বিজয়ের লাল সূর্য
– বাসুদেব পাল
কয়েক দিন হলো যুদ্ধে যোগ দিয়েছে আবীর। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ শুনেছে সে। যেন এক যাদুমন্ত্র। শুধু আবীর নয়, বিভিন্ন বয়সের ছেলেরা, বিভিন্ন পেশার মানুষেরা স্বেচ্ছায় যোগ দিচ্ছে যুদ্ধে। জীবনের সোনালী সময় টুকু মাতৃভূমির মুক্তির জন্য উৎসর্গ করতে চায়।
কিন্তু আবীর যেন তাল মেলাতে পারছেনা সবকিছুতে। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে দুচোখের পাতা এক করতে পারছেনা আবীর। চোখ বন্ধ করলেই চোখের সামনে ভেসে উঠছে রেখার মুখ।
বছর তিনেক আগে এই এপ্রিলের কোন এক গোধুলি বেলায় রেখার সাথে ওর প্রথম পরিচয়। নদীর পাড়ে মুক্ত বাতাসে রেখার চোখের তারায় আবীর খুঁজে পেয়েছিল দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন আর অনাগত ভবিষ্যৎ। আবছা আলোয় ওরা হাত ধরেছিল দুজন। অস্তগামী সূর্য তার একটুখানি লাল রঙ দিয়ে রাঙ্গিয়ে দিয়েছিল রেখার মুখ। নীড়ে ফেরা পাখিরা পাখা নেড়ে দুর্বোধ্য ভাষায় ডেকে ডেকে কি যেন বলেছিল তাদের।
তারপর রেখার কি যে হলো তা বুঝতে পারেনি আবীর। কোন ভাবেই আর রেখার সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি।
মাঝে মাঝে আবীরের মনে হত, রেখা কি ভুলে গেল তাকে?
আবীর বুঝতে পারেনা সত্যিকারের প্রেমের কি মৃত্যু হয়? কাউকে প্রকৃত ভালবাসলে কি তাকে ভুলে যাওয়া যায়? কই , আবীর তো ভুলতে পারেনি রেখাকে। একটি দিনও থাকতে পারেনি রেখাকে না ভেবে।
নতুন পরিবেশে রেখাকে খুব বেশি মনে পড়ছে আবীরের। যে রেখা হাতে ফুল দিয়ে আবীরকে বলেছিল, ‘জানিনা কিভাবে আপনার মনের ভিতর যেতে পারব ?’
আবীর কোন কিছু না ভেবেই রেখাকে মনে স্থায়ী আসন দিয়েছিল। আর আজ কিনা সেই রেখাই ভুলে গেল?
অনেক ভেবে আবীর সিদ্ধান্ত নেয় যে ভাবেই হোক দেখা করবে রেখার সাথে। সন্ধ্যা নামতেই আবীর উদ্দেশ্য পুরণে রওনা হয়।
তখন মাথার উপরে উঁকি দিচ্ছে শুক্লা দশমীর চাঁদ। বট গাছের আড়ালে ক্ষীণ আলোতে আবীরের নিকট রেখাকে খুব অচেনা মনে হচ্ছে। রেখার কথা, আচরণ আজ খুব অপরিচিত মনে হচ্ছে ওর কাছে।
এতদিন পরে আবীরের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠল। রেখা মুখের উপর বলেই দিল, ‘আপনার এ অবস্থায় আমার মা বাবা কোন ভাবেই মেনে নিবেনা। আমাকে পাওয়ার মত যোগ্যতা অর্জন করেন’।
আবীর বুঝতে পারেনা ভালবাসার মাঝে যোগ্যতা কিভাবে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। যতটুকু যোগ্যতা আছে তাতে রেখার অযোগ্য হয়তো সে নয়। নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকে আবীর ।
রেখা তার পরিচিত পথ বেয়ে হেঁটে যায় বাড়ির দিকে। যতক্ষণ দেখা যায় আবীর এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তারপর সে ও শুকনো ঝরা পাতায় শব্দ তুলে দ্রুত এগিয়ে যায় ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে। নির্বাক গাছগুলো শাখা নেড়ে সান্ত্বনা দেয় আবীরকে।
রাত সাড়ে বারোটায় সুজানগর অপারেশন। উদ্দেশ্য পাকবাহিনীর ঘাটি উড়িয়ে দেয়া। শত কষ্টের মাঝেও আবীর মনে পায় এক অপরিমেয় শক্তি। হৃদয়ে আজ তার বেজে ওঠে শিকল ছেড়ার গান। আজ সে পিছুটান মুক্ত।
হাতে আজ মেশিন গান তুলে নেয় আবীর। আজ সে সম্মুখ যোদ্ধা। কোন মতেই পিছু হটবেনা সে। মুহুর্তেই গর্জে ওঠে হাতের অস্ত্র। ছিন্নভিন্ন হচ্ছে শত্রুর দেহ। ধ্বংস হচ্ছে তাদের আস্তানা। ভয়ে শত্রুরা পালিয়ে যাচ্ছে। কি অপুর্ব আনন্দ চোখে মুখে!
হঠাৎ একটি গুলি এসে লাগে আবীরের বুকের হৃদপিন্ড বরাবর। লুটিয়ে পড়ে সে। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে। তার চোখের কোনে উঁকি দেয় বিজয়ের উদীয়মান লাল সূর্য। সে সূর্য যেন সিঁদুরের লাল টিপ হয়ে স্থান করে নেয় রেখার ভ্রু যুগলের ঠিক মাঝে।
লেখক পরিচিতি

বাসুদেব কুমার পাল। জন্ম রামপাল উপজেলার বড়দিয়া গ্রামে ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে, পিতা মণিদ্রনাথ পাল ও মাতা সরোজিনী পাল। বি, এসসি(অনার্স) ও প্রাণিবিজ্ঞানে এম,এসসি ডিগ্রী অর্জনের পর এখন আমড়াতলা চাঁপড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক পদে এখন কর্মরত। ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত – স্ত্রী লাবনী পাল এবং বাণী ও বর্ণ নামে দুই সন্তানের জনক।
ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখির শুরু। ছাত্রজীবনেই খুলনার বিভিন্ন দৈনিকে অনেক কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে খুলনার দৈনিক জন্মভূমি পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে কবির কবিতা। এছাড়া তিনি উপন্যাসও লিখে থাকেন। – এ পর্যন্ত প্রকাশিত উপন্যাস একটি – স্বপ্নের মৃত্যু, অপ্রকাশিত উপন্যাস চারটি। তিনি আরো লিখেছেন ছোট গল্প ও ছোটদের জন্য ছড়া এবং রচনা করেছেন আধুনিক গান। শখের বসেই তার লেখালেখি, অবসর কাটে লিখে ও বই পড়ে। কবির লেখার ভিতর সম-সাময়িক বিষয় ও প্রকৃতিই প্রধান্য পায় বেশী।