয়মিত। সাহিত্যাঙ্গনে তাঁর বিশেষ পরিচিতি রয়েছে অঙ্কুরীশা পত্রিকার সম্পাদক হিসাবে।